স্মরণ
হেমাঙ্গ বিশ্বাস, হালুয়াচাষাদের তত্ত্বকার
১.
বাংলাদেশে উঁচু ও লম্বা টানের গানগুলো কেন হিট হয়? এক অঞ্চলের বিশিষ্ট লোক সঙ্গীতশিল্পী অন্য অঞ্চলের গান গাইতে গেলেই কেন ধরা খান? যেমনটি কবি জসিম উদ্দীন ভাওয়াইয়া জাদুকর আব্বাসউদ্দীন সম্পর্কে হেমাঙ্গ বিশ্বাসকে বলেছিলেন, ‘অনেক চেষ্টা করে দেখেছি কিন্তু ভাটিয়ালির বিশেষ খোঁচ ও ভাঁজগুলো আব্বাসের গলায় ওঠে না।’ তার মানে আঞ্চলিক সহজাত গায়কীর সাথে সেই অঞ্চলের একটা প্রাকৃতিক সম্পর্ক রয়েছে, যা শিশুর মাতৃভাষা শেখার মতোই ব্যাকরণহীন। চারপাশের উৎপাদন-সম্পর্ক, মাটি, জল, রোদ, বৃষ্টি, খোলাপ্রান্তর, পাহাড়-পর্বত সবকিছু মিলেই হলো লোকসঙ্গীতের শিক্ষালয়।
মুক্ত আকাশের নিচে খোলা প্রান্তরে গলা টানলে তার যে রূপ, পাহাড় বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে গলা টানলে তা হবে আরেক রকম। কিংবা নৌকা উজানের দিকে টানতে টানতে সুর ধরলে যা হবে সারি গান, ভাটির দিক পাল ও হাল ছেড়ে তা হবে ভাটিয়ালি। বিশেষ বিশেষ অঞ্চলের স্বর প্রক্ষেপে এমন এক প্রকারের 'গলাভাঙা' 'গলার খোঁচ' বা স্থানিক অলংকার থাকে যা শহুরে ওস্তাদ হাজার রেওয়াজ করেও আয়ত্ব করতে পারে না। -এভাবেই এক অঞ্চলের অনন্য লোকশিল্পী অন্য অঞ্চলের বিশেষ লৌকিক অলংকারটি ধরতে পারেন না। তার মানে আঞ্চলিক সহজাত গায়কীর সাথে সেই অঞ্চলের একটা প্রাকৃতিক সম্পর্ক রয়েছে, যা শিশুর মাতৃভাষা শেখার মতোই ব্যাকরণহীন।
হেমাঙ্গ বিশ্বাস বলতেন, “লতা মুঙ্গেশকরের গাওয়া 'ফান্দে পড়িয়া বগা' গানের রেকর্ডটি এবং আব্বাসউদ্দীনের সেই গানের রেকর্ডটি পর পর বাজিয়ে দেখলেই কথাটা উপলব্ধি বাংলাদেশে উঁচু ও লম্বা টানের গানগুলো কেন হিট হয়? এক অঞ্চলের বিশিষ্ট লোকসঙ্গীতশিল্পী অন্য অঞ্চলের গান গাইতে গেলেই কেন ধরা খান? যেমনটি কবি জসিম উদ্দীন ভাওয়াইয়া জাদুকর আব্বাসউদ্দীন সম্পর্কে হেমাঙ্গ বিশ্বাসকে বলেছিলেন, ‘অনেক চেষ্টা করে দেখেছি কিন্তু ভাটিয়ালির বিশেষ খোঁচ ও ভাঁজগুলো আব্বাসের গলায় ওঠে না।’ তিনি বিস্তারিত করে বলেছেন, “লোকসংগীত গুরু মুখী নয় গণমুখী। লোকসংগীতের কোনো 'ঘরানা' নেই, আছে 'বাহিরানা'। এই আঞ্চলিকতাকেই আমি 'বাহিরানা' বলছি। কোনো অঞ্চলের গান গাইতে গেলে সেই অঞ্চলের জীবনের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য প্রয়োজন। প্রত্যেক সার্থক লোকসংগীতশিল্পীর গান গাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মনে ভেসে ওঠে একটা visual image বা চাক্ষুসচিত্র, কিন্তু ভাটিয়ালি বা ভাওয়াইয়া সুরের সত্যিকারের শিল্পী যখন সুরে টান দেন তখন তাঁর মানসচক্ষে যে জনপদের, যে প্রকৃতি ও প্রান্তরের ছবি ভেসে ওঠে তা সুস্পষ্ট বা তার communication বা ভাবানুষঙ্গটিও সর্বজনীন।”
আমাদের বেশির ভাগ লোকগীতিই প্রাণস্ফূর্তিতে ভড়া, গাওয়ার ঢং উচ্চগ্রামে। নিচু গ্রামে তা লাশে পরিণত হয়। শহুরে সাধা গলায় লোকগীতি গাওয়ার তাগদ প্রায়ই থাকে না। কিন্তু টিভি চ্যানেলগুলোর বরাতে বা দৌরাত্ম্যে শহুরে গলাগুলোই কেউ মধ্যবঙ্গের বাউল সম্রাজ্ঞী কেউ ভাওয়াইয়া রাজা, কেউ কেউ মহানগর ঢাকাতেই খুলে বসেছেন লোকসঙ্গীতের স্কুল।
২.
সঙ্গীতের তত্ত্বকারগণ সঙ্গীতের সংজ্ঞায় গীতবাদ্য ও নৃত্যকে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। লোকসঙ্গীতে গীতবাদ্য ও নৃত্য আজো অটুট, আজও অভিন্ন। খাঁটি লোকসঙ্গীতশিল্পী আড়ষ্ট হয়ে বসে কখনো গান গাইতে পারেন না। সমবেত গোষ্ঠী জীবনের শ্রমের ছন্দের সঙ্গে যখন গীতের উৎপত্তি, সেই সময় থেকে শরীর সঞ্চালন মিশে আছে। আদিবাসী বিভিন্ন জাতি, উপজাতির মধ্যে গান ও নাচ এখনো মিশে আছে। তাঁরা নাচের সময় না গেয়ে পারেন না, আবার গাওয়ার সময় না নেচে পারেন না, এটা একটা স্বতঃস্ফূর্ত ঘটনা। আমাদের লোকসঙ্গীতের কথিত নবাবজাদা যেখানে বসে লোকসঙ্গীত গান, সেখানে প্রকৃত লোকশিল্পীরা তা পারেন না। তাঁরা নেচে নেচে গান গান। আর এই নেচে নেচে গাওয়ার মধ্যে যে প্রাণবন্ত ব্যাপারটি আছে, তা কি হারমোনিয়াম ও তবলা ধারণ করতে পারে? না পারে না বলেই লোকসঙ্গীতে হারমোনিয়াম ও তবলা অচল। একটা ডপকী বা খঞ্জনিতে যে অপরূপ ছন্দ তোলা যায়, দোতারায় যে প্রাণ খোলা পরিবেশ সৃষ্টি হয় সেখানে হারমোনিয়াম ও তবলা সেই আবহটিকে রীতিমতো হত্যা করে। অর্থাৎ লৌকিক বাদ্যযন্ত্র ছাড়া লোকসঙ্গীত গাওয়ার কথা কল্পনা করা যায় না। সুরা জগতে পাঞ্চিংয়ের মতো বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে সুরেরও পাঞ্চিং চলে। পাঞ্চিং হচ্ছে এক যন্ত্র দিয়ে আরেক যন্ত্রের এফেক্ট আনা বা প্রক্সি দেওয়া। দোতারার প্রক্সি দিচ্ছে মেণ্ডোলিন কিংবা সরোদ, বাঁশের বাঁশির প্রক্সি দিচ্ছে সানাই আর ঢোলের কাজ সারছে ডুগি ও তবলায়।
লোকসঙ্গীতের তত্ত্বকার হেমাঙ্গ বিশ্বাস বলেছেন, “প্রত্যেক দেশে এবং অঞ্চলে তার নিজস্ব বাদ্যযন্ত্র নানা রকমের আছে। এগুলোর বিবর্তন আমাদের সংগীতের ইতিহাসে এক বিস্ময়কর অধ্যায়। এ শুধু গানে 'একম্পেনিমেন্ট' ভাবা ঠিক নয়। এক একটি যন্ত্র এক এক প্রকারের মুড বা মেজাজ সৃষ্টি করে। পূর্ববঙ্গের 'লাউয়া' বা একতারা যন্ত্রের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের একতারা যন্ত্রের পার্থক্য আছে। পূর্ববঙ্গের দোতারার সঙ্গে উত্তরবঙ্গের দোতারার পার্থক্যও লক্ষণীয়। এ সবই বিশেষ সুরের প্রকৃতির সাথে সম্বন্ধযুক্ত।”
তেমনি কুষ্টিয়ার বাউল গানের বাদ্যযন্ত্র হচ্ছে ডুগি ও খমক, যা ঢাকার নরসিংদীর বাউলরা ব্যবহার করেন সারিন্দা, যার ফলে এই ছড় টানা তারের যন্ত্রের টানে টানে পশ্চিমবঙ্গের বাউল সম্প্রদায়ের নাচের ছন্দ একেবারেই হারিয়ে যায়। কিন্তু স্বরলিপির বইপড়া বিভিন্ন চ্যানেলের ঘুঘু স্টার শিল্পীরা লোকসঙ্গীতের এই অপার স্বাধীনতার স্বাদ ক্যামনে জানবেন। চারদিকে লোকসঙ্গীতের বানে ভেসে যাচ্ছে কিন্তু পিয়াসার পানি নাই। -রে নিঠুর শ্যাম/ ফাঁকি দিয়ে আনিলি আসাম।
পথে-ঘাটে, আইলে-ক্ষেতে অনেক বড় বড় শিল্পী লোকসঙ্গীতকে এখনো বাঁচিয়ে রেখেছেন, কিন্তু হেমাঙ্গ বিশ্বাস সেই গানের গীতের সূত্রায়ণ করেছেন।
তিনি ১৯১২ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন।
আজ করপোরেট পুঁজির বিরুদ্ধে জনগণকে দাঁড়াতে হলে হেমাঙ্গ বিশ্বাস বিনে গতি নেই।
লেখক : প্রধান সমন্বয়ক, রেল-নৌ যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটি।