ক্রিকেট
তিন মোড়লের গাদ্দারিতে বীতশ্রদ্ধ ক্রিকেটাঙ্গন
আইসিসিতে ভারতের প্রতিনিধিত্ব নিয়ে বারবার সমালোচনা হয়েছে। সঙ্গে অস্ট্রেলিয়া আর ইংল্যান্ডের ভূমিকাও যথেষ্ট প্রশ্নবিদ্ধ। এই তিন দেশ মিলে ক্রিকেটের যেকোনো সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করার অভিযোগ উঠেছে হরহামেশাই। মূলত এই ত্রি-বলয়ের কাছে অনেকটা জিম্মি হয়ে পড়েছে ভদ্রলোকের খেলা ক্রিকেট। বিগত বছরে অনেক বেশি ক্রিকেট খেলেছে ভারত, তাতে সন্দেহ নেই। অনেক দেশকে তো আবার নিজেদের দেশে খেলার জন্য আমন্ত্রণও জানায় না ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড। যেখানেই সুযোগ, সেখানেই এক পেরেক বসিয়ে দেয় ভারত। আইসিসিকে মুড়িয়ে রেখেছে বিভিন্ন সাজে। আর এতে ফল যা হওয়ার তাই হচ্ছে। অবৈধভাবে হাতিয়ে নিচ্ছে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা। আইসিসির মোড়কে ক্রিকেটে সর্বশেষ যে পেরেকটি বসেছে, সেটা বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের ঘাড়ে।
একেবারেই আচমকা টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশ-নেদারল্যান্ডস ম্যাচে অবৈধ বোলিং অ্যাকশনের দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছে বাংলাদেশ দলের দুই খেলোয়াড়কে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, তাসকিন আহমেদ ও স্পিনার আরাফাত সানির বিরুদ্ধে যে দুজন আম্পায়ায় অভিযোগ তুলেছেন, তারা বিগত বছরে বংলাদেশের ম্যাচ পরিচালনা করলেও আগে কোনো অভিযোগ আনেননি। হঠাৎ করে ভারতের মাটিতে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে এ ধরনের অভিযোগ তোলায় সন্দেহের চোখে দেখছেন অনেকে। কারণ, গত বিশ্বকাপের কাঁচা ঘা যে এখনো শুকায়নি বাংলাদেশের অগণিত ক্রিকেটভক্তের মাঝে। অনেকটা জোর করেই সেদিন কোয়ার্টার ফাইনালে বাংলাদেশকে হারায় ভারত। পক্ষপাতমূলক আম্পায়ারিংয়ের অভিযোগ উঠেছিল।
ম্যাচটি নিয়ে পুরো ক্রিকেটবিশ্বে তোলপাড় হয়েছিল। পাকিস্তানি আম্পায়ার আলিম দার ও ইংলিশ আম্পায়ার ইয়ান গুল্ডের বিতর্কিত কিছু সিদ্ধান্তে সেই ম্যাচে বাংলাদেশ হারে। এটা নিয়ে জল গড়াতে গড়াতে এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে তৎকালীন আইসিসির প্রেসিডেন্ট আ হ ম মুস্তফা কামাল বিশ্বকাপের ফাইনালে পুরস্কার পর্যন্ত দিতে যেতে পারেননি। এ ঘটনার পর তিনি আইসিসির প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরে আসেন।
তাসকিন-সানির ব্যাপারে ভারতের আম্পায়ার সুন্দরম রবি ও অস্ট্রেলিয়ার রড টাকার ম্যাচ রেফারির কাছে অভিযোগ করার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঝড় ওঠে। এ বিষয়ে স্বয়ং বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের কোচ হাথুরুসিংহে ক্ষোভ করেছেন।
এর আগে বাংলাদেশের সোহাগ গাজী আর আল-আমিনের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ করা হয়েছিল। আল-আমিন আবার দলে ফিরলেও সোহাগ আজো বাংলাদেশ দলে ফিরতে পারেননি। আর পারবেন কি না, সেটা নিয়েও সংশয় আছে। বোলিংয়ে সমস্যা এখানে মুখ্য নয়। মনোবলটা ভেঙে দেওয়ার জন্য এমনটি করা হচ্ছে, যেটা ক্রিকেটের সংস্কৃতিকে কলুষিত করছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, গত বছরে মোট ছয়জন প্লেয়ারের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ আনা হয়। তাঁদের মধ্যে আছেন পাকিস্তানের সাঈদ আজমল ও সুনিল নারিনের মতো প্রতিভাধর প্লেয়ারের নাম। তালিকায় আর যাঁরা ছিলেন হাফিজ, সেনানায়েক, হোল্ডার, উতসেয়া এঁদের সবাই সে সময় বেশ ভালো ফর্মে ছিলেন। বাংলাদেশ দলের দিকে তাকালেও ওই একই চিত্র ভেসে উঠবে। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে বাংলাদেশ কি কোনো ষড়যন্ত্রের শিকার হতে চলেছে?
অতি সম্প্রতি এশিয়া কাপে ভারতের ঘাড়ের ওপর নিশ্বাস ফেলার ফসল কি এটা? রড টাকার তো বেশ কিছুদিন ধরে নিয়মিতই বাংলাদেশের ম্যাচ পরিচালনা করছেন। কই, ভারতের মাটিতে যাওয়ার আগে এ নিয়ে কোনো কথা তো আগে বলেননি তিনি? তাহলে, কলকাঠি নাড়ছে কে? ভারতীয় ক্রিকেটে ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসিটা বেশ পরিচিত। নিজ দলের সৌরভ-দ্রাবিড়ের মতো তারকারা পাত্তা পায়নি শেষ পর্যন্ত আর বিদেশিদের উত্থান তো প্রশ্ন ওঠে না! তাসকিন এশিয়া কাপের ফাইনালে চাপের মধ্যে ভারতীয় ব্যাটিং লাইনআপের বিরুদ্ধে যে বল করল, তা এককথায় অসাধারণ।
এটা নজরে পড়তে পারে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের। আর সেই ইঙ্গিত গিয়ে পড়ল কি না বোলিং অ্যাকশনে? সানির বোলিং অ্যাকশন নিয়ে দ্বিধা থাকতে পারে। কিন্তু তাসকিন যে সহজে উতরে যাবে, এটা নিয়ে কোচসহ দলের অন্যরা বেশ আশাবাদী। আমাদের তাসকিন-সানির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে ভারতের অশ্বিন ও বুমারার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নয় কেন হে আইসিসি? এমন প্রশ্ন বাংলাদেশের হাজারও ক্রিকেটভক্তের। যে ক্রিকেট তেমন বোঝে না, ফুটেজ দেখিয়ে তাকেও যদি প্রশ্ন করা হয় কার অ্যাকশন কেমন? নিঃসন্দেহে বলবে অশ্বিন-বুমারারটা পরীক্ষার প্রয়োজন আছে। কোনো আম্পায়ার কি তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলবে? সময়ই সেটা বলে দেবে।
এরই মধ্যে সানিকে পাঠানো হয়েছে চেন্নায়ের শ্রী রামচন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে। সেখানে হবে তাঁর অ্যাকশনের পরীক্ষা। তাসকিনকেও পর্যায়ক্রমে পাঠানো হবে এই বায়োমেকানিক পরীক্ষা দিতে। এ সময় তাঁদের প্রয়োজন সমর্থন। আইসিসিরই নানা নিয়মের বেড়াজালে আবদ্ধ ক্রিকেটারদের কিছু করা বা বলার সুযোগ নেই। তবে সর্বশেষ আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচটি দলের দুই সতীর্থ তাসকিন আর সানিকে উৎসর্গ করেই খেলতে নেমেছিল বাংলাদেশ দল।
আইসিসির তিন মোড়লের এই গাদ্দারি যে শুধু বাংলাদেশের বিপক্ষে করা হয়, তা নয়। আইসিসির অন্যান্য ছোট দেশও বেশ বিরক্ত এসব নিয়ে। নেদারল্যান্ডসের অধিনায়ক পিটার বোরেন বেশ অভিমান করেই সেদিন বললেন, আইসিসি সহযোগী দেশগুলোর জন্য যথেষ্ট কাজ করছে না। সত্যি কথা বলতে, এখানে শুধু টাকার খেলাই চলে। যাদের টাকা বেশি, তারাই সবচেয়ে বেশি খেলার সুযোগ পায়।
এসব কথা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, ক্রিকেটের বাণিজ্যিক সম্প্রসারণে ভারত, ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া যে অতিরিক্ত সুবিধা আদায় করে চলেছে, তা ওপেন সিক্রেট। এ ক্ষেত্রে ভারতীয়দের আধিপত্য অনেক বেশি। কারণম ক্রিকেটীয় বিজ্ঞাপনের সবচেয়ে বড় অংশটা আসে ভারতীয় বাজার থেকে। এ জন্য আইসিসি চাইলেও এ বলয় থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে না। কারণ, তখন ক্রিকেটে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা কামানো সম্ভব হবে না আইসিসির পক্ষে। সবকিছু ছাপিয়ে ক্রিকেটীয় আইনের প্রতি সম্মান দেখানোর দায়িত্ব ক্রিকেট-সংশ্লিষ্ট সবার। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে, অশ্বিন-বুমারার মতো বিতর্কিত বোলিং অ্যাকশনের ফাঁকফোকর কিংবা ভারতে ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় জুয়ার বাজার থেকে ক্রিকেট যেন মুক্ত থাকে।
লেখক : সাংবাদিক