কারাগার থেকে ক্যাম্পাসে ফেরা ফিনিক্স কানাইয়া কুমার
বিহারের বেগুসরাইতে সাধারণ পরিবারে বেড়ে ওঠা ছেলেটি আজ ভারতীয় রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। পাত্তা দিচ্ছে না কাউকে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে কটাক্ষ করতেও ন্যূনতম বিচলিত নয়। স্বাধীনতার কথা বলে, বলে সাধারণ মানুষের মুক্তির কথা। এই তো মাস খানেক আগেও যাকে একজন ছাত্রনেতাই বলা যেত, সে আজ রাজনীতির মাঠে পরিপক্ব খোলোয়াড়! তার এক একটি কথা বুলেটের মতো বিধে চলেছে মোদি প্রশাসনের বুকে। গ্রেপ্তার হয়েছে। হয়েছে আক্রমণের শিকার। তবুও মাথা নোয়ায়নি। ভারতের মাটিতে আজাদি আন্দোলনের নতুন এক তারকা। যে কি না কাশ্মীর ও কেরালার মানুষের অধিকারের কথা বলছে। দেশদ্রোহিতার অভিযোগে আক্রমণের শিকার হয়েছেন আদালত চত্বরে। পাতিয়ালা হাউজ কোর্টের মধ্যে বিজেপি সমর্থক আইনজীবীদের হাতে বেদম মার খান তিনি।
সেদিন মার খাওয়ার পর সেই ভয়ার্ত মুখ যেন আজ ম্যাজিকে উধাও! তিনি কানাইয়া কুমার। যিনি আজ হাজারও ভারতীয়কে নতুন করে ভাবতে সুযোগ করে দিয়েছেন। সিপিআইয়ের ছাত্র সংগঠন অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্ট ফেডারেশনের ছাত্রনেতা কানাইয়া কুমার জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের সভাপতি। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সরকারবিরোধী ও মুক্তি আন্দোলনের স্লোগান দেওয়ার অপরাধে সাদা পোশাকধারী পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে ২২ দিন জেল খেটেও এসেছেন। তিহার জেল থেকে রাষ্ট্রদ্রোহিতা মামলায় ৬ মাসের অন্তর্বর্তী জামিনে ছাড়া পেয়েই ক্যাম্পাসে সতীর্থদের মাঝে ফিরে বিপুল উচ্ছ্বাস আর ভালোবাসায় আপ্লুত হয়েছেন। কয়েক দিন জেলে কাটানো ছাত্রনেতা যে কতটা বদলে গেছেন, তার আভাস মিলল। জেল থেকে বের হয়ে যেন আগুনের ফুলকি ঝরছে এই ছাত্রনেতার কণ্ঠে। ফিরেই ছাত্র সমাবেশে মাইক হাতে নিয়ে বুঝিয়ে দিলেন, কেন তাঁকে নিয়ে নরেন্দ্র মোদিকেও চিন্তায় পড়তে হতে পারে।
দেশ থেকে মুক্তি নয়, দেশের ভেতরেই আমরা মুক্তি চাই। আজাদি পেটের জ্বালা থেকে, আজাদি দুর্নীতি থেকে, আজাদি মনুবাদ থেকে, আজাদি পুঁজিবাদ থেকে। আমরা সমাজতন্ত্র, ধর্ম নিরপেক্ষ, সাম্যের পক্ষে। আমরা দারিদ্র্য, ক্ষুধা, শোষণ, সাম্প্রদায়িক বিভেদ, জাতপাত, বৈষম্য থেকে এবং পশ্চাৎপদতা থেকে স্বাধীনতা চাই। আমরা কথা বলার স্বাধীনতার মানে বুঝি। স্বাধীনতার অর্থও বুঝি। সংবিধানের প্রতি সম্পূর্ণ ভরসা আছে।
কানাইয়া বলেন, আমি এখন আমার কাহিনী লিখব। কারাগারে থাকা অবস্থায়ই লেখা শুরু করেছি। আমি কখনোই ভারতবিরোধী কিছু বলিনি। আমি জানি, সত্য একদিন বেরিয়ে আসবে। সত্যঘটনাধীরে ধীরে প্রকাশ পাবে।
দেশের করদাতাদের অর্থে পড়াশোনা করে দেশ-বিরোধী কার্যকলাপ চলছে জেএনইউতে, এই অভিযোগও খারিজ করেছেন ছাত্র সংসদের এই সভাপতি। তাঁদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষার্থী দেশবিরোধী হতে পারেন না বলেও দাবি করেছেন তিনি। করদাতাদের অর্থ সুরক্ষিত বলে জানিয়ে তিনি বলেছেন, যাঁরা আমাকে সমর্থন করেছেন, তাঁদের সবাইকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। এও আশ্বাস দিতে চাই যে, একজন জেএনইউয়ে পড়ুয়া কখনো দেশবিরোধী হতে পারে না।
এ সময় আফজল সম্পর্কে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করে দিয়ে কানাইয়া বলেন, ‘আমায় প্রশ্ন করলে বলব, আফজল নয়, আমার আদর্শ রোহিত ভেমুলা।’
কানাইয়া বলেন, আমি নেতা নই, সাধারণ একজন ছাত্র। গত কিছুদিনে আমি একেবারে বোকা বনে গেছি। ছাত্ররা যে আমার ওপর এত ভরসা করেছে, সে জন্য আমি তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞ। ছাত্রদের পাশে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, আর যাই হোক, জেএনইউয়ের ছাত্ররা দেশদ্রোহী নয়। সরকার যদি ফেলোশিপ বন্ধ করে দেয়, সেটা ফের চালু করার লড়াই আমরা শুরু করব। দেশদ্রোহের অভিযোগে কাউকে গ্রেপ্তার করা হলে তাঁর পাশে দাঁড়াবে সমগ্র ছাত্রসমাজ।
আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মতো গুরুতর অভিযোগ না আনার জন্য সরকারকে আবেদন করেন তিনি। কারণ এতে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যত নষ্ট হতে পারে। কানাইয়া বলেছেন, ৯ ফেব্রুয়ারির ঘটনার তীব্র নিন্দা করছি আমরা। তবে সেটা রাষ্ট্রদ্রোহিতা হয়েছিল কি না, সেটা আদালতই ঠিক করুন। কিন্তু আমি শিক্ষার্থীদের আগামী দিনের কথা মাথায় রেখে সরকারকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা না করার আবেদন করব।
ক্যাম্পাসের প্রশাসনিক ব্লকের সামনে দাঁড়িয়েই কানাইয়া ভারতের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে পুলিশ প্রশাসন, মিডিয়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে কটাক্ষ করে বক্তব্য দেন।
প্রবল হাততালির মধ্যে ভাষণের ছন্দে ছন্দে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে কটাক্ষ করেছেন কানাইয়া কুমার। লোকসভা ভোটের সময় মোদির দেওয়া প্রতিশ্রুতির কথা উল্লেখ করে তীব্র সমালোচনা করেছেন এই ছাত্র নেতা। বলেছেন, মোদি বিদেশ থেকে কালো টাকা উদ্ধারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। প্রত্যেকের অ্যাকাউন্টে ওই কালো টাকা থেকে ১৫ লাখ টাকা দেওয়ার কথাও ছিল। ভোটে এমন প্রতিশ্রুতি অনেকেই দেন। কিন্তু মোদির প্রতিশ্রুতি এতটাই নাটকীয় ছিল, যে ভোলা সম্ভব হচ্ছে না। আর ওই ব্যর্থতা থেকে নজর ঘোরাতে চাইছে মোদির নেতৃত্বাধীন সরকার।
সেদিন সংসদে নিজের বর্ক্তৃতায় স্তালিনের প্রসঙ্গ টেনেছিলেন মোদি। তাও নজর এড়ায়নি কানাইয়া কুমারের। তিনি বলেন, এরমধ্যে হিটলার ও মুসোলিনির কথাও বলতে পারতেন মোদি। কানাইয়ার অভিযোগ, মুসোলিনির কাছেই তো পাঠ নিয়েছিল আরএসএস।
প্রধানমন্ত্রীকে চ্যালেঞ্জ করে বলেন, উনি ‘সত্যমেব জয়তে’ বলেন। সে কথা তো সংবিধানেই রয়েছে। আমরা তাই একই কথা বলি। মোদির ‘মন কি বাত’-কেও কটাক্ষ করতে ছাড়েননি কানাইয়া কুমার। বলেন, মোদি মনের কথা বলেন, মনের কথা শোনেন না। মায়ের ছেলেকেও দেশদ্রোহী বলা হয়েছিল, একটু মায়ের কথাও বলুন।
যে দিল্লি পুলিশ কানাইয়া দেশদ্রোহিতার অভিযোগে গ্রেপ্তার করেছিল, তা মোদি সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের অধীনে। আর কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহই দাবি করেছিলেন, জেএনইউয়ের আন্দোলনে সমর্থন রয়েছে জঙ্গি হাফিজ সইদের। এই প্রসঙ্গে একটি টুইটও করেছিলেন তিনি। এ দিন নাম না উল্লেখ করে সেই রাজনাথকেও কটাক্ষ করেছেন কানাইয়া কুমার। বললেন, ক্ষমতা আছে সেই ব্যক্তির হাতে যিনি ‘জাল’ টুইট করেন।
কানাইয়া কুমারকে দেশবিরোধী বলে আক্রমণ করতে গিয়ে বিজেপির কেউ কেউ সীমান্তে সেনাদের শহীদ হওয়ার প্রসঙ্গ টেনেছিলেন। এ দিন তার জবাবও দিয়েছেন কানাইয়া। বলেছেন, শহিদ জওনায়দের আমি স্যালুট করছি কিন্তু যে সেনা মরে সে এ দেশের, যে কৃষক মরে সেও এ দেশের। তোমরা কেন মিথ্যা রাজনীতি করছ।
তার ওপর আরোপিত মামলা সম্পর্কে কারহাইয়া বলেন, মামলাটি এখনো বিচারাধীন, তাই এই বিষয়ে আমি কিছু বলতে চাচ্ছি না। বক্তব্যের শেষ পর্যায়ে গিয়ে কানাইয়া বলেন, আবারও বলছি, ভারত থেকে নয়, ভারতে আজাদি চাই।
লড়াই যে এখানেই থামছে না স্পষ্ট করে দিয়েছেন কানাইয়া কুমার। বলেছেন তাঁদের যতই দমন করার চেষ্টা হবে আন্দোলন ততই বাড়বে। আরো দুই ছাত্র নেতা উমর এবং অনির্বাণের মুক্তির দাবিও তুললেন এ ছাত্রনেতা।
দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী আম আদমি পার্টি (আপ) নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়াল টুইটে কানাইয়ার বক্তৃতার প্রশংসা করে বলেছেন, আমি অনেকবার মোদিকে ছাত্রদের সঙ্গে টক্কর না দিতে বলেছিলাম। কিন্তু মোদিজি শোনেননি। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারাও কানাইয়ার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছেন। তাঁর আগুন-ঝরানো বক্তৃতায় অনেকেই বলছেন, দিল্লির রাজনীতি এক নতুন তারকা খুঁজে পেল।
অন্যদিকে কানাইয়াকে ‘ইঁদুরের’ সঙ্গে তুলনা করল আরএসএস। সংগঠনের নেতা মনমোহন বৈদ্য মন্তব্য করেছেন, কানাইয়ার ভাষণ কোনো প্রতিক্রিয়া দেওয়ার উপযুক্ত নয়। কমিউনিস্টদের দেখে ‘সেই ইঁদুরের’ কথা মনে পড়ছে। এরইমধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় টপ ট্রেন্ড কানাইয়া।
আদালতে কানাইয়ার বিরুদ্ধে ৯ ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানে ভারতবিরোধী স্লোগান দেওয়ার প্রমাণ মেলেনি। বেশির ভাগ তথ্যই জাল ছিল।
যার স্লোগানে, উত্তাল রাজধানী। তোলপাড় সংসদ। সেই কানাইয়া কুমারই এবার এ বঙ্গে আসছেন- এমন একটি সংবাদও ছড়িয়েছে। আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে বামদের হয়ে প্রচার করতে তিনি আসছেন। স্বয়ং সিপিএম সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি এ কথা জানিয়েছেন। লড়াকু ছাত্রনেতাই এবার আসছেন বঙ্গে নির্বাচনী প্রচারণায়। যদিও, এই ঘটনাকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে নারাজ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তৃণমূলনেত্রী তাই মন্তব্য করেও বসলেন, যেই আসুক, কোনো কিছু যায় আসে না।
জেএনইউয়ের ক্যাম্পাসে কানাইয়ার ভাষণ বহুবার ঝড় তুলেছে। এ রাজ্যে তার পুনরাবৃত্তি হয় কি না, সেদিকেই তাকিয়ে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অনেকে।
কানাইয়ার গ্রেপ্তার এবং দ্রত জামিন, সব থেকে বেশি অস্বস্তিতে ফেলেছে যাদের, সেই বিজেপি এ নিয়ে অবশ্য কোনো মস্তব্য করেনি।
বিচারপতি প্রতিভা রানীর ডিভিশন বেঞ্চে কানাইয়া কুমারের জামিনের শুনানি শেষ হয়। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, কানাইয়া ও খালিদ ভারতবিরোধী কোনো স্লোগান দিয়েছিলেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়নি। জেএনইউয়ের সমাবেশে মুখ ঢাকা একদল লোক ভারতবিরোধী স্লোগান দিচ্ছিল। ভিডিও ফুটেজে ওমর খালিদ নামের একজনকে স্লোগান দিতে শোনা যায়, ‘কাশ্মীরের মানুষ লড়াই চালিয়ে যাও। আমরা তোমাদের সঙ্গে আছি।’
গ্রেপ্তার হওয়া ছাত্রনেতার কানাইয়ার পক্ষে দাড়াঁন বিশিষ্ট আইনজীবী কংগ্রেস নেতা কপিল সিব্বল। ২৩ পাতার রায়ে বলা হয়েছে, কানাইয়া কুমারের পারিবারিক অবস্থার কথা বিবেচনা করেই তাঁর জামিন মঞ্জুর করা হয়েছে। জামিনে মুক্ত থাকাকালীন তদন্তে সব রকম সহযোগিতা করতে হবে ছাত্রনেতাকে। এ সময় তিনি দেশের বাইরে যেতে পারবেন না। সেইসঙ্গে আরো বলা হয়েছে যে নিজের ক্ষমতা প্রয়োগ করে জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ে সব ধরনের দেশবিরোধী কার্যকলাপ বন্ধ করতে হবে।
গত ৯ ফেব্রুয়ারি জেএনইউয়ে ভারতের পার্লামেন্টে হামলায় অভিযুক্ত আফজাল গুরুর ফাঁসির বার্ষিকী উপলক্ষে মানবাধিকারকর্মীরা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। সেই অনুষ্ঠানে ‘ভারতবিরোধী’ স্লোগান দেওয়ার অভিযোগে গত ১২ ফেব্রুয়ারি কানাইয়া কুমারকে গ্রেপ্তার করে মোদি সরকারের অধীনে থাকা দিল্লি পুলিশ। ৩ মার্চ জেল থেকে বেরিয়ে আসার দিন একেক করে গাড়ি বের হওয়ার সময় শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি সংবাদকর্মী ও পুলিশের উপস্থিতির সাথে দিল্লির অফিস ফেরত মানুষের আগ্রহের চিত্রই বলে দেয় কারাগার থেকে ক্যাম্পাসে ফেরা এ ছাত্রনেতা ফিনিক্স হয়ে আলো ছড়াবে ভারতের আজাদি আন্দোলনে। যা নিয়ে যথেষ্ঠ ভাবার আছে মোদি প্রশাসনের।
লেখক : শিক্ষার্থী, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়