বিজয়ের এই দিনে
অর্জিত হলো স্বাধীনতা
একাত্তর সালের ১৬ ডিসেম্বর, বিকেল সাড়ে ৪টা। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যৌথ বাহিনীর সামনে আত্মসমর্পণের জন্য প্রস্তুত ৯১ হাজার ৬৩৪ জন পাক বাহিনী (সংখ্যা নিয়ে সামান্য মতপার্থক্য রয়েছে)। অন্যদিকে আনন্দে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল লাখ লাখ মুক্তিপাগল মানুষের চোখ দিয়ে। যৌথ বাহিনীর প্রধান জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করেন পাকিস্তানি জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজি। এ সময় মুক্তিবাহিনীর পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন মুক্তিবাহিনীর উপ-সর্বাধিনায়ক ও ডেপুটি চিফ অব স্টাফ গ্রুপ ক্যাপ্টেন আবদুল করিম (এ কে) খন্দকার। ঐতিহাসিক এই দলিলটি তৈরি করেছিলেন ভারতীয় মেজর জেনারেল জ্যাকব। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এটাই ছিল সবচেয়ে বড় আত্মসমর্পণের ঘটনা।
১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারি এক সরকারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে এই দিনটি পায় জাতীয় দিবসের মর্যাদা। এ দিন ভোরে জাতীয় প্যারেড ময়দানে তিন বাহিনীর কুচকাওয়াজে অংশ নিয়ে থাকেন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী। তোপধ্বনির পাশাপাশি তাঁরা সালাম গ্রহণ করে থাকেন। সাভারের নবীনগরে অবস্থিত জাতীয় স্মৃতিসৌধে দেশের বীরসন্তানদের স্মরণ করেন সর্বস্তরের মানুষ।
এই আত্মসমর্পণ নিয়ে আজও অনেক বিতর্ক চলছে। কেন এম এ জি ওসমানী সেখানে ছিলেন না। কেন অরোরার কাছে আত্মসমর্পণ করা হলো? তাহলে কি এটা পাক-ভারত যুদ্ধ ছিল?
এসব বিতর্কের বিষয়গুলো থেকে যাবে এটা স্বাভাবিক। এটা এক ধরনের বাকস্বাধীনতা বৈ আর কী? তবে বাড়াবাড়িটা বেশি হওয়া মোটেই কাম্য নয়।
আত্মসমর্পণের সে বাণীগুলো ছিল এমন :
The Pakistan eastern command agree to surrender all Pakistan armed forces in Bangladesh to Lieutenant General Jagjit Singh Aurora General, officer-commanding in chief of the Indian and Bangladesh forces in the eastern theatre, This surrender includes all Pakistan land, air and naval forces and civil armed forces. They are currently located to the nearest regular troops under the command of Lieutenant General Jagjit singh.
The Pakistan eastern command shall come under orders of Lieutenant-General Jagjit Singh Aurora as soon as this instrument has been signed, Disobedience of orders will be regarded as breach of the surrender terms and will be dealt with in accordance with the accepted laws and usages of war. The decision of Lieutenant General Jagjit Singh Aurora will be final, should any doubt arise as to the meaning or interpretation of surrender terms.
Lieutenant General Jagjit Singh Aurora gives a solemn assurance that personnels who surrender shall be treated with dignity and respect that soldiers are entitled to in accordance with provisions of the Geneva Convention and guarantees the safety and well-being of all Pakistan military and para-military forces who surrenders, protection will be provided to foreign nationals, ethnic minorities and personnels of West Pakistan origin by the forces under the command of Lieutenant General Jagjit singh Aurora.
এর আগে একাত্তরের এই দিন সকালে ঢাকা সেনানিবাসের কমান্ড বাঙ্কারে এসে পৌঁছান জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক কর্মকর্তা জন কেলি। তবে সেখানে জেনারেল নিয়াজিকে পাওয়া যায়নি। তবে রাও ফরমানকে পাওয়া যায়। রাও ফরমানই জন কেলিকে আত্মসমর্পণের কথা জানান। পরে জন কেলির হাত ধরেই আত্মসমর্পণের বাকি পথটুকু সম্পন্ন হয়।
সেদিন পর্দার আড়ালে যা ঘটেছিল, তা জন কেলির এক বর্ণনা থেকেই জানা যাক। কমান্ডার জেনারেল নিয়াজি চাইছিলেন রাওয়ালপিন্ডি থেকে সুস্পষ্ট নির্দেশ আসুক আত্মসমর্পণের জন্য। সকালে তিনি গভর্নর মালিকের কাছ থেকে চিঠি পেয়েছিলেন ত্বরিৎ ব্যবস্থা ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। মালিক তাঁর বার্তায় লেখেন, ‘আপনার ও আমার কাছে প্রেসিডেন্ট প্রেরিত বার্তার পরিপ্রেক্ষিতে আপনার দিক থেকে কী ব্যবস্থা নিয়েছেন, আমি সেটা জানতে চাইছি। তাতে সুস্পষ্টভাবে বলা হযেছে যে আপনি সংঘাত বন্ধের জন্য সব পদক্ষেপ নিন এবং সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য, পশ্চিম পাকিস্তানের ও এখানকার বিশ্বস্তজনদের জীবন রক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। যা দরকার সেটা করার জন্য আপনাকে অনুরোধ করছি।’
নিয়াজি রাওয়ালপিন্ডিতে জেনারেল হামিদের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। জেনারেল হামিদ তাঁকে ‘নির্দেশমতো কাজ করতে’ বলেন। নিয়াজি আকুল হয়ে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে কথা বলতে চান। দেশের এই গুরুতর পরিস্থিতিতে ইয়াহিয়ার তখন অন্য দশা, নিয়াজি লিখেছেন, ‘জেনারেল হামিদ বললেন তিনি (ইয়াহিয়া) বাথরুমে গেছেন। আদতে তিনি বাথরুমে ছিলেন না, অতিরিক্ত মদ্যপানে তাঁর তখন বেসামাল অবস্থা। এরপর এয়ার মার্শাল রহিম খান আমার সঙ্গে কথা বলেন, তাঁকেও মনে হচ্ছিল মাতাল, তিনি চাপ দেন আমি যেন প্রেসিডেন্টের হুকুম তামিল করি।’
এদিকে সকাল ১০টার পর মিত্রবাহিনী ঢাকায় পৌঁছে। অন্যদিকে এর আগেই বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী তার বাহিনী নিয়ে মিরপুর ব্রিজ দিয়ে ঢাকায় ঢুকে পড়েন। বিকেল ৪টার আগেই বাংলাদেশের দুটি নিয়মিত বাহিনীর ইউনিটসহ চার ব্যাটালিয়ান সৈন্য রাজধানীতে প্রবেশ করে।
পৃথিবীতে আর কোনো দেশ এত অল্প সময়ে এত রক্ত দিয়ে পরাশক্তির বিরোধিতা সত্ত্বেও স্বাধীনতা অর্জন করতে পারেনি। তবে বেশ কিছু দেশ স্বার্থবাদীদের হস্তক্ষেপে বা আত্মঘাতীমূলক সিদ্ধান্তের কারণে কম সময়ে স্বাধীন হয়েছে বা নিজের অস্তিত্ব বিলোপ করেছে। এ ক্ষেত্রে আমরা সিকিম ও দক্ষিণ সুদানের কথা উদাহরণ হিসেবে টানতে পারি।
আজকের এই দিনে প্রতিষ্ঠা হয় তৃতীয় কোনো বাঙালির (শেখ মুজিবুর রহমান) শাসনব্যবস্থা। অনেক ঐতিহাসিকই মনে করেন এই বাংলা মাত্র দুজন বাঙালি ছাড়া বরাবরই শাসিত হয়েছিল বহিরাগত শাসক দ্বারা। সে দুজন বাঙালি শাসক ছিলেন রাজা শশাঙ্ক আর জালালুদ্দিন যদু।
দীর্ঘকালের ঔপনিবেশিক শোষণের ওপর আবার পাকিস্তানের শাসন-শোষণ। অতঃপর যুদ্ধ, অবশেষে স্বাধীনতা।