বিজয়ের এই দিনে
ভারতের স্বীকৃতিদান, শক্রমুক্ত হচ্ছিল বিভিন্ন জেলা
দ্বিতীয় দেশ হিসেবে ভারত বাংলাদেশকে এই দিনে স্বীকৃতি দিয়েছে। এর আগে ৫ ডিসেম্বর সর্বপ্রথম দেশ হিসেবে ভুটান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল বলে অনেক ইতিহাসবিদের লেখাতেই ফুটে উঠেছে। তবে কেন অনেক তথ্যগ্রন্থতে ভারতকে প্রথম স্বীকৃতিদানকারী দেশ হিসেবে লেখা হয়, তা অন্তত আমার জানা নেই।
এখানে একটা বিষয় বলা যেতে পারে, ভারত সরকারের এ স্বীকৃতি ছিল আনুষ্ঠানিকভাবে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী লিখিত পত্রের মাধ্যমে বাংলার প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে এ সিদ্ধান্ত জানিয়েছিলেন। হয়তো ভুটানের স্বীকৃতিটা এদিক হতে ব্যতিক্রম ছিল।
লোকসভায় দাঁড়িয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, ‘সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করার পর স্থায়ী মন্ত্রিসভার বৈঠকে ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শুধু ভাবাবেগে পরিচালিত হয়ে নয়, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি সম্পূর্ণরূপে বিচার করেই স্বীকৃতি দিচ্ছি।’
স্বীকৃতি পেয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। তিনি ভাষণের মাধ্যমে ভারতের জওয়ানদের অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, ‘ভারতের সেনাবাহিনীর জওয়ানরা আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বাংলাদেশের মাটি থেকে হানাদার শত্রুদের নির্মূল করার জন্য আজ যুদ্ধ করে চলেছে।’
অন্যদিকে, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ায় ভারতের সঙ্গে তাৎক্ষণিক কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে পাকিস্তান।
একই কারণে যুক্তরাষ্ট্র ভারতে অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধ করে দেয়। পাশাপাশি উত্তর ভিয়েতনামে যুদ্ধরত চীন সাগরে অবস্থিত মার্কিন সপ্তম নৌবহরকে বঙ্গোপসাগরের দিকে যাত্রার নির্দেশ করে।
ভারত কর্তৃক বাংলাদেশের স্বীকৃতির বিষয়টি, বিশেষ করে ৭ ডিসেম্বর বিভিন্ন মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচার করা হয়েছিল। যেমনটি আমরা দেখেছিলাম আনন্দবাজার পত্রিকার ক্ষেত্রে।
তারা তাদের সম্পাদকীয়তে লেখে, ‘স্বীকৃতির তিলক বাংলাদেশের ললাটে। বাংলাদেশের আজ বিচলিত হওয়ার কিছু নাই। সূর্যোদয়কে যাহারা অস্বীকার করে, তাহারা অন্ধ মাত্র, অস্বীকৃতির দৃষ্টিহীনতা সকালের রশ্মিজলকে মিথ্যা করিয়া দিতে পারে না।’
৬ ডিসেম্বরের এই দিনে হানাদার মুক্ত হয় যশোর ও কুড়িগ্রাম জেলা। তবে এর মধ্যে যশোর প্রথম।
ভারত-বাংলাদেশ যৌথ কমান্ড বাহিনীরর আক্রমণে যশোর ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় হানাদার বাহিনী। ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে তারা খুলনার শিরোমণিতে অবস্থান নেয়। কুড়িগ্রাম জেলাটি তখন একটি মহকুমা ছিল, যার অধীনে ছিল আটটি থানা। এ অঞ্চলের মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে ভারতীয় বাহিনীর ষষ্ঠ মাউন্টেন ডিভিশন যোগ দিয়েছিল।
মূলত মুক্তিবাহিনী ১ ডিসেম্বরই কুড়িগ্রাম শহরটির চারদিকে কৌশলগত অবস্থান নেয়। ৬ তারিখ পর্যন্ত তারা নিয়মিত শক্রবাহিনীর ওপর আক্রমণ চালাতে থাকে, যার চূড়ান্ত ফল পাওয়া যায় ৬ ডিসেম্বর বিকেলবেলায়।
এ অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদান রাখার জন্য শহীদ লেফটেন্যান্ট আশফাকুস সামাদ বীর উত্তম (মরণোত্তর) খেতাব পান। বীর বিক্রম খেতাব অর্জন করেন শওকত আলী ও সৈয়দ মনসুর আলী টুংকু। বীর প্রতীক খেতাব পান বদরুজ্জামান, আবদুল হাই সরকার, আবদুল আজীজ ও তারামন বিবি। আমরা সেতারা বেগমসহ যে দুজন নারী মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতির কথা জানি, তার মধ্যে এই তারামন বিবি একজন। এর মধ্যে সেতারা বেগম ছিলেন সেনাবাহিনী আর তারামন বিবি গণবাহিনীর সদস্য। তবে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন দলিলপত্র থেকে ২০৩ জন রণাঙ্গনের নারী মুক্তিযোদ্ধার কথা জানা যায়। আর বীরাঙ্গনাসহ অসংখ্য নারীর অবদান এখনো রয়েছে ইতিহাসের গোপন পাতায়।
এ দিনেই শত্রুমুক্ত হয় ফেনী অঞ্চল। দশম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও সাব-সেক্টরের মুক্তিবাহিনী কর্নেল জাফর ইমামের নেতৃত্বে ফেনী মুক্ত করেন।
মেজর জলিলের নেতৃত্বাধীন সৈনিকরা সাতক্ষীরা মুক্ত করে খুলনার দিকে এগোতে থাকেন। ঝিনাইগাতীর আহম্মদনগর হানাদার বাহিনীর ঘাঁটি আক্রমণ করেন কোম্পানি কমান্ডার মো. রহমতুল্লাহ।
পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও মুক্ত করে সেদিন বীরগঞ্জ ও খানসামার পাকিস্তানি অবস্থানের দিকে এগিয়ে চলছিল মিত্রবাহিনী।
এদিকে লাকসাম, আখাউড়া, চৌদ্দগ্রাম ও হিলিতে মুক্তিবাহিনী দৃঢ় অবস্থান নেয়। রাতে আখাউড়া ও সিলেটের শমসেরনগর যৌথ বাহিনীর অধিকারে আসে। ঝিনাইদহও শক্রমুক্ত হয়।
একটানা তিন দিনের অভিযানের পর ৬ ডিসেম্বর মুক্ত হয় হবিগঞ্জ। মুক্তিযোদ্ধারা সদর থানায় বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। মুক্তিযেদ্ধের উপ-সর্বাধিনায়ক মেজর জেনারেল এম এ রব (বীর উত্তম) ও মেজর জেনারেল এজাজ আহমেদ চৌধুরীর নির্দেশে ভারতের বাঘাই ক্যাম্পের ২২ কোম্পানির ৩৩ মুক্তিফৌজ নিয়ে গঠিত ১ নম্বর প্লাটুন কমান্ডার আবদুস শহীদের নেতৃত্বে এ স্থানে যুদ্ধ হয়।
ওই দিন একই সঙ্গে হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ, লাখাই, চুনারুঘাট ও অন্যান্য উপজেলাও মুক্ত হয়।
আর এই হবিগঞ্জ মুক্ত করতে গিয়ে বানিয়াচং উপজেলার মাকালকান্দি, লাখাই উপজেলার কৃষ্ণপুর, চুনারুঘাট উপজেলার লাল চান চা বাগান, নালুয়া চা বাগান ও বাহুবল উপজেলার রশিদপুরসহ বিভিন্ন স্থানে এক হাজারের বেশি মুক্তিকামী নারী-পুরুষ প্রাণ হারান। কিছু হানাদারও নিহত হয়।
পাশাপাশি শ্রীমঙ্গল, বড়লেখা, কুলাউড়া, নীলফামারী, লালমনিরহাট শক্রমুক্ত হয়।
এদিনও থেমে থাকেনি মিত্রবাহিনীর বিমান আক্রমণ। বঙ্গোপসাগরে ভারতের নৌবাহিনী সৃষ্টি করে নৌ-অবরোধ।