বিজয়ের এই দিনে
পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণ শুরু
একাত্তরের এই দিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণ শুরু হয়। বলা যেতে পারে, গত কয়েক দিন তাদের প্রতি প্রবাসী বাংলাদেশি ও ভারত সরকার আত্মসমর্পণের যে আহ্বান রেখে আসছিল, তারই বাস্তব রূপ শুরু হয়েছিল আজকের এই দিনে। তবে এর আগেও বিচ্ছিন্ন কয়েকটি স্থানে হানাদাররা আত্মসমর্পণ ও অস্ত্র সংবরণ করেছিল।
এদিনে কুমিল্লার ময়নামতিতে এক হাজার ১৩৪ জন ও সৈয়দপুরে ১০৭ পাকিস্তানি সেনা আত্মসমর্পণ করে।
একাত্তরের এই দিনে পাকিস্তানি হানাদারমুক্ত হয় মানিকগঞ্জ ও বগুড়ার কাহালু উপজেলা।
মানিকগঞ্জের বিভিন্ন যুদ্ধে ৫৪ মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং নয়জন পঙ্গুত্ববরণ করেন। এ অঞ্চলে মুক্তিসংগ্রামে অসামান্য অবদানের জন্য চারজনকে মুক্তিযোদ্ধা খেতাব করা হয়। তাঁদের মধ্যে বীর উত্তম খেতাব পান স্কোয়াড্রন লিডার (অব.) বদরুল আলম। বীর প্রতীক খেতাব পান শহীদ মাহফুজুর রহমান, আতাহার আলী ও ইব্রাহীম খান।
এদিকে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার অধ্যক্ষ হোসেন আলী সহযোগীদের নিয়ে কাহালু থানা চত্বরে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন এবং কাহালু উপজেলাকে হানাদার ঘোষণা করেন।
অধ্যক্ষ হোসেন আলী তাঁর বাহিনী নিয়ে এ অঞ্চলে যুদ্ধ করেছিলেন। তাঁদের আক্রমণে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় শতাধিক পাকিস্তানি সেনা, যাদের বগুড়ার গোকুল ক্যাম্পে ভারতীয় বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল। খুলনা, বগুড়া ও চট্টগ্রামে হানাদারদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের তুমুল যুদ্ধ চলে।
এদিন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের স্টুডিওতে বসে বার্তা বিভাগীয় প্রধান কামাল লোহানী, আলী যাকের ও আলমগীর কবির ঘন ঘন সংবাদ বুলেটিন প্রচার করেন। সংবাদ বুলেটিনে দেশের বিভিন্ন জেলা শত্রুমুক্ত হওয়ার খবর আসতে থাকে।
এদিন লে. কর্নেল সফি উল্লাহর ‘এস’ ফোর্স ঢাকার উপকণ্ঠে ডেমরা পৌঁছায়। অন্যদিকে ঢাকায় বাড়তে থাকে পাকিস্তানি সেনাদের উপস্থিতি। কারণ, সমুদ্রপথে তাদের পালোনোর পথ মোটামুটি দুই-তিন দিন আগ থেকেই বন্ধ হয়ে যায়। ফলে তারা যতটা সম্ভব স্থলপথেই ঢাকায় আসার চেষ্টা চালায়।
অন্যদিকে পূর্ব ও উত্তর দিক থেকে ঢাকার প্রায় ১৫ মাইলের মধ্যে পৌঁছে যায় মিত্রবাহিনী। পূর্ব দিক থেকে এগিয়ে আসে ৫৭ নম্বর ডিভিশনের দুটি ব্রিগেড। উত্তর দিক থেকে আসে জেনারেল গন্ধর্ব নাগরার ব্রিগেড। আজও টাঙ্গাইলে অবতরণ করে ছত্রীসেনারা। পশ্চিমে ৪ নম্বর ডিভিশনও মধুমতী পার হয়ে পৌঁছে যায় পদ্মার তীরে। রাত ৯টা নাগাদ মেজর জেনারেল নাগরা টাঙ্গাইল আসেন। এর আগে সন্ধ্যা থেকেই টাঙ্গাইলে অবস্থান করেছিলেন ব্রিগেডিয়ার ক্লের ও ব্রিগেডিয়ার সান সিং। রাত সাড়ে ৯টায় তাঁরা ওয়াপদা রেস্টহাউসে যুদ্ধ পরিকল্পনায় বসেন।
এ সময় মেজর জেনারেল নাগরা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশংসা করে বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধারা যদি আমাদের সাহায্য না করতেন, তাহলে আমাদের বাহিনী যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ত। রাস্তাতেই আমাদের অনেক শক্তি ক্ষয় হয়ে যেত।’
এদিকে যুদ্ধ জয়ের নিশ্চয়তা জেনেই বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এক বিবৃতিতে বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে জাতিসংঘের যেসব কর্মী, কূটনৈতিক, প্রতিনিধি ও বিদেশি নাগরিক নিরাপদে সরে আসতে চান, বাংলাদেশ সরকার তাদের সম্ভাব্য সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেবে।’
অন্যদিকে মুজিবনগরে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার এক জরুরি বৈঠক বসে। বৈঠকে শত্রুমুক্ত জেলাগুলোতে দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রশাসন চালু করাসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এদিকে সব দিক থেকে অবরুদ্ধ হয়ে ‘আরো সাহায্যে’র জন্য রাওয়ালপিন্ডিতে আরজি পাঠায় জেনারেল নিয়াজি।
পাকিস্তানের সিংহভাগ ভরসা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ওপর। তারা বারবার যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ কামনা করে আসছিল। কিন্তু এদিনে নিয়াজিকে জানানো হয়, ওই দিন পাকিস্তানি বাহিনীর সহায়তার জন্য ‘মিত্রদের’ যে সহায়তা এসে পৌঁছানোর কথা ছিল, তা ৪৮ ঘণ্টার জন্য পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। পাকিস্তানের ঊর্ধ্বতন নেতৃত্ব চীনকে সামরিক হস্তক্ষেপের ব্যাপারে রাজি করানোর কাজে ইসলামাবাদে সারা দিন ধরে তদবির চালিয়ে যায়। পিকিংয়ে পাকিস্তানি দূতাবাসও একই কাজ করে। এদিন সিকিম-ভুটান সীমান্তে অবস্থানরত চীনা সেনাবাহিনীকে কিছুটা তৎপর হতে দেখা যায়।
এদিনে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের মুলতবি বৈঠকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব তৃতীয়বারের মতো সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেটোর মাধ্যমে বাতিল হয়ে যায়। চব্বিশ ঘণ্টা নিশ্চল রাখার পর সপ্তম নৌবহরকে পুনরায় সচল করা হয় বঙ্গোপসাগরের দিকে, যা মাত্র ২৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করেছিল।
তবে থেমে থাকেনি হানাদার ও তাদের দোসরদের গুপ্ত হত্যাকাণ্ড। আজকের এই দিনে তারা সাংবাদিক সেলিনা পারভীনকে তাঁর সিদ্ধেশ্বরীর বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়, যার ক্ষত-বিক্ষত লাশ ১৮ ডিসেম্বর রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে পাওয়া যায়।