স্মৃতিকথা
তরুণদের হাত ধরেই এগিয়ে যাবে ইতিহাস
একবুক স্বপ্ন নিয়ে যোগ দিয়েছিলাম মুক্তিযুদ্ধে। রেসকোর্সে দাঁড়িয়ে থেকে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ শুনেছিলাম। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানিরা আক্রমণ শুরু করল, বঙ্গবন্ধু ওই রাতেই গ্রেফতার হলেন। গ্রেফতার হওয়ার আগে তিনি ইপিআরের ওয়্যারলেসে স্বাধীনতার ঘোষণা করলেন। শুরু হয়ে গেল আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। নেতাদের পরামর্শ ছিল গ্রামে চলে গিয়ে যুদ্ধ সংগঠিত করার। আমি চলে গেলাম জন্মশহর লক্ষ্মীপুরে, সেখানে গিয়ে বন্ধু-বান্ধব এবং মুক্তিকামী তরুণদের নিয়ে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করলাম। প্রশিক্ষক হিসেবে পেলাম অবসরপ্রাপ্ত এক সেনা কর্মকর্তাকে। এই প্রশিক্ষণ যথেষ্ট না মনে করে চলে গেলাম ভারতে। মে মাসের দিকে ভারতে গিয়ে দুই মাসের প্রশিক্ষণ শেষে চলে এলাম বাংলাদেশে। বাংলাদেশে এসে আবার যুদ্ধ শুরু করলাম। অনেক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। আমরা পেলাম স্বাধীন এক দেশ।
একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বপ্নের হিসাব মেলাই। হিসাব মেলাই স্বাধীনতার স্বপ্ন আসলে কতটা পূরণ হয়েছে? বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল একটি স্বাধীন দেশের। পাকিস্তানের কারাগার থেকে বেরিয়ে এসে বঙ্গবন্ধু দেশ গড়ার কাজে হাত দিলেন। বিপর্যস্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণে তিনি মনোযোগ দিলেন। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে ১৯৭৩ সালে এমপি হলাম। সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিল। স্বপ্নের সোনার বাংলা নির্মাণের স্বপ্ন ধূলিস্যাৎ করা হলো বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে। পঁচাত্তরের এই হত্যাকাণ্ডে মুছে ফেলা হলো আমাদের স্বাধীনতার স্বপ্ন। এরপর বারবার ক্ষমতায় যারা এসেছে, তারা স্বাধীনতাবিরোধীদের ক্ষমতায় এনেছে। স্বাধীনতাবিরোধীরা ক্ষমতায় থেকে বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানানোর চেষ্টা করেছে। স্বাধীনতার দীর্ঘদিন পর ১৯৯৬ সালে আমরা ক্ষমতায় এসে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়ন শুরু করলাম। বর্তমানে পরপর দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থেকে স্বাধীনতার স্বপ্ন পূরণে আমরা অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছি। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার স্বপ্ন পূরণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বদ্ধপরিকর। এরই মধ্যে আমরা নিম্ন-মধ্যবিত্ত দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছি। বিদ্যুৎ খাতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছি, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছি। এগুলো সবই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ফসল।
এখন যারা তরুণ প্রজন্ম, তারা অনেকেই মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তেমন জানে না দেখে মন খারাপ হয়। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তাদের যথেষ্ট ধারণা না থাকায় এরা স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ছে। তরুণদের এই না জানার পেছনে তরুণদের কোনো কিছু জানতে না চাওয়ার বিষয়টিই মুখ্য মনে হয়। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক প্রত্যক্ষদর্শীর লেখা বই আছে, এগুলো পড়লে তরুণ প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানতে পারবে। তরুণদের সবারই বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পড়া উচিত। চাকরি ক্ষেত্রে ৪০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা বরাদ্দ করা হয়েছে। কোটার ব্যাপারে এখন অনেক তরুণই মুক্তিযোদ্ধা সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা করে থাকে। তাদের উচিত এই মুক্তিযুদ্ধকে সঠিকভাবে জানা। সঠিকভাবে জানলেই তারা বুঝতে পারবে মুক্তিযুদ্ধ কী? মুক্তিযোদ্ধারা কারা? মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানার জন্য অনেক কিছুই আছে। পাঠ্যপুস্তকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অন্তর্গত করা হয়েছে। স্বাধীনতা দিবস কিংবা বিজয় দিবসে তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রামাণ্যচিত্র প্রচার করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর হতে পারে তরুণ প্রজন্মের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে ধারণা পাওয়ার একটি উত্তম জায়গা। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকসহ বেশ কয়েকজন এমপি রাশিয়া, জার্মানি ঘুরে এসেছি, দেখে এসেছি এসব দেশ কীভাবে তাদের স্বাধীনতার ইতিহাসকে তুলে ধরেছে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় এসব দেশের আদলে কাজ শুরু করেছে। এসব কাজ বাস্তবায়িত হলে তরুণরা স্বাধীনতার ইতিহাস সম্পর্কে আরো বেশি জানার সুযোগ পাবে। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব তরুণদেরই কাঁধে তুলে নিতে হবে। এ জন্য তরুণদের স্বাধীনতা সম্পর্কে জানতে হবে। তরুণরা মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানলেই এগিয়ে যাবে আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ।
লেখক : সংসদ সদস্য, লক্ষ্মীপুর-৩ ও সদস্য, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।