প্যারিস জলবায়ু সম্মেলন
আলোর নিচেই অন্ধকার
২০০৯ থেকে ২০১৫, মাঝে কেটে গেছে ছয় বছর। চাওয়া ছিল একটাই, জলবায়ু পরিবর্তন রোধে সব দেশের ঐকমত্য। অথচ ধরিত্রীর কল্যাণে দেশগুলোর এক মত হতে সময় লেগে গেছে পুরো ছয় বছর। ডারবানের চাওয়া মিলল প্যারিসে। কার্বন নিঃসরণ কমাতে ধনী ও উন্নত দেশগুলোর থেকে প্রতিশ্রুতি আদায়, ক্ষতিপূরণ দাবিসহ বেশ কিছু চাওয়া নিয়ে ফ্রান্সের প্যারিসে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ‘জলবায়ু সম্মেলন’ বা কোপ ২১। সম্মেলনটি নানা কারণে সফলতার মুখ দেখেছে, কারণ অন্তত ১৯৫টি দেশের ঐকমত্য নিঃসন্দেহে একটি বড় প্রাপ্তি। সব দেশ পরিবেশ রক্ষার দাবিতে আনুষ্ঠানিকভাবে একটা চুক্তিতে আসতে পেরেছে— এটাই বা কম কিসে।
তবে, চুক্তিতে একমত নামক প্রদীপের নিচে অন্ধকার রয়ে গেছে আগের বারের মতোই।
১১ ডিসেম্বর শনিবার প্যারিস সময় সন্ধ্যায়, ধরিত্রীকে রক্ষার ঐতিহাসিক চুক্তিতে পৌঁছান বিশ্বনেতারা। চূড়ান্ত চুক্তি উপস্থাপনের প্রায় সাত ঘণ্টা পর, সর্বজনীনভাবে গৃহীত হয় এ চুক্তি। ২০৫০ সাল নাগাদ বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখার বাধ্যবাধকতা নিয়ে, অনুমোদন পায় চুক্তিটি। ৩২ পৃষ্ঠার চুক্তিতে বলা হয়, উন্নয়নশীল ও দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোর জন্য ১০ হাজার কোটি ডলারের ক্ষতিপূরণ দেবে শিল্পোন্নত দেশগুলো। প্যারিস সম্মেলনের বড় প্রাপ্তি বলতে একটা চুক্তিতে আসাটাই সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হিসেবে দেখছেন পরিবেশকর্মীরা। চুক্তি যাতে না হয় সেই লক্ষ্যে প্রাণপন চেষ্টা করেছে বেশ কিছু উন্নত দেশের লবিস্টরা। পৃথিবীকে বসবাসের উপযোগী রাখতে পারে এ ধরনের একটা চুক্তির প্রয়োজন রয়েছে, এটা প্রায় সব দেশই স্বীকার করেছে কিন্তু তাদের নিজেদের জাতীয় স্বার্থ আছে এমন বিষয়ে তারা ছাড় দিতে রাজী হচ্ছিল না। এ ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলো বিশেষ করে সৌদি আরব এই চুক্তি যাতে না হয় শেষ পর্যন্ত অনেক চেষ্টা করেছে। আগের যতগুলো সম্মেলন সবই ছিল ব্যর্থতার গল্প। সেই বৃত্ত ভাঙল প্যারিসের এবারের জলবায়ু সম্মেলন।
তবে, চুক্তির ফোকর ঠিক এখানেই। কারণ চুক্তিতে একমত হলেও এখনই সেটি সই বা কার্যকর হচ্ছে না। চুক্তি কার্যকরের জন্য আসছে বছরের ২২ এপ্রিল থেকে ২০১৭ সালের ২১ এপ্রিল পর্যন্ত জাতিসংঘ মহাসচিবকে এক বছর সময় দেওয়া হয়েছে। তবে এর মধ্যে যেসব দেশ শতকরা ৫৫ ভাগ কার্বন গ্যাস নিঃসরণের জন্য দায়ী কেবল তাদের স্বাক্ষরেই এ চুক্তি কার্যকর বা বাস্তবায়িত হতে পারে। উন্নত ও ধনী-উৎপাদনশীল এসব দেশের চুক্তিতে অংশগ্রহণে বিশেষ বাধ্যবাধকতা রাখা হয়নি। এটিও প্যারিস চুক্তির এক ধরনের বড় ব্যর্থতা। চাইলেই যেকোনো দেশ চুক্তি স্বাক্ষর নাও করতে পারবে। কেউ যদি স্বাক্ষর করতে না চায় সেক্ষেত্রে পদক্ষেপ কী হবে তারও স্পষ্ট কোনো ধারণা দেওয়া নেই চুক্তিতে।
আরেকটি মজার ব্যাপার হলো, সই করার তিন বছর পর যেকোন দেশ চুক্তি থেকে বেরিয়ে যেতে পারবে। আবার কোনো রাষ্ট্র যদি চুক্তি সম্পাদনের পর না মানে তাহলে কী শাস্তি বা জরিমানা হবে তারও স্পষ্ট কোনো উল্লেখ রাখা হয়নি প্যারিস চুক্তিতে।
৩১ পৃষ্ঠার এই সর্বজনীন চুক্তিতে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে আইনি বাধ্যবাধকতার পাশাপাশি পাঁচ বছর পরপর কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি পর্যালোচনার বিধান থাকছে। উন্নয়নশীল ও দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোকে প্রতিবছর ১০ হাজার কোটি ডলার ক্ষতিপূরণ দেবে, শিল্পোন্নত দেশগুলো। যা কার্যকর হবে ২০২০ সালের পর থেকেই। ১.৫ ডিগ্রি লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে তৈরি হওয়া দাবি অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে সত্যিকারের ও স্পষ্ট কোনো অঙ্গীকার করা হয়নি এটা ঠিক কীভাবে বাস্তবায়ন করা করা হবে? তাপমাত্রা বৃদ্ধি কমাতে কোনো উল্লেখযোগ্য পরিকল্পনার কথাও বলা হয়নি, যা ধরে এগিয়ে যাওয়া হবে। তবে, উন্নত দেশগুলো তাদের যে পরিকল্পনা জমা দিয়েছে তা দিয়ে ১.৫ ডিগ্রি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব নয়।
এবার একটু ক্ষতিপূরণ প্রসঙ্গে আসা যাক, ক্ষতিপূরণের অর্থায়ন কোথা থেকে আসবে তারও কোনো ধারণা দেওয়া হয়নি প্যারিস চুক্তিতে। এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে দায় স্বীকার বা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিষয়। আবার কোনো কোনো রাষ্ট্র ক্ষতিপূরণ দিতে সম্মত হলেও জলবায়ু পরিবর্তন তথা বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির দায় স্বীকার করতে চায় না। চীন, ভারত, ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকা এখনই ক্ষতিপূরণের অর্থ দিতে সম্মত হয়নি বলেও জানিয়েছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো। চুক্তিতে অর্থায়নের বিষয়টি একটু বেশিই দুর্বল মনে হয়েছে – ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ ক্লজটি খুবই ক্ষীণভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এখানে ক্ষতিপূরণ বাস্তবায়নের কিছু অংশ দেশগুলোর আগ্রহের ওপর নির্ভর করছে। বলা হয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত উন্নয়নশীল কোনো দেশ নিজে থেকে ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারবে না। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, সব কিছুই যদি উন্নত দেশের ইচ্ছে মতোই হয় তাহলে চুক্তি করারই বা দরকার ছিল কী?
তবে চুক্তির সব অংশ মানা বাধ্যতামূলক না করাই সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক হয়েছে বলে মত পরিবেশ বিশ্লেষকদের। দেশগুলো কার্বন নিঃসরণের মাত্রা কমানোর পরিকল্পনা ও দালিলিক প্রমাণ রাখা- সেগুলোর নিয়মিত মূল্যায়নের বিষয়ে বাধ্যতামূলক হলেও কোন দেশ কী পরিমাণ লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করবে তার কোনো বিস্তর ধারণা দেওয়া হয়নি প্রস্তাবিত চুক্তিতে।
চীন, যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও দ্রুত উন্নয়নশীল দক্ষিণ আফ্রিকা, ব্রাজিল, ভারতসহ বেশ কিছু দেশ ২০০৯-এর ডারবানের কনফারেন্স অব পার্টিজ কোপ থেকে চুক্তি সম্মত বিরোধিতা জানিয়ে আসছিল। তারা বলছে, কার্বন নিঃসরণ কমালে সেসব দেশের উৎপাদন কমে যাবে। যা সরাসরি প্রভাব ফেলবে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে। এত সব বিরোধিতার পরও প্যারিসের কোপ ২১-এ জলবায়ু পরিবর্তন রোধে বিশ্বের দেশগুলোর ঐকমত্য একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়েই থাকবে। তবে চাতক দেশের নাগরিক হয়ে আশা একটাই, চুক্তির বাস্তবায়ন যেন হয়।
লেখক : বাংলাদেশ যুব পরিবেশ কর্মসূচির মুখপাত্র