স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জনসভা যশোরে
একাত্তরের ডিসেম্বরে প্রায় ১৬ দিন ধরে চলা ভয়াবহ এক যুদ্ধের মাধ্যমে শত্রুমুক্ত হয়েছিল যশোর জেলা। মিত্রবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের অবিরাম প্রতিরোধের মুখে শেষ পর্যন্ত ৬ ডিসেম্বর রাতে যশোর ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে খুলনার দিকে পালিয়ে যায় হানাদাররা। দেশের প্রথম জেলা শহর হিসেবে হানাদারমুক্ত হয় যশোর।
মুক্ত যশোরে ঢল নামে মানুষের। একদিকে বিজয়ের আনন্দ, অন্যদিকে স্বজন হারানোর বেদনা। ৭ ডিসেম্বর সকালে যশোরে আসেন ৮ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক মেজর মঞ্জুর ও মিত্রবাহিনীর নবম ডিভিশনের কমান্ডার মেজর জেনারেল দলবর সিং।
ওই দিনই ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় থাকা প্রবাসী সরকার ওয়ালিউল ইসলামকে যশোরের জেলা প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেয়।
পরে আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ, নূরে আলম জিকু, শাহ হাদীউজ্জামান, অশোক রায় ও নবনিযুক্ত জেলা প্রশাসক যশোরের চৌগাছা উপজেলার মাসিলা সীমান্ত দিয়ে যশোর শহরে পৌঁছান। এরপর জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে একটি সমাবেশের আয়োজন করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধের যে কটি ঘটনা যশোরবাসীকে গর্বিত করে, তেমনই আরেকটি ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী ১১ ডিসেম্বর। এদিন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জনসভা অনুষ্ঠিত হয় যশোর শহরের টাউন হল ময়দানে। ওই জনসভায় প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ সর্বস্তরের মানুষকে স্বাধীনতাযুদ্ধের চেতনায় দেশ পুনর্গঠনে আত্মনিয়োগ করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আর ধ্বংস নয়, যুদ্ধ নয়। এ মুহূর্তে কাজ হলো যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে গড়ে তোলা।’
জনসভায় প্রধানমন্ত্রী যশোরের তৎকালীন জেলা প্রশাসক ওয়ালিউল ইসলাম এবং কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কাঞ্চন ঘোষালকে নির্দেশ দেন, আইনশৃঙ্খলার যেন অবনতি না ঘটে। একই সঙ্গে তিনি সবাইকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আপনারা আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না। অপরাধী যে-ই হোক, তাকে আইনের হাতে সোপর্দ করবেন।’
জনসভায় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, সংসদ সদস্য ফণীভূষণ মজুমদার, রওশন আলী, মোশাররফ হোসেন, তবিবর রহমান সরদার, এমআর আকতার মুকুল, লেখক ও চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান উপস্থিত ছিলেন। সমাবেশ শেষে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সফরসঙ্গীরা যশোর-বেনাপোল সড়ক ধরে কলকাতায় চলে যান।
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম এ জনসভার খবর সংগ্রহ করতে লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকার সাংবাদিক পিটার গিল, নিইউয়র্ক টাইমস পত্রিকার সিডনি এস এইচ সানবার্গ, বালটিমোর সান, ওয়াশিংটন পোস্টসহ বহু খ্যাতনামা পত্রিকার প্রতিনিধিরা এসেছিলেন। পরদিন ওই সব পত্রিকায় ফলাও করে ছাপা হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জনসভার খবর।