বিজয় গাঁথা
একজন লালু এবং একটি ভুলু জাতি
১.
মহান মুক্তিযুদ্ধের একজন বীরপ্রতীক বসবাস করতেন মিরপুর মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সে ময়লার ঢিবির ওপর টাঙানো চালার ভেতরে। হোটেলে থালাবাসন ধোয়ার কাজ করতেন তিনি, কখনো বা কুলির কাজ। আশা ছিল, সন্তানদের সামান্য পড়ালেখা শেখাবেন, এতে যদি ভাগ্য ফেরে। কিন্তু স্কুলে বেতন দিতে না পারায় কর্তৃপক্ষ ছেলের নাম কেটে দিয়ে স্কুল থেকে বের করে দেয়। শেষ জীবনে দুটো কিডনিই বিকল হয়ে যায় তাঁর। এভাবে হাসপাতালের বারান্দায় ধুঁকে ধুঁকে প্রায় বিনা চিকিৎসায় মারা যান তিনি।
এ কাহিনী আপনার কাছে অবিশ্বাস্য লাগছে না? আমারও প্রথম শুনে অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিল। আরো আশ্চর্য লেগেছিল যখন শুনলাম, এই বীর তার বীরপ্রতীক খেতাব পাওয়ার কথা জানতে পেরেছিলেন ৩০ বছর পর! যখন তাঁর শরীরে দুরারোগ্য ব্যাধি বাসা বেঁধেছে। তাঁর এই রোগ পাকিস্তানি বাহিনীর চেয়েও ভয়ানক। তখন আক্ষেপ করে এই বীর বলেছিলেন, ‘আমার থিকা অল্প বয়সী লোকজন মুক্তিযোদ্ধা ভাতা তুলে। আমি ১২ বছর বয়সে যুদ্ধ করছি, তারা তাহলে কত বছর বয়সে যুদ্ধ করছে? মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় কত ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা ঢুইকা গেছে, তারা ভাতাও তোলে। আর আমার পোলাপাইন না খাইয়া থাকে। কী করুম, আমি মূর্খ মানুষ। ছোটো লোকের পোলা।’
অভিমানী, বঞ্চিত এই বীরের নাম নাম শহীদুল ইসলাম। ক্যাম্পের সবাই আদর করে যাকে ডাকত লালু বলে। এই লালু আমাদের লালু। এই লালু বাংলাদেশের লালু। এই লালু লাল-সবুজের লালু। এই লালু টাঙ্গাইলের গোপালপুরের লালু। এই লালু মহান মুক্তিযুদ্ধের সর্বকনিষ্ঠ বীর যোদ্ধা।
লালুর জীবন সাঙ্গ হয়েছে ২০০৯ সালের মে মাসের ২৫ তারিখেই। আর তাই তিনি আর আমাদের মুক্ত দেশে, স্বাধীন নাগরিকদের চলার পথের বাধা হতে আসবেন না। চিকিৎসার জন্য কারো কাছে হাত পাতবেন না। জানি, লালুকে এই জাতি মনে রাখবে না, ভুলে যাবে। প্রয়োজন পড়বে না তাদের।
তারপরও বলতে চাই লালুর বীরত্বের কথা। ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর গোপালপুরকে হানাদার মুক্ত করতে লালুর অবদান ভোলার মতো নয়। চলুন জানি কী করেছিলেন বীরপ্রতীক লালু ওই সময়ে।
২.
ছেলেটি ছিল হ্যাংলা পাতলা, দুরন্ত। হবে না কেন? মাত্র কৈশোরে পড়েছে ছেলেটি। দেশেরও তখন দূরন্ত সময় চলছে। গাঁয়ের মেঠোপথ, ঝোপঝাড়, বাঁশবাগানে, পুকুরে সাঁতার কাটা এবং কিশোর বন্ধুদের নিয়ে নদী-খাল-পুকুরে হৈ-হুল্লোড় করে কৈশোরের দিনগুলো তার কাটছিল বেশ। বাবা মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন আর মা আমিনা বেগমের তিন ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে সবার ছোট ছিলেন তিনি। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন দুঃসাহসী আর ডানপিটে। সেই ১২ বছর বয়সেই ঘটিয়ে ফেলেন ঘটনাটি। কারো কারো সাহস থাকে, কারো বা থাকে দুঃসাহস। তার ছিল দ্বিতীয়টি। ছেলেটি আর কেউ নন, তিনি শহীদুল ইসলাম লালু।
একদিন সেই কিশোর দেখলেন পাকিস্তানি বাহিনীর তাণ্ডবে সাধারণ মানুষগুলো ভয়ে গ্রাম ছেড়ে পালাচ্ছে। সূতীপলাশ গ্রামের অদূরে গোপালপুর থানার আশপাশে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। পাকিস্তানি সৈন্যরা বাঙালিদের মারছে। লালু পালালেন তবে, পেছনের মানুষের আহাজারি ভুললেন না। তাই ফিরে গেলেন কেরামজানী আর ঝাওয়াইল স্কুল মাঠে। সেখানেই মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী দলবল নিয়ে পাকিস্তানি সেনা প্রতিরোধের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। লালু এক বুক সাহস নিয়ে তাঁদের কাছে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করার বায়না ধরলেন। লালুর সাহস ও বায়না দেখে তারা প্রথমে হেসে ফেললেন। কিন্তু লালু নাছোড়বান্দা। যুদ্ধে তিনি যাবেনই। এক সময় ফুট-ফরমাশ খাটানোর লক্ষ্যে তাকে দলে ভর্তি করিয়ে নেওয়া হলো।
লালুকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল পাকিস্তানি বাহিনীর শক্ত ঘাঁটি গোপালপুর থানায় হানাদারদের বাংকার গ্রেনেড মেরে উড়িয়ে দেওয়ার। বয়সে ছোট বলে সবার অগোচরে এ কাজ সহজে করা যাবে এবং ক্যাম্পের ভেতরে সহজে ঢুকতে পারবে। নির্ধারিত দিনে লালু হাফপ্যান্ট পরে বিকেলে তিনটি গ্রেনেড নিয়ে গোপালপুর থানার উদ্দেশে রওনা হন। থানার কাছে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে।
গ্রেনেড তিনটি থানার পেছনের পুকুরপাড়ে রেখে ক্যাম্পে প্রবেশ করেন। এরপর সুযোগ খুঁজতে থাকেন কখন ওই গ্রেনেডের বিস্ফোরণ ঘটাবেন। থানায় চা-পানি খাওয়ানোর ফাঁকে ফাঁকে চারদিকে কে কোথায় আছে দেখে নেন। তিনি তিনটি বাংকার টার্গেট করে নেন, যা সহজেই গ্রেনেডে উড়িয়ে দেওয়া সম্ভব। তাতে কজন পাকিস্তানি সেনা ঘায়েল হবেন তার হিসাবও কষে নেন। একেক বাংকারে পাঁচজন, চারজন ও তিনজন করে পাকিস্তানি সেনা রয়েছে। তারা ভারি অস্ত্র নিয়ে বাংকারগুলোতে পজিশন নিয়ে আছে। লালু বয়সে ছোট হওয়ার কারণে সবার সন্দেহের বাইরে থেকে তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে সক্ষম হন। লুকিয়ে রাখা গ্রেনেডগুলো আনতে গিয়ে কিছুটা বিপদের সম্মুখীনও হন। তিনি দেখেন গ্রেনেডের ওপর শুয়ে আছে মস্ত বড় একটি সাপ। সাপ চলে যাওয়ার পর গ্রেনেডগুলোর সেফটিপিন খুলে দ্রুত প্রত্যেক বাংকারে ছুড়ে মারতে থাকেন। পাকিস্তানি সেনারা কল্পনাও করতে পারেনি এমন একজন খুদে যোদ্ধার দ্বারা আক্রান্ত হবে। প্রচণ্ড শব্দে তখন বিস্ফোরিত হয় গ্রেনেডগুলো। এতে তিনটি বাংকারের সবাই মারা যায়। আর তখনই মুক্তিযোদ্ধারা গোপালপুর থানা সহজেই দখলে নেয়। লালু যে ফিরে আসতে পারবেন, সে ধারণা খোদ কমান্ডারদেরও ছিল না।
লালু গোপালপুর ছাড়াও ভূঞাপুর, মধুপুর ও নাগরপুরের কয়েকটি রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেন।
১৬ ডিসেম্বর দেশ শত্রুমুক্ত হলে ২৪ জানুয়ারি টাঙ্গাইলের বিন্দুবাসিনী স্কুলে আব্দুল কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে তাঁর বাহিনীর সদস্যরা অস্ত্র জমা দেন। লালুও সেদিন অন্যদের সাথে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে জমা দেন অস্ত্র। রাষ্ট্রপতি খুদে এই মুক্তিযোদ্ধাকে দেখে অবাক হয়ে কোলে তুলে নেন এবং বলেন, ‘সাব্বাস বাংলার দামাল ছেলে।’ যখন সহযোদ্ধাদের কাছ থেকে লালুর বাংকার ধ্বংসের কথা শুনলেন তখন বঙ্গবন্ধু তাকে ‘বীর বিচ্ছু’ নামে আখ্যা দেন।
তখন সেই ছবি দিয়ে একটি পোস্টারও ছাপা হয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধে জয়লাভ করলেও জীবনযুদ্ধে লালু ছিলেন পরাজিত। অভাব ও দারিদ্র্য ছিল নিত্যসঙ্গী। একদিন প্রাণের কঠিন বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে ছুটে আসেন ঢাকায়। ঢাকায় এসে ঠেলাগাড়ি ঠেলা, রাজমিস্ত্রী ও সোয়ারীঘাটের কুলিগিরি সব করেছেন। হোটেলে বাবুর্চির সহকারী হিসেবেও কাজ করেন।
এরই মধ্যে সময় গড়িয়ে যায়, চলে আসে ১৯৯৬ সাল। মুক্তিযুদ্ধের কাগজপত্র খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল বাংলাদেশ সরকারের ১৯৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর প্রকাশিত গেজেটে খেতাবপ্রাপ্ত বীরমুক্তি সেনাদের তালিকায় তাঁর নাম রয়েছে। লালুর নাম রয়েছে ৪২৬ জন বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্তদের মধ্যে। তাঁর নম্বর ৪২৫।
তাঁর নাম ছাপা হয়েছে ‘শহীদ ইসলাম, প্রযত্নে আব্দুল কাদের সিদ্দিক, টাঙ্গাইল।’ খবর পড়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লালুকে দপ্তরে ডেকে পাঠান এবং তাকে সম্মানিত করেন, ওই পর্যন্তই। এরপর আর বাংলা মায়ের বীর এই সন্তানের খোঁজ নেয়নি কেউ।
লালুদের ঠাঁই হয় আস্তাকুড়ে। সেখানেই একদিন তাঁরা ধুঁকে ধুঁকে মরে যান। যে পতাকার জন্য জীবনবাজি, মরণের পর সেটাই হয় তার কফিনের মোড়ক। এই বাংলাদেশে একজন মুক্তিযোদ্ধার এটাই রাষ্ট্রীয় সম্মান বৈকি। যদিও সেটি কালেভদ্রে জোটে মরণের পরে।
লেখক : বার্তা সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।