স্বৈরশাসনের পতন
যে যাত্রা শুরু হয়েছিল আরো আগে
৬ ডিসেম্বর ২০১৫ এরশাদ সরকারের পতনের ২৫ বছর। আট বছরের বেশি সময় ক্ষমতায় থাকার পর গণ-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পতন হয়েছিল সেনাশাসক জেনারেল এইচ এম এরশাদের। কিন্ত এটিকে কেবল এরশাদ সরকারের পতন বলেই বিবেচনা করা যাবে না, একার্থে ১৯৭৫ সাল থেকে ক্ষমতার হাত বদল এবং অব্যাহত সেনাশাসনের যে ধারা তার অবসান ঘটেছিল এই দিন। বাংলাদেশের রাজনীতি ও সমাজের গণতন্ত্রায়নের সম্ভাবনা তৈরি করেছিল এই আন্দোলন এবং স্বৈরাচারের পতন। বাংলাদেশে যাদের বয়স এখন তিরিশের নীচে তাঁদের কাছে এসব ঘটনা বড়জোর দূরশ্রুত কাহিনী, বিস্মৃত ঘটনা পর্যন্ত নয়। তাঁরা বড়জোর জানেন নব্বইয়ের আন্দোলনের কথা যার সূচনা হয়েছিল ১৯৯০ সালের ১০ অক্টোবর। কিন্ত সেই আন্দোলনের পেছনে আরো অনেক ঘটনা, আরো অনেক আত্মদান রয়েছে যা একটু একটু করে তৈরি করেছিল সাফল্যের পথ। আজ যখন নব্বইয়ের উত্তাল আন্দোলনের ইতিহাস বিস্মৃত; সেই সময়ের পর্যুদস্ত স্বৈরশাসক কেবল পুনর্বাসিতই নয়, ‘সম্মানিত’ ও ‘সম্মানীয়’– সেই সময় আবারও স্মরণ করা দরকার সিকি শতাব্দী আগের এই আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল কেমন করে।
তার জন্য আমাদের আরো কয়েক বছর পেছাতে হবে, ফিরতে হবে এক মধ্য ফেব্রুয়ারিতে যে মধ্য-ফেব্রুয়ারি ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’র কথা জানে না। সেটি ১৯৮৩ সালের ১৪-১৫ ফেব্রুয়ারি। এক আশ্চর্য সময় এসেছিল এই দেশে। কী ঘটেছিল সেসব দিনে? রক্তের আখরে লেখা সেই সব দিন আত্মত্যাগের, সেই সব দিন অধিকারের প্রশ্নে আপসহীন সংগ্রামের। এই সংগ্রামের উল্টো দিকে আছে পলায়ন ও বিশ্বাসঘাতকতার কাহিনী, তাও এই সব দিনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। গণতন্ত্র ও শিক্ষার অধিকার প্রশ্নে সেই ফেব্রুয়ারিতে দেশের তরুণদের এক বড় অংশ জীবন বাজি রেখে রাজপথ প্রকম্পিত করেছিল, সামরিক শাসনের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে প্রাণ দিতে কুণ্ঠিত হয়নি। সেই ইতিহাস এখন বিস্মৃত; যাঁরা ইতিহাস লেখেন এবং বলেন তাঁদের কাছে সেই সব দিন ফুটনোটের যোগ্য বলে বিবেচিত হয় না বলেই মনে হয়। যাঁরা এই ইতিহাসের সামান্য জানেন তাঁরা এটুকু জানেন যে সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মিছিলে গুলিবর্ষণ হয়েছিল, প্রাণ দিয়েছিলেন কয়েকজন, বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনে পুলিশের হামলার ঘটনা ঘটেছিল, হাজার হাজার ছাত্রকে আটক করা হয় এবং সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু নব্বইয়ের আন্দোলনের পেছনে যেমন ১৯৮৩ সালের মধ্য-ফেব্রুয়ারি, তেমনি সেই মধ্য ফেব্রুয়ারি একদিনে তৈরি হয়নি।
এই ঘটনাবলীর পটভূমি তৈরি হয়েছিল ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ যখন দেশে সামরিক শাসন জারি করে অবৈধভাবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন সেনাপ্রধান জেনারেল হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ। ‘রক্তপাতহীন’ এই ক্ষমতা দখলের পটভূমি সৃষ্টি হয়েছিল তারও আগে, ক্ষমতাসীন বিএনপির অভ্যন্তরীণ কলহ-কোন্দল এবং উচ্চাভিলাষী সেনা কর্মকর্তাদের ষড়যন্ত্রই কেবল নয়, তার সঙ্গে যুক্ত ছিল আরো অনেক কিছু। কোনো কোনো সংবাদপত্রের সম্পাদকীয়তে এই পরিবর্তন স্বাগত জানানোর বিষয় কারো কারো মনে থাকবে। সেনাশাসন জারির সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ– ডাকসুর পক্ষ থেকে লিখিতভাবে চিঠি দিয়ে ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে আলোচনার সূত্রপাত হলো ১৯৮২ সালের মার্চের শেষ সপ্তাহে। সম্মিলিতভাবে প্রতিবাদের তাগিদ থাকলেও কৌশলের প্রশ্নে বিভক্তি, ঐক্যের শরিকদের বিষয়ে ভিন্নমত, দাবি-দাওয়ার বিষয়ে বিভিন্ন চিন্তা এই প্রক্রিয়াকে করল শ্লথ। তা ছাড়া আলোচনার এই পর্যায়ে ডাকসু, বাসদ সমর্থিত ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, আওয়ামী লীগ সমর্থিত ছাত্রলীগ, জাতীয় ছাত্রলীগ, জাসদ সমর্থিত ছাত্রলীগ, বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র ঐক্য ফোরামসহ অনেক সংগঠন ঐক্যবদ্ধ হলেও এই প্ল্যাটফর্মে বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলের অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নটি একটি বিভেদসূচক বিষয়ে পরিণত হলো। কোনো কোনো সংগঠন এই বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করলেও, কিছু সংগঠন সুস্পষ্টভাবেই জানিয়ে দেয় যে ছাত্রদলকে যুক্ত করা হলে তাঁদের পক্ষে এই প্রচেষ্টায় শামিল হওয়া সম্ভব হবে না। কয়েকটি বামপন্থী ছাত্র সংগঠন এই প্রচেষ্টার বাইরে থাকাকেই সঠিক বলে সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে এই ঐক্য প্রচেষ্টা থেকে ছাত্রদল এবং কয়েকটি ছাত্র সংগঠন বাইরে থেকে যায়। যেহেতু ক্ষমতাসীনদের প্রতি সমাজে ক্ষোভ বিরাজমান ছিল সেহেতু সাধারণ মানুষের মধ্যে থেকে আশু কোনো রকম প্রতিবাদের শক্তি গড়ে ওঠার বিষয়ে ছিল সন্দেহ। সেই প্রেক্ষাপটে ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে আলোচনা- মতবিনিময় চলতে থাকল গোটা গ্রীষ্মকাল ধরে। এই সম্মিলিত চেষ্টার ফসল হিসেবে বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলনের স্মৃতিবাহী ১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষা দিবসকে সামনে রেখে ১৬ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মৌন মিছিল বের করা হয়। সেই রাতে শিক্ষা দিবসের পোস্টার লাগাতে গিয়ে আটক হন বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর তিন জন কর্মী- শিবলী কাইয়ুম, হাবিবুর রহমান ও আবদুল আলী। একার্থে দেশে সেনা শাসনের সূচনার ১৭৫ দিন পরে একটি মৌন মিছিলের মধ্য দিয়েই ভেঙেছিল পিনপতন নীরবতা। এর সাতদিনের মধ্যে সামরিক সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা আবদুল মজিদ খান ঘোষণা করেন নতুন শিক্ষানীতি। এই নতুন নীতিকে প্রত্যাখ্যান করার অন্যতম কারণ ছিল যে এর মধ্য দিয়ে উচ্চশিক্ষার সুযোগ সীমিত করার কথাই বলা হয়েছিল। ফলে ছাত্র সংগঠনগুলো তাদের এতদিনের মতপার্থক্যকে পাশে রেখে শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে আন্দোলন তৈরির বিষয়ে দ্রুত ঐকমত্যে পৌঁছাতে সক্ষম হয়। ৫ অক্টোবর তাদের সেই ঐক্য প্রচেষ্টা সুস্পষ্ট আকার নেয় ১০টি ছাত্র সংগঠন এবং ডাকসুর যুক্ত বিবৃতিতে। তার এক মাসের মধ্যে ৭ নভেম্বর পালন উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জাসদ সমর্থিত ছাত্রলীগের একটি মিছিল পুলিশ হামলা চালায় এবং সবার ওপরে চড়াও হয়, যাতে দুজন শিক্ষক – নুরুল আমিন ব্যাপারী ও মাহমুদা খাতুন আহত হন।[এই ঘটনার বর্ণনা বা ছবি প্রকাশিত হয়নি মূলধারার সংবাদপত্রগুলোতে সেন্সরশিপের কারণে; ডাকসুর ছাত্রবার্তার বিশেষ সংখ্যায় এসব ছবি ছাপা হয়েছিল। কোনো প্রেসে এই সংখ্যাটি কম্পোজ করার সুযোগ না থাকায় কেবল ছবি এবং ক্যাপশন দিয়ে ছবিগুলো প্রকাশ করা হয়। যত দূর স্মরণে আছে এই ছবিগুলোর ক্যাপশন লিখে দিয়েছিল লুতফর রহমান রিটন; সম্ভবত মারুফ চিনু এবং রিটনের ছড়াও ছাপা হয়েছিল ওই সংখ্যায়।] ৮ নভেম্বর ঢাকায় এবং ১৪ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পালিত হয় ছাত্র ধর্মঘট। এই ঘটনার পর ছাত্র সংগঠনগুলো ছাত্র আন্দোলনের কাঠামো গড়ে তোলার বিষয়ে একমত হয় এবং ২১ নভেম্বর ডাকসু ও ১৪টি ছাত্র সংগঠন মিলে মধুর ক্যান্টিনে সাংবাদিক সম্মেলন করে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠনের ঘোষণা দেয়। দাবি ছিল তিনটি- পূর্ণ গণতন্ত্র ও মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা; প্রস্তাবিত শিক্ষানীতি বাতিল; এবং ছাত্রবন্দিদের মুক্তি ও দমন নীতি বন্ধ করা। সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ১৩ ডিসেম্বর পালিত হয় ছাত্র ধর্মঘট; বটতলায় ঘোষণা করা হয় যে ১১ জানুয়ারি ‘শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্দেশ্যে শান্তিপূর্ণ দাবি মিছিল।’
সেই মিছিলের আগেই শুরু হয় বিভিন্নমুখী ঘটনা প্রবাহ। ৫ জানুয়ারি শিক্ষামন্ত্রী ছাত্র নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের প্রস্তাব করলে ছাত্র নেতারা তা এক কথায় নাকচ করে দেন; ৬ জানুয়ারি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চ্যান্সেলর বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আলোচনার প্রস্তাব পাঠালে ছাত্র নেতারা তা এই বলে নাকচ করে দেন যে সুনির্দিষ্ট এজেন্ডা ছাড়া তাঁরা কোনো আলচনায় যাবেন না। পরের দিন অর্থাৎ ৮ জানুয়ারি পরিষদের যে বিবৃতি এক ‘সংবাদে’ প্রকাশিত হয় তাতে দেখা যায় যে নেতারা শিক্ষানীতি বাতিল এবং আটক ছাত্রদের মুক্তি ছাড়া আলোচনায় বসতে রাজি নন। (এই বিবৃতি প্রকাশের কারণে সংবাদকে পরে যে ধরনের চাপ সহ্য করতে হয়েছিল সেটি সংবাদে কর্মরত সাংবাদিক হিসেবে প্রত্যক্ষ করেছি।) পরের দুইদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ফজলুল হালিম চৌধুরীর মাধ্যমে দ্বিপক্ষীয় দর কষাকষি চলতে থাকে। উপাচার্য মহোদয় শিক্ষক হিসেবে ছাত্রদের যেমন এর পরিণতি বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন ঠিক তেমনি মনে করিয়ে দিয়েছেন যে সিদ্ধান্ত ছাত্র নেতাদের, তিনি মাধ্যম মাত্র এবং তাঁদের ব্যাপারে জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা যেন নেতারা বিস্মৃত না হন। ৯ তারিখ রাতে কোনো রকম আলোচনার সম্ভাবনা শেষ হয়ে যাওয়ার পর সরকারের পক্ষ থেকে কড়া হুঁশিয়ারি সংবলিত প্রেসনোট জারির ঘটনা ঘটে। ১০ তারিখের সংবাদপত্রে সেই হুঁশিয়ারির পাশাপাশি প্রকাশিত হয়েছিল ১৮টি রাজনৈতিক দলের একটি বিবৃতি। এই বিবৃতিটিতে স্বাক্ষর জোগাড় করা হয়েছিল পূর্ববর্তী কয়েক দিন ধরে কার্যত ঘরে ঘরে গিয়ে। তাতে স্বাক্ষর দেওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতাদের দ্বিধা এবং অনীহা দুই-ই ছিল ছাত্র সংগঠনগুলোর জন্য শিক্ষামূলক। তারা বুঝতে পারছিল যে রাজনৈতিক দলগুলো আন্দোলনের জন্য প্রস্তত নয়। ১০ তারিখ সরকারি প্রেসনোটের ব্যাপারে ছাত্ররা যখন বিক্ষুব্ধ সে সময় ছাত্র নেতারা ব্যস্ত ওই আঠারো দলের নেতাদের বক্তব্য শুনতে। ফলে ১১ জানুয়ারি সকালে ছাত্র নেতারা যখন সিদ্ধান্ত নিলেন যে তাঁরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে মিছিল নেবেন না; বরঞ্চ শহীদ মিনারে যাবেন তখন কর্মীদের একাংশ নেতৃত্বের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করলেন। হৈ হট্টগোলের মধ্যে দ-একটি দলের কয়েকজন মধ্যসারির নেতার নেতৃত্বে কিছু ছাত্রছাত্রী শিক্ষা ভবন অভিমুখে মিছিল করে চলে গেল। এই অংশ ডাকসু ভবন তছনছ করে ফেলল। তারা একটি পালটা সংগ্রাম পরিষদ গঠনের ঘোষণা দিল। প্রকৃতপক্ষে, ১১ জানুয়ারির আগের কয়েক দিন নেতারা সরকারের সঙ্গে আলোচনা করা না করা নিয়ে নিজেদের মধ্যে বৈঠক এবং মধ্যস্থতাকারীর সঙ্গে সময় ক্ষেপণের কারণে নেতা ও কর্মীদের মধ্যে তৈরি হয়েছিল বিস্তর ব্যবধান। জাতীয় নেতাদের অনুরোধেই যে এই কর্মসূচি বদল হয়েছে কর্মীদের একাংশ সেটা মানতে রাজি ছিল না।
১৪ জানুয়ারি জেনারেল এরশাদ জামায়াতে মুদাররিসিনের সম্মেলনে ঘোষণা করেন যে এখন থেকে একুশে ফেব্রুয়ারিতে শহীদ মিনারে শহীদদের উদ্দেশে কোরআন তেলওয়াত করা হবে; তিনি এও ঘোষণা করেন যে তার লক্ষ হচ্ছে বাংলাদেশে ইসলামী ব্যবস্থা কায়েম করা। এই ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে বিবৃতিদানকারী ১৮ দলের মধ্যে ১৫টি দল প্রতিবাদ করে বিবৃতি দিয়ে ঘোষণা করে যে তারা একত্রে একুশে উদযাপন করবে। পাশাপাশি জাতীয় একুশে উদযাপন কমিটি গঠিত হয়, গড়ে ওঠে ‘সাংস্কৃতিক জোট’। [এই দুটো উদ্যোগের সঙ্গে শুরু থেকে যুক্ত থাকবার সূত্রে এ কথা স্মরণ করতে পারি যে একেবারে গোড়ার দিকে উদীচীর মাহমুদ সেলিম, মফিদুল হক এবং সাংবাদিক ফয়েজ আহমদের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য।] পরবর্তী দিনগুলোতে পরিষদের অভ্যন্তরীণ ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটে এবং ১৪ ফেব্রুয়ারি শিক্ষা ভবন অভিমুখে কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। ছাত্রদের মধ্যে যে ক্রমাগতভাবে একটি লড়াকু মনোভাব গড়ে উঠছিল সেটা বোঝা যায় যখন ৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবির কর্মীদের সঙ্গে সংগ্রাম পরিষদের কর্মীদের সংঘর্ষের ঘটনায়। নেতাদের আটকের ঘটনা ঘটতে থাকে যা ছাত্রদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করে।
এই প্রেক্ষাপটে ১৪ ফেব্রুয়ারি সকালে যখন হাজার হাজার ছাত্র বটতলায় সমবেত হয় তখনো কারো কল্পনায়ও ছিল না আগামী কয়েক ঘণ্টায় কী ঘটতে যাচ্ছে। শান্তিপূর্ণ মিছিল শিক্ষা ভবনে যাওয়ার আগেই কার্জন হলের মোড়ে (হাইকোর্টের গেটে) পুলিশের কাঁটাতারের ব্যারিকেডের মুখোমুখি হলো। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সেখানেই বসে পড়ার কথা, তার আগেই শুরু হলো টিয়ার গ্যাস, কিছুক্ষণের মধ্যেই গুলি ছুটতে শুরু করল, চোখের সামনে লুটিয়ে পড়ল কয়েক জন। ছত্রভঙ্গ মিছিল থেকে সরে আসা ছাত্রদের অনেকে কার্জন হল প্রাঙ্গণ থেকে সামান্য প্রতিরোধের চেষ্টা চালিয়ে গেলেও তা যে বেশিক্ষণ টিকবার নয় সেটা বুঝতে কারো বাকি ছিল না। মিছিলের শেষের ভাগে যাঁরা ছিলেন তাঁদের কেউ কেউ শিশু একাডেমিতে আশ্রয়ের জন্য ছুটে গেলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে শিশু একাডেমি প্রাঙ্গণ রক্তাক্ত হয়ে উঠল; শিশুদের অনুষ্ঠান চলছিল– কিন্তু শিশু এবং তাদের অভিভাবকরাও এই আক্রমণ থেকে রক্ষা পেলেন না। যাঁরা সেখানে ছিলেন তাঁদের ভাষ্য অনুযায়ী এ্কটি শিশুর মৃতদেহ পুলিশ তাদের গাড়িতে তুলে নিয়েছিল। মেডিক্যাল কলেজের জরুরি বিভাগ মুহূর্তে ভরে উঠল গুলিবিদ্ধ, টিয়ার গ্যাস আর লাঠির আঘাতে আহতদের দিয়ে। [কার্জন হলের প্রাঙ্গণে ছিলেন সে সময় বিবিসির সাংবাদিক আতাউস সামাদ, যিনি আমার শিক্ষকও; এই অবস্থার মধ্যে প্রবীণ এই সাংবাদিক আমাকে বলেছিলেন ‘এই অবস্থা আইউব আমলেও দেখি নাই’।] ছত্রভঙ্গ মিছিলের কর্মীরা খুব কম সময়ের মধ্যেই পুনরায় জড়ো হলো কলা ভবনের সামনে। ছাত্র নেতারা এসে পৌঁছাবার আগেই নতুন কর্মসূচির দাবি উঠল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ছাত্রনেতারা আসলেন। ইতিমধ্যে মেডিক্যাল কলেজ থেকে এসে পৌঁছাল শহীদ জয়নালের লাশ। অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে রাখা সেই লাশ সামনে রেখে শপথ উচ্চারিত হলো এই সংগ্রাম চলবে। ইতিমধ্যে জাতীয় রাজনৈতিক নেতারা এলেন। আপাতদৃষ্টে মনে হলো এতদিনের দ্বিধা কাটিয়ে তাঁরা রাজপথে নামতে প্রস্তত।
জাতীয় নেতারা বটতলা ছেড়ে যাওয়ার মুহূর্তের মধ্যে রায়ট পুলিশের বাহিনী নেমে এলো পঙ্গপালের মতো, নির্বিচারে আক্রমণ। জয়নালের লাশ নিয়ে ছাত্রদের একাংশ ছুটে গেল ছাত্রাবাসে। কিন্তু সব ক্যাম্পাস তখন পুলিশের নিয়ন্ত্রণে। নির্বিচারভাবে লাঠিচার্জ, নিপীড়ন চলল সারারাত ধরে; যেখানে যাকে পাওয়া গেল তাকেই আটক করা হলো, শহরে সান্ধ্য আইন জারি হলো। হল থেকে জয়নালের লাশ নিয়ে গেল পুলিশ। ছত্রভঙ্গ ছাত্র নেতৃত্ব পারস্পরিক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল; তারপরও পরের দিন ডাকা হলো সারা দেশে হরতাল। সেই ডাকে সারা দিয়ে ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে অনেক যায়গায় ছাত্ররা পথে নামল, নির্বিচার গুলিতে নিহত হলো। জাতীয় রাজনীতির নেতারা আটক হলেন, তাঁদের কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সে কথা জানা গেল না।
সংগ্রাম পরিষদের একাংশ ১৮ থেকে ২০ তারিখের কর্মসূচির ডাক দিল, যা আশানুরূপ সাফল্য লাভ করল না। কতজন নিহত হয়েছিলেন তাঁর কোনো হিসাব শেষ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি; কিন্তু কমপক্ষে ১০ জনের নিহত হওয়ার খবর সংগ্রহ করা গিয়েছিল। দেশে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্ট কালের জন্যে বন্ধ হয়ে গেল। এর মধ্যে জানা গেল ১৪ তারিখ রাতে যখন সারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশ ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ফজলুল হালিম চৌধুরী ছাত্রদের ওপরে হামলা বন্ধ করতে এবং তাঁদের পাশে গিয়ে দাঁড়াবার জন্য চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু পুলিশ তাঁকে তাঁর নিজ বাসভবন থেকে বেরুতে দেয়নি; প্রতিবাদে তিনি পদত্যাগ করেন পরের দিন। মধ্য ফেব্রুয়ারি যেমন সাহসিকতার গৌরবে উজ্জ্বল তেমনি তার মধ্যে আছে ব্যক্তিবিশেষের বিশ্বাসঘাতকতার কলঙ্কজনক ইতিহাস। ১৪ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় যখন সাধারণ ছাত্রদের আহাজারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাতাস ভারী হয়ে উঠছিল, হাজারে হাজারে ছাত্র আটক হচ্ছিল সেই সময় সেই বিশ্ববিদ্যালয়েরই একটি হলের হাউস টিউটরের গৃহ থেকে সেনাবাহিনীর নিরাপত্তায় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন ডাকসুর তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক জিয়াউদ্দিন বাবলু। আক্ষরিক অর্থেই সহযোদ্ধাদের রক্তের ওপর পা দিয়ে স্বৈরশাসকের সঙ্গে হাত মেলানোর এ রকম আর কোনো উদাহরণ বাংলাদেশের ইতিহাসে আছে বলে আমার জানা নেই।
এসব রক্তপাত, এই সব আত্মদানের মধ্য দিয়ে যে আন্দোলনের সূচনা তার উত্থান হয়েছে, পতন হয়েছে, যুক্ত হয়েছে সাহসিকতার উদাহরণ তেমনি তাতে আরো অনেক বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাসও যুক্ত হয়েছে পরবর্তী বছরগুলোতে। কিন্তু গণতন্ত্রের জন্য, মৌলিক অধিকারের জন্য মানুষের যে আকুতি তাই একে নিয়ে গেছে সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে, নিয়ে গেছে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বরে। আমরা ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বরের ইতিহাসকে স্মরণ করব, তার পেছনের ইতিহাসকে স্মরণ করব; সেই সঙ্গে এই প্রশ্নও কি করব না - রাজনীতি ও সমাজের গণতন্ত্রায়নের অমিত সম্ভাবনার যে বিদ্যুৎচ্ছটা আমরা দেখতে পেয়েছিলাম, যে আলো সেদিন জাতিকে পথ দেখিয়েছিল তার কতটা বাস্তবায়িত হলো, কতটা হারাল?
লেখক : যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের প্রধান