বিজয়ের এই দিনে
দেশকে মেধাশূন্য করার নীলনকশা
একাত্তরের এই দিনটিও ছিল যুদ্ধকালীন অন্যান্য দিনের মতোই একটি দিন। ডিসেম্বরের অন্যান্য দিনের মতো এই দিনটিতেও পাকিস্তানি বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত হতে থাকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল। তাদের প্রতিহত করতে গিয়ে না ফেরার দেশে যেতে হয়েছে অনেক মুক্তিপাগল বাঙালিকে। হানাদারও নিহত হয়েছে যৌথ বাহিনীর হাতে। তবে এদিনটার একটা স্বতন্ত্র রক্তচিহ্নময় ইতিহাস রয়েছে। এ ইতিহাস অনেক বেদনার।
আনুষ্ঠানিকভাবে সোনার বাংলা বিশ্ব মানচিত্রে জন্ম নেওয়ার আর মাত্র দুটি প্রহর বাকি। তৃতীয় প্রহরেই জন্ম স্বাধীন সোনার বাংলার।
কিন্তু এ সুখকে বাঙালি জাতি তেমনভাবে আলিঙ্গন করতে পারেনি। মাত্র দুদিন আগে একাত্তরের এই দিনে (১৪ ডিসেম্বর) হানাদার বাহিনী সর্বশেষ মরণ কামড় বসায়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল জাতিকে মেধাশূন্য করা। তাদের এ ঘৃণ্য ফন্দিতে তারা কিন্তু সফল।
স্বাধীনতার পরপর জাতি প্রতিটি পদে পদে এ সূর্যসন্তানদের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে।
একটি চিরন্তন কথা হলো ‘দেশ গঠনের আগে প্রয়োজন জাতি গঠন।’
সেদিক থেকে বাঙালি জাতির দেশ গঠনে কোনো অপূর্ণতা ছিল না। বাংলাদেশ গঠন না হওয়ারও বহু পূর্বে জাতি হিসেবে ‘বাঙালি’ নিজেদের ঐক্য বিশ্ববাসীকে দেখাতে পেরেছিল।
প্রাক ঔপনিবেশিক আমলের বহুকাল আগের বিভিন্ন সাহিত্য বা ইতিহাসকর্মে এর জ্বলন্ত প্রমাণ পাওয়া যায়। অবশ্য সাতচল্লিশে ভারত বিভাগের মাধ্যমে বাঙালি জাতিকে দুটি ভৌগোলিক পরিচয়ে আবদ্ধ করে। তবে আজ অবধি সব বাঙালিই নিজেদের বাঙালি বলতে গর্ববোধ করেন।
সদ্য স্বাধীন হওয়া কোনো দেশের মেরুদণ্ড শক্ত করে গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন প্রতিটি ক্ষেত্রে মেধাবী লোকদের নেতৃত্ব। যা আমাদের পরিসরে কম ছিল না। কিন্তু বুদ্ধিজীবীদের হারানোর মধ্য দিয়ে আমাদের মেরুদণ্ডে আজও পচন রোধ করা সম্ভব হয়নি।
একের পর এক জাতীয় হত্যাকাণ্ড, স্বৈরশাসন আর গণতন্ত্রের মোড়কে অগণতান্ত্রিক শাসন আজ দেশটির নিত্যসঙ্গী।
তরুণ প্রজন্ম ইতিহাস অধ্যয়নের মধ্য দিয়ে ১৪ ডিসেম্বরের সেই নারকীয় হত্যাকাণ্ড আজও অশ্রু বিসর্জনের মধ্য দিয়ে স্মরণ করছে।
বিভিন্ন তথ্যসূত্র থেকে এক হাজার ৭০ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর তালিকা পাওয়া যায়। শহীদদের এ কাতারে আছেন কবি-সাহিত্যিক, লেখক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সাংবাদিক, গবেষক ও শিক্ষাবিদরা। যাদেরকে নৃশংসভাবে হত্যা করে হানাদার ও তাদের দোসররা। তাঁদের তুলে নেওয়া হয় ঘর বা দপ্তর থেকে।
তাঁদের অনেকের ক্ষতবিক্ষত লাশ ১৬ ডিসেম্বরের পর বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে মিরপুর ও রায়েরবাজার বধ্যভূমির কথা উল্লেখযোগ্য। অনেকেরই সন্ধান আজও মেলেনি।
বিভিন্ন তথ্যসূত্র থেকে প্রাপ্ত কয়েকজন শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম উল্লেখ করা হলো। এঁদের মধ্যে রয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, আনোয়ার পাশা (বাংলা সাহিত্য), গোবিন্দ চন্দ্র দেব (দর্শনশাস্ত্র), আবুল খায়ের (ইতিহাস), জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, হুমায়ূন কবীর, রাশিদুল হাসান (ইংরেজি সাহিত্য), সিরাজুল হক খান (শিক্ষা), এ এন এম ফাইজুল মাহী (শিক্ষা), সাজিদুল হাসান (পদার্থবিদ্যা), ফজলুর রহমান খান (মৃত্তিকা বিজ্ঞান), এন এম মনিরুজ্জামান (পরিসংখ্যান), এ মুকতাদির (ভূ-বিদ্যা), শরাফত আলী (গণিত), এ আর কে খাদেম (পদার্থবিদ্যা), অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য (ফলিত পদার্থবিদ্যা), এম এ সাদেক, এম সাদত আলী (শিক্ষা), সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য, গিয়াসউদ্দিন আহমদ (ইতিহাস), এম মর্তুজা (চিকিৎসক)।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছেন হবিবুর রহমান (গণিত বিভাগ), শ্রী সুখারঞ্জন সমাদ্দার (সংস্কৃত) ও মীর আবদুল কাইউম (মনোবিজ্ঞান)।
চিকিৎসকদের মধ্যে রয়েছেন অধ্যাপক মোহাম্মদ ফজলে রাব্বি, অধ্যাপক আলিম চৌধুরী, অধ্যাপক শামসুদ্দীন আহমেদ, অধ্যাপক আবদুল আলিম চৌধুরী, হুমায়ুন কবীর, আজহারুল হক, সোলায়মান খান, আয়েশা বদেরা চৌধুরী, কসির উদ্দিন তালুকদার, মনসুর আলী, মোহাম্মদ মোর্তজা, মফিজউদ্দীন খান, জাহাঙ্গীর, নুরুল ইমাম, এস কে লালা, হেমচন্দ্র বসাক, ওবায়দুল হক, আসাদুল হক, মোসাব্বের আহমেদ, আজহারুল হক ও মোহাম্মদ শফী।
সাংবাদিকদের মধ্যে রয়েছেন শহীদুল্লাহ কায়সার, নিজামুদ্দীন আহমেদ, সেলিনা পারভীন, সিরাজুদ্দীন হোসেন ও আ ন ম গোলাম মুস্তফা।
অন্যদের মধ্যে আছেন আলতাফ মাহমুদ (গীতিকার ও সুরকার), ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত (রাজনীতিবিদ), রণদাপ্রসাদ সাহা (সমাজসেবক ও দানবীর), যোগেশ চন্দ্র ঘোষ (শিক্ষাবিদ, আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক), জহির রায়হান (লেখক, চলচ্চিত্রকার), মেহেরুন্নেসা (কবি), ড. আবুল কালাম আজাদ (শিক্ষাবিদ, গণিতজ্ঞ) ও নজমুল হক সরকার (আইনজীবী)।
তবে এখানে যেসব শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম উল্লেখ করা হলো তাঁদের সবাই ১৪ ডিসেম্বর শহীদ হননি। এঁদের অনেকেই এর আগে ও পরে একই ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন। তবে ১৪ ডিসেম্বরের আগে যাঁরা শহীদ হয়েছেন, তাঁদের সবাই যে হানাদার ও তাদের দোসরদের হাতে নির্মমতার শিকার তা অকপটে বলায় যায়। তবে ১৪ ডিসেম্বরের পর যাঁরা ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন, তাঁদের বিষয় নিয়ে অকপটে কিছু বলা যাচ্ছে না। যেমন- জহির রায়হানের নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারে অনেক বিতর্ক আছে। যিনি ছিলেন বেসরকারিভাবে গঠিত ‘বুদ্ধিজীবী নিধন তদন্ত কমিশনের’ আহ্বায়ক।
মুক্তিযুদ্ধের এই দিনে শত্রুমুক্ত হয় সাভার, দিনাজপুর, বগুড়ার শিবগঞ্জ, জয়পুরহাটের পাঁচবিবিসহ চট্টগ্রামের বান্দরবান।
যৌথ বাহিনীর আক্রমণের মুখে হানাদাররা দিনাজপুর থেকে সৈয়দপুরে পালিয়ে যায়।
রাজধানীর চারদিকে চলতে থাকে বিজয়ের সর্বশেষ হামলা। ১৩ ডিসেম্বর রাত থেকে ১৪ ডিসেম্বর ভোর পর্যন্ত পূর্ব ও পশ্চিম দিক থেকে মিত্রবাহিনীর কামান অবিরত গোলা ছুড়তে থাকে। এতে নিয়াজিদের হৃদকম্পন আরো তুঙ্গে ওঠে।
মিত্রবাহিনীর কামানের গোলা গিয়ে পড়ে ক্যান্টনমেন্টেও। অবশ্য এটাই ছিল মিত্রবাহিনীর প্রধান টার্গেট। ক্যান্টনমেন্টে ছোড়া গোলাতে পুরো ঢাকা কেঁপে ওঠে।
ফলে রাও ফরমান আলী এবং চিফ সেক্রেটারি মুজাফ্ফর হোসেনের ইশারায় গভর্নর মালিক সকালেই ‘সমগ্র পরিস্থিতি’ বিবেচনার জন্য গভর্নর হাউসে মন্ত্রিসভার জরুরি বৈঠক ডাকেন।
কিন্তু বৈঠক চলাকালেই শিলং বিমানঘাঁটি থেকে অর্ধডজন মিগ-২১ গভর্নর ভবনের ওপর রকেট আক্রমণ চালায়।
ভয়ে দিগ্বিদিক ছুটতে থাকেন মালিক ও তাঁর মন্ত্রীরা।
বিমান হানা শেষে মালিক তাঁর মিত্রদের সঙ্গে আবার বৈঠকে বসেন এবং পাঁচ মিনিটের মধ্যে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। পদত্যাগের সিদ্ধান্ত ঢাকার আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটির প্রতিনিধি রেনডকে জানিয়ে ‘হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে’ আশ্রয় নেন।
এদিকে নিয়াজিও গোপনে গোপনে জেনারেল মানেকশর কাছে আত্মসমর্পণের কথা জানাতে থাকেন। তবে শর্ত একটাই, নিরাপদ আত্মসমর্পণ চায় পাকিস্তানি পক্ষ।