১০ জানুয়ারি
বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস
বাংলা ভাষায় ‘প্রত্যাবর্তন’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো পুনরায় আগমন কিংবা ফিরে আসা। আর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন মানে হলো, আগে দেশে ছিলেন, কিন্তু কোনো কারণে সাময়িক সময়ের জন্য বিদেশে অবস্থান করে সেখান থেকে পুনরায় দেশের মাটিতে ফিরে আসা। বিভিন্ন সময় নানাভাবে বিভিন্ন ব্যক্তির বিদেশ থেকে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের ইতিহাস রয়েছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন বিশ্বের সব ইতিহাসকে পেছনে ফেলে দিয়েছে। এখন আমি সে ইতিহাসেরই কিছু দিক নিয়ে আলোচনা করব।
আমরা আগেই সবাই জানি, এ দেশে বঙ্গবন্ধুর মতো একজন নেতার জন্ম না হলে বাংলাদেশ নামের কোনো স্বাধীন দেশ জন্ম হতো কি না, সন্দেহ ছিল কিংবা হলেও তা কত দিনে হতো, কে-ই বা এর সদুত্তর দিতে পারে। ইতিহাসের পর্যালোচনায় জানা যায়, বঙ্গবন্ধুরও জন্মের আগে থেকে ব্রিটিশশাসিত পাক-ভারত উপমহাদেশে কখনো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, কখনো সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন, কখনো বা রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ইত্যাদির কারণে এ অঞ্চলের রাজনৈতিক মাঠ সরগরম থাকত। তারপর বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় তাঁর স্কুলজীবনেই সেই রাজনৈতিক বৈষম্যের বিষয়টি দেখতে পেতেন। তখন বাঙালি জাতির নেতৃত্বদানকারী নেতা শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, তারও পরে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এতদাঞ্চলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। বিশেষত, হক সাহেব এবং শহীদ সাহেব যখন কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রী থাকা অবস্থায় গোপালগঞ্জের মিশন স্কুলে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে ভিজিটে এসেছিলেন, তখনই সে স্কুলের সাধারণ ছাত্রদের সপক্ষে এক প্রতিবাদী ছাত্র বালক শেখ মুজিব তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছিলেন। তখন থেকেই আস্তে আস্তে বালক শেখ মুজিব সেসব নেতৃত্বের সান্নিধ্যে আসার প্রয়াস পান।
বঙ্গবন্ধু লিখিত তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থটি, যা তাঁরই সুযেগ্যা কন্যা বর্তমান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বের করে বাংলার সাহিত্যভাণ্ডার এবং ইতিহাসকে অনেক সমৃদ্ধ করেছে। আর বাঙালির রাজনৈতিক ইতিহাস পেয়েছে তার প্রকৃত সত্যের ভিত্তি। সেই গ্রন্থটির মাধ্যমেই জাতি অনেক ইতিহাসের ফয়সালা জানতে পারছেন। সেখান থেকেই আমরা এতদাঞ্চলে স্বাধীনতার সুদীর্ঘ ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা পাই। এখানে একটি কথা খুব ভালোভাবে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, বঙ্গবন্ধু শুধু বাংলাদেশ নামক দেশটিই স্বাধীন করেননি। তিনি পাক-ভারত উপমহাদেশকে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ থেকে মুক্ত করার ক্ষেত্রেও রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান। গণমানুষের সেবাটাকে যিনি তাঁর ভাগ্য হিসেবে বরণ করেছিলেন, সে জন্য কলকাতায় পড়তে গিয়েও সেখানে তিনি সেসব বীরবাঙালি নেতার সঙ্গে সার্বিক ও সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করে আন্দোলন-সংগ্রামে পূর্বপরিকল্পনা মাফিক ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। তিনি কলকাতায় থাকার সময় পাক-ভারত হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গাটা খুব কাছে থেকে দেখেছেন। কাজেই এর ভয়াবহতা উপলব্ধি করতে পেরেই তিনি তাঁর রাজনৈতিক জীবনে কখনো সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় দেননি। তাঁর সারা জীবনের রাজনৈতিক আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল অসাম্প্রদায়িক চেতনা। আর সে জন্য পরম মুসলিমপন্থাবলম্বনকারী পাকিস্তানের সঙ্গে বেশি দিন থাকতে পারেনি তাঁর মন। তাই তিনি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগকে পরে অসাম্প্রদায়িক করার জন্য ‘মুসলিম’ কথাটি বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ গঠন করেছিলেন। এভাবেই আস্তে আস্তে তিনি শেখ মুজিব থেকে গণমানুষের অবিসংবাদিত ও কারিশম্যাটিক নেতা, বঙ্গবন্ধু, জাতির পিতা এবং সর্বোপরি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির মর্যাদায় আসীন হয়েছেন।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ তখন প্রথমে প্রাদেশিক পরিষদে ও পরে জাতীয় পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে সমর্থ হয়েছিল। বাঙালির মুক্তির সনদখ্যাত ঐতিহাসিক ছয় দফার ভিত্তিতে সেই নির্বাচনের পর তিনি তখন পুরো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রিত্ব প্রত্যাখ্যান করে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা চাইলেন। আর পাকিস্তানিরা যখন এ নিয়ে টালবাহানা করছিল, তখন বঙ্গবন্ধু দেখতে পেলেন যে সেখানে আর সংগ্রাম ছাড়া কোনোভাবেই তা অর্জন সম্ভব নয়। তখন তিনি ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে সেই ঐতিহাসিক জনসভা আহ্বান করেন। সেখানে বাঙালির স্বাধীনতার জন্য বিশ্বের ইতিহাসে ‘ম্যাগনাকার্টা’ খ্যাত ১৭ মিনিটের একটি ভাষণ প্রদান করেন, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। তখন থেকেই মূলত পূর্ব বাংলায় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সশস্ত্র মুক্তির সংগ্রাম শুরু হয়ে গিয়েছিল। সে সময় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী যখন শেখ মুজিবের মতিগতি তাদের বিবেচনায় ভালো ঠেকেনি, তখন তলেতলে তারা পূর্ব বাংলায় সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করে যাচ্ছিল। তারই ধারাবাহিকতায় একদিকে ২৫ মার্চের কালরাতে অসহায় ও নিরস্ত্র বুদ্ধিজীবীদের ওপর অতর্কিতে হামলা চালিয়ে নির্বিচারে তাঁদের হত্যা করা হচ্ছিল, অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে গিয়েছিল। তারা শেখ মুজিবকে পূর্ব বাংলার কোনো কারাগারে রাখাটা নিরাপদবোধ করেনি।
অতঃপর শেখ মুজিবের পূর্বনির্দেশেই প্রথমে ২৬ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে সেখানকার আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন, যা পরে আবার ২৭ মার্চ তৎকালীন সেনাবাহিনীর মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে পাঠ করে শুনিয়েছিলেন। তার পরে চলমান মুক্তির সংগ্রামকে আরো বেগবান, প্রাতিষ্ঠানিক ও সর্বোপরি রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় নিয়ে আসার জন্য ১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়ার মেহেরপুরে মুজিবনগরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়েছিল। সেখানে তাঁর অনুপস্থিতিতে সৈয়দ নজরুল ইসলাম জাতীয় অন্য নেতৃবৃন্দকে সঙ্গে নিয়ে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে পুরো নয় মাস মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বে দিয়েছেন। ৭ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত নয় মাস মুক্তিসংগ্রামের সময় সেই বঙ্গবন্ধু নির্দেশিত বক্তব্য, ভাষণ, মত ও পথেই পুরো বাঙালি জাতি দুই লাখ মা-বোনের ইজ্জত ও ৩০ লাখ শহীদের আত্মদানের চরমমূল্যের বিনিময়ে এ দেশ স্বাধীন হয়েছে।
স্বাধীনতা যুদ্ধের পুরো নয়টি মাস বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের স্বৈরশাসকরা পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে আটকে রেখেছিল। বঙ্গবন্ধু তাঁর সারা রাজনৈতিক জীবনের বেশির ভাগ সময়ই কারাগারে কাটিয়েছেন। কাজেই তিনি কখনো কারাগারকে ভয় পেতেন না। ১৬ ডিসেম্বরে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন বাংলাদেশে রূপান্তরিত হওয়ার পর তারা তখন স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রথম নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সেই কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠ থেকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। তখন তিনি বীর বাঙালির বীর নেতা হিসেবে বীরের বেশে তাঁরই ডাকে স্বাধীন হওয়া এই বাংলায় প্রত্যাবর্তন করেন।
একদিকে ঘৃণ্য নরহত্যার এবং অন্যদিকে গর্বিত স্বাধীনতার ১৯৭১ সাল পেরিয়ে সেই দিনটি ছিল ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। সেই ১০ জানুয়ারিতে বাংলাদেশের রাজধানী শহর ঢাকা পরিণত হয়েছিল একটি জনমানব সাগর। বরণ্যে সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী এ দিনটির বর্ণনা দিতে গিয়ে তাঁর একটি লেখায় লিখেছিলেন যে, বিমানে চড়ে ওপর থেকে মানুষের ঢল দেখে তাঁর দুই চোখ ভরে শুধু আবেগজড়িত কান্না এসেছিল সেদিন। ঠিক একই অবস্থা হয়েছিল ৭ মার্চের রেসকোর্স ময়দানের সেই ঐতিহাসিক ভাষণের দিনে। সেদিনও জনসভাস্থলসহ পুরো ঢাকা শহরে তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না।
চারদিকে শুধু লোকে-লোকারণ্য। একটি দেশের একজন রাজনৈতিক নেতা এতটা জনপ্রিয় হয় কেমন করে! যিনি পুরো নয় মাস দেশেই ছিলেন না, তার পরও শুধু তাঁর নামের ওপর ভিত্তি করে বীর বাঙালি সাহসের জোরে দেশকে স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে আসে। কিন্তু তিনি যদি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে ষড়যন্ত্রকারীদের হাতে নির্মমভাবে সপরিবারে নিহত না হতেন, তাহলে এখন যে রকমভাবে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, তার অনেক আগেই বাংলাদেশ মালয়েশিয়া কিংবা সিঙ্গাপুর হয়ে যেতে পারত। তখন বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা দেশের বাইরে থাকার কারণে বেঁচে যান। পরের সরকারগুলো শেখ হাসিনাকে দেশে আসতে না দেওয়ার প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধুর মতো এক প্রকার চ্যালেঞ্জ নিয়েই ১৯৮১ সালের ১৭ মে তাঁকেও স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করতে হয়। তখনো রাজধানী ঢাকার অবস্থা সে রকমই হয়েছিল। তার পরে শেখ হাসিনা ২০০৭ সালের সামরিক পরিবেষ্টিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রোষানলে পড়ে আবারো চ্যালেঞ্জ নিয়েই বাংলাদেশের মানুষের কল্যাণের কথা চিন্তা করে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেছিলেন।
এ দিনটি তাই বাঙালি জাতির জীবনে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিন হিসেবে পরিচিত। প্রতিবছরের মতো এবারো এদিনটিকে ঘিরে সরকারসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন উৎসবমুখর পরিবেশে তা পালনের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়েছে। স্বাধীনতার ৪৪ বছর পর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের চতুর্থ মেয়াদের (প্রথম ১৯৭১-৭৫, ২১ বছর পর দ্বিতীয় ১৯৯৬-২০০১, আট বছর পর তৃতীয় ২০০৯-২০১৪ এবং চতুর্থ ২০১৪-২০১৯) দ্বিতীয় বছরের শুরুতে বাংলাদেশের স্রষ্টা জাতির জনকের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। এরই মধ্যে ২০১৬ সালের ১০ জানুয়ারি টঙ্গীর তুরাগতীরে ৫১তম বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের আখেরি মোনাজাত থাকায় তাঁর প্রতি সম্মান জানিয়ে সরকার আগামী ১১ জানুয়ারি অলোচনা অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যাঁকে হারিয়েছি তাঁকে তো আর পাওয়া যাবে না, তবে তাঁর নির্দেশিত পথে তাঁরই সুযোগ্যা কন্যার নেতৃত্বে পরিচালিত সরকারের চলমান উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার প্রত্যয়ই এবারের এ দিবসের অঙ্গীকার হোক।
লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ