বেতন কাঠামো

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের দুঃখগাথা

Looks like you've blocked notifications!
সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজান।

লোকে বলে, ধনীর চেয়ে গরিবকেই বেশি জ্বালা-যন্ত্রণা পোহাতে হয়। কারণ, সুযোগ পেলে অসহায়-দিনগ্রস্তকে কেউ একহাত নিতে ছাড়ে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সাম্প্রতিক অবস্থা এখন সে রকমই। কারণ আর কিছু নয়, বিজয় দিবসে উপহার পাওয়া পে স্কেলের গেজেট নিয়ে। শিক্ষকরা পে স্কেলের মাধ্যমে তাঁদের অবমাননার কথা আঁচ করতে পেরেছিলেন আজ থেকে প্রায় আট মাস আগেই।

বলা যায়, মহাত্মা গান্ধীর মতোই অহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে কর্তৃপক্ষের সুমতি আনার চেষ্টা করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককুল। কিন্তু এই আন্দোলনের জন্য তাঁদের নিন্দা আর নানা অপবাদও সহ্য করতে হয়েছে। কেউ বলেছেন, মাস্টারদের কোনো জ্ঞানই নেই। কেউ বা বলেছেন, তাঁরা জায়গায় জায়গায় মাস্টারি করে টাকার বন্যায় ভেসে যান, যে সুযোগ অন্যরা পায় না। কেউ বা বলেছেন, অন্য কুল থেকে তাঁদের চাকরির বয়স বেশি। এ সুযোগে সবাই কমবেশি এক ঘা দিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের।

কিন্তু যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবমাননার চেষ্টা করা হয়েছে, তাঁদের কষ্টের কথা, তাঁদের অবমাননার কথা খুব কম লোকই বলেছে। শুরু থেকে শুরু করা যাক। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো ফল করা শিক্ষার্থীরাই প্রভাষক হিসেবে যোগদান করে। কিন্তু যোগদানের পর তার না হয় বসার জায়গা, না থাকে কোনো প্রেষণা। কিন্তু নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি ভালোবাসার টানেই সে এখানে ফিরে আসে।

নিজের পরিচিত ক্যাম্পাসে জীবনের বড় একটি অংশ অতিবাহিত করার মধ্যে আসলেই আনন্দ থাকে। কিন্তু অন্যান্য পেশায় চাকরিতে যোগদানের পরপরই ভালো অঙ্কের থোক বরাদ্দ দেওয়া হয় শুরুর কঠিন সময়টি উতরে যাওয়ার জন্য। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে একজন প্রভাষকের শুরুর কয়েকটি বছর চলে যায় তাঁর এই ক্ষুদ্র আয় দিয়ে পরিবারের ভরণপোষণ করতে করতে। আর বাজেটে যেভাবে শিক্ষা খাতে আয় কমছে, তার ঢেউ বিশ্ববিদ্যালয়েও লেগেছে।

ফলে একজন নবীন প্রভাষকের না থাকে বসার জায়গা, না থাকে গবেষণার সুযোগ। কিন্তু এই প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে সেই উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করে। আমি এমন অনেক প্রভাষককে জানি, যাঁরা ঢাকার দূর-দূরান্ত থেকে লোকাল বাসে যাতায়াত করে আবার ফিরে যান। এই কষ্টের কথা কখনো কি আমরা বলেছি?

আমরা তো বলিনি, ক্যাডার সার্ভিসের একজন চাকুরের মতো আমাদেরও পাজেরো দিতে হবে যাতায়াতের জন্য। তরুণ শিক্ষকরা নিজের চেষ্টায় বিদেশে একটি বৃত্তি জোগাড় করে উচ্চতর ডিগ্রি করতে যান, প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মতো সরকারি অর্থে বিদেশে ডিগ্রি নিতে যাওয়ার সুযোগ তাঁদের নেই।

সেদিনই বিজ্ঞান অনুষদের একজন শিক্ষক বলছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর পিএইচডিতে সম্পূর্ণ বৃত্তি হয়ে যাওয়ার পর বিমানভাড়ার টাকা জোগাড় করতে তাঁকে হিমশিম খেতে হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোনো ধরনের সহায়তা তিনি পাননি। পাওয়ার সুযোগও নেই। এরপর বন্ধু-সহকর্মীদের কাছ থেকে টাকা ধার করে তিনি পিএইচডি শেষ করে দেশে ফিরে এসেছেন। ওই শিক্ষক জানালেন, মার্কিন মুলুকে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর চাকরি হয়ে গিয়েছিল। শুধু দেশকে ভালোবাসা আর মাটির টানে তিনি আবার ফিরে এসেছেন। কিন্তু এসে দেখলেন, তাঁর বসার জায়গাই নেই। কিন্তু দুঃখের কথা কজনই বা বলেছেন? শিক্ষকদের সমালোচনার সঙ্গে কজনই সহানুভূতি জানিয়েছেন এই বেদনার প্রতি?

শুধু প্রভাষকদের বেলায় এই বেদনা-অপ্রাপ্তিযোগ, তা কিন্তু নয়। এটি আরো বেশি তীব্র হয়ে ওঠে উচ্চতর পদধারী সহযোগী অধ্যাপক আর অধ্যাপকদের বেলায়। কারণ, তখন তার পরিবার হয়। দেখা যায়, একাডেমিক ফলাফলে তাঁর থেকে পিছিয়ে থাকা সহপাঠীরা পাজেরো গাড়ি নিয়ে চলাফেরা করেন। মনোরম পরিবেশে সুসজ্জিত আবাসন সুবিধা পান। পান আর্দালি, গাড়িচালক। আবার গাড়ি কেনার জন্য ঋণও পান, সঙ্গে যোগ হয় গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণের ভাতাও। এর কিছুই পান না অধ্যাপকরা।

অর্ধশত বছরের পুরোনো যেই একাডেমিক ভবনে তাঁর অফিসকক্ষ, তাঁর দরজাটি তিনি নিজেই খোলেন। বসার পুরোনো টেবিলটি নিজেই পরিষ্কার করেন। অতিথি এলে চা-নাশতা আনতে হয় নিজেকেই, নয়তো নিয়ে যেতে হয় শিক্ষক লাউঞ্জে আপ্যায়নের জন্য। এই বেদনা-কষ্টের কথা কোনো শিক্ষকই নিজে থেকে বলেননি। কারণ, জীবনে অর্থকড়ির চেয়ে মান-মর্যাদা অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

কিন্তু এই পে স্কেলের গেজেটের মাধ্যমে তাঁদের নানা অপ্রাপ্তিযোগের সঙ্গে জড়ো হয়েছে সম্মান কেড়ে নেওয়ার বিষয়টি। ১৯৮১ সালে চালু হওয়া সিলেকশন গ্রেড বাতিল করে শিক্ষকদের তৃতীয় গ্রেডের পর আর ওপরে যাওয়ার পথ রুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে এই বেতন কাঠামোতে। একটি প্রতিষ্ঠিত ৩৫ বছরের সিলেকশন গ্রেড প্রথাটি বাতিল এই পে স্কেলেই তো করা হলো। কিন্তু হাত দেওয়া হলো না সচিব পদের ওপর সুপার গ্রেড হিসেবে থাকা পদ দুটিতে। উল্টো প্রতিবাদের পর জ্ঞানের অভাবে এ আন্দোলন শিক্ষকরা করছেন, এমন গালমন্দও করেছেন সরকারের নীতিনির্ধারকরা।

মর্যাদাহানি, কর্মক্ষেত্রে নানা ধরনের বেদনার সঙ্গে এখন যোগ হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে সবচেয়ে ভালো ফল যাঁরা করেন, তাঁরাই নাকি জ্ঞানের অভাবে ভুগছেন এমন উপহাস।

কিন্তু আমাদের নীতিনির্ধারকরা ভুলেই গেছেন, রাজনীতির সবচেয়ে দুর্যোগ মুহূর্তে এই শিক্ষকরাই তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। একটি কথা না বললেই নয়। তা হলো, সরকারের বেতন যেভাবে বাড়ানো হয়েছে, এখনই সুযোগ ছিল শিক্ষকদের আলাদা প্রণোদনা দেওয়া, গবেষণাকে আরো উৎসাহিত করা।

ফ্লাইওভার, সেতু, মেট্রো রেল, নদীর নিচে টানেল অবশ্যই উন্নয়ন। কিন্তু আমরা কি ভেবেছি, দৃশ্যমান উন্নয়নের সঙ্গে দরকার শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন। ভাবিনি বলেই বারবার মেধাবীদের শিক্ষকতায় আসতে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে, পেশাটিকে অপমান করা হচ্ছে। একসময় আসবে, যখন দেশ চালাতে-গড়তে এই শ্রেণিকেই দরকার পড়বে। তখন কি পাশে পাওয়া যাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের? কারণ, নানা বেদনার যোগফলে বিদেশে উন্নত জীবনের আশায় পাড়ি দেওয়া শিক্ষকদের সংখ্যা কিন্তু এখন নেহাত কম নয়।

লেখক : শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।