আন্তর্জাতিক
ক্ষমতার সমীকরণ ও বারাক ওবামার সৌদি সফর
আজও যেসব দেশে সম্রাট-রাজা-বাদশাহ-আমির-ওমরাহরা রাজত্ব করেন এবং শাসন করেন, তাঁদের নির্ভরতা ক্ষমতার বিবিধ সমীকরণভিত্তিক। সেখানে ক্ষমতার উৎস জনগণ নয়। ‘জোর যার মুল্লুক তার’ আজও এসব রাষ্ট্রে অনুসৃত নীতি। বংশ, গোত্র এবং সামরিক শক্তিই ক্ষমতার উৎস। সেখানে জনগণের সম্মতির প্রয়োজন নেই। নির্বাচনব্যবস্থা নেই। জবাবদিহিতার অবকাশ নেই। এমনি একটি রাজতন্ত্র হচ্ছে সৌদি আরব। ইসলামের ইতিহাসের এক ক্ষয়িষ্ণু সময়ে এই বংশের আদিপুরুষ মোহাম্মদ ইবনে সৌদ ১৭৪৫ সালে ইসলামী পুনর্জাগরণের নেতা আবদুল ওহাবের সহযোগিতায় সৌদি রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। এ সময়ে আবদুল ওহাব ছিলেন এ রাজবংশের আধ্যাত্মিক নেতা। প্রথম মহাযুদ্ধের পর উসমানীয় সালতানাত (Ottoman Empire)-এর ধ্বংসস্তূপের মধ্যদিয়ে ব্রিটিশ সহযোগিতায় ১৯৩২ সালে সৌদি আরব আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করে।
মক্কা ও মদিনা দখলে এলে ইসলামী বিশ্বে তাদের সম্মান ও মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। শুধুমাত্র হজ ব্রতের ওপর নির্ভরশীল দরিদ্র সৌদি আরব ১৯৩৩ সালে তেল আবিষ্কৃত হলে সৌভাগ্যের সন্ধান পায়। তেলের কারণে সৌদি আরবের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গঢ়ে ওঠে। ১৯৭৭ সালে সৌদি বাদশাহ ফয়সালের নেতৃত্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তথা পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে তেল অবরোধ ঘোষিত হয়। ওপেক সিদ্ধান্ত নেয় যে, ইসরাইলের প্রতি পাশ্চাত্যের তোষণ নীতির পরির্বতন না হলে তাদের তেল সরবারহ করা হবে না। এতে গোটা পাশ্চাত্য চরম জ্বালানি সংকটের সম্মুখীন হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সৌদি তেলক্ষেত্র জবর দখলের সিদ্ধান্ত নেয়। প্রবল চাপের মুখে ওপেক সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে বাধ্য হয়। এর কয়েক মাস পরেই বাদশাহ ফয়সালকে হত্যা করা হয়। এ হত্যাকাণ্ডের জন্য ইসরাইলি গুপ্তচর সংস্থা মোসাদকে দায়ী করা হয়। অবশ্য তারা এ দায় অস্বীকার করে। বাদশাহ ফয়সালের মৃত্যুর পর মার্কিন সৌদি সম্পর্ক আরো খোলামেলা এবং ঘনিষ্ঠতর হয়ে ওঠে। ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামী বিপ্লব অনুষ্ঠিত হলে সৌদি আরব তাদের ক্ষমতার প্রতি হুমকি অনুভব করে। এ সময় এবং আরো একবার ১৯৯০ সালে সাদ্দাম হোসেন কর্তৃক কুয়েত দখল হলে সৌদি রাজ্যতন্ত্র এর নিরাপত্তা এবং স্থায়িত্বের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। পরবর্তীকালে মার্কিন সৌদি মধুর সম্পর্কে টানাপড়েন শুরু হয়।
এই টানাপড়েনের কারণ প্রধানত দুটি। প্রথমত, ইরানের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তথা পাশ্চাত্যের পারমাণবিক চুক্তি। এ চুক্তির ফলে ইরানের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৪০ বছরের বৈরিতার অবসান ঘটে। ইরান বিপ্লবের পর ইরান-মার্কিন কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। এই বৈরিতার বছরগুলোতে-ইরানকে সরাসরি আক্রমণের হুমকি দেওয়া হয়। পাশ্চাত্যের প্ররোচনায় ইরাক ইরান আক্রমণ করে। আট বছরব্যাপী যুদ্ধে উভয় রাষ্ট্র ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ইরানের বিরুদ্ধে কঠোরতর আন্তর্জাতিক অবরোধ আরোপ করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত ইরানের যাবতীয় সম্পদ আটক করা হয়। পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে উত্থিত বিতর্ক চরমে পৌঁছায়। ইরান দাবি করছিল শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক উন্নয়নের জন্য কাজ করছে তারা।
অপরদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্য অভিযোগ করছিল- ইরান পারমাণবিক বোমা তৈরির লক্ষ্যে কাজ করছে। ইরান আক্রমণ সহজ নয় ভেবে মার্কিন মিত্ররা কূটনৈতিক সমাধানের পথ বেছে নেয়। দীর্ঘ জটিল কুটিল কূটনৈতিক দৌড়-ঝাপ শেষে এ বছরের ১৭ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক সম্পদায়ের সমর্থনে সমঝোতা চুক্তি কার্যকর হয়। এ চুক্তি Joint Comprehensive Plan of Action –JCPOA বলে পরিচিত। প্রথম থেকেই সৌদি আরব ও তার মিত্ররা এই সমঝোতা চুক্তির প্রবল বিরোধিতা করে আসছিল। সৌদি ও তার মিত্র উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদ (Gulf Cooperation Council-GCC) যুক্তি প্রদান করে যে ইরানকে নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্য ইরানের অনুকূলে চলে যাবে। আরব মিত্র রাষ্ট্রগুলো রাজনৈতিক হুমকির সম্মুখীন হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয় সংকটে পড়ে। ইরানকে পারমাণবিক কর্মসূচি থেকে নিবৃত্ত রাখা অধিকতর প্রয়োজনীয় মনে হয়।
অপরদিকে ওবামা প্রশাসন মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলোতে সরাসরি সম্পর্ক নির্ণয়ের পরিবর্তে পরোক্ষভাবে প্রতিটি দেশকে পৃথক পৃথকভাবে ক্ষমতায়নের সিদ্ধান্ত নেয়। বিশেষত সামরিক নির্ভরতা হ্রাস পেলে মার্কিন মিত্র রাষ্ট্রগুলো নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। সৌদি আরব বিকল্পের সন্ধানে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক স্বীকার করার উদ্যোগ নেয়। নিরাপত্তা জোরদার করার লক্ষ্যে শক্তিশালী মুসলিম দেশগুলো নিয়ে একটি আধাসামরিক জোট গঠনের চেষ্টা চালায়। সৌদি আরবের সঙ্গে টানাপড়েন সম্পর্ক মেরামত করার লক্ষ্যে সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এক ফোনেই বাংলাদেশ এই জোটে যোগ দিতে তাৎক্ষণিকভাবে রাজি হয়ে যায়। পরে অবশ্য জোটের পরিবর্তে নিরাপত্তা কেন্দ্রের ( Security Center) কথা শোনা যায়।
সম্পর্ক অবনতির দ্বিতীয় কারণটি হলো সৌদি আরবকে ৯/১১ ঘটনার জন্য দায়ী করে কংগ্রেসে উত্থিত ক্ষতিপূরণ বিল। টুইন টাওয়ার ঘটনার জন্য গঠিত কমিটি অবশেষে রাষ্ট্র হিসেবে সৌদি আরবকে দায়ী করে। উল্লেখ্য যে, ওই ঘটনায় অভিযুক্ত ১৯ জনের মধ্যে ১৫ জনই ছিল সৌদি নাগরিক। নিহত পরিবারগুলোকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রয়াস নেওয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে কংগ্রেসে উত্থাপিত হতে যাচ্ছে যে বিল তার শিরোনাম- Justice Against Sponsor of Terrism Act এ বিল কার্যকর হলে ক্ষতিগ্রস্তরা সৌদি সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারবে। আর সৌদিদের গুনতে হবে কোটি কোটি ডলার। এ বিলে ডেমোক্র্যাট এবং রিপাবলিকান উভয় দলের সমর্থন রয়েছে। সৌদি আরব বারবার মার্কিন প্রশাসনকে দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছে – রাষ্ট্র বা সরকারের এ ঘটনায় কোনো সম্পৃক্ততা নেই। কিন্তু সরকার বা জনগণ তা বিশ্বাস করে না। এমনিতেই মুসলিম বিদ্বেষের একটি লু হাওয়া পাশ্চাত্যের সর্বত্র বিরাজমান। ৭০ ভাগ মার্কিন নাগরিক মনে করে এ ঘটনায় সৌদি আরব জড়িত ছিল।
অপরদিকে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প যে মুসলিমবিরোধী বিদ্বেষ ছড়াচ্ছেন, তা পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলছে। সৌদি আরব এ বিল উত্থাপনে মহা ক্ষিপ্ত হয়েছে। তারা হুমকি দিয়েছে আমেরিকার গচ্ছিত ৭৫০ বিলিয়ন ডলার বিল তারা বিক্রি করে দেবে। সাম্প্রতিক সময়ে অর্থনৈতিক মন্দাগ্রস্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এতে হতাশ হওয়ার কথা বৈকি! অবশ্য আইনবিদরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে এ ধরনের ক্ষতিপূরণ আদায়ের চেষ্টা আন্তর্জাতিক আইন অনুমোদন করে না। বরং হিতে বিপরীত হতে পারে। একই আইন বলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত রাষ্ট্রসমূহ মামলা দায়ের করতে পারে।
এই পরিস্থিতিতে সম্পর্ক মেরামতের চেষ্টায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা বিগত ২০-২১ এপ্রিল দুদিনের জন্য সৌদি আরব সফর করেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, বারাক ওবামা এ ক্ষেত্রে কোনো কেরামতি দেখাতে পারেননি। প্রেসিডেন্ট ওবামা দুটো পর্যায়ে বৈঠক করেন। সৌদি বাদশাহ সালমানের সঙ্গে একান্ত বৈঠক করেন। এরপর তিনি উপসাগরীয় নেতাদের সঙ্গে সমন্বিত বৈঠক করেন। প্রেসিডেন্ট ওবামা আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের প্রতিশ্রুতি দেন। এসব প্রতিশ্রুতির মধ্যে রয়েছে : ক) প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন, খ) সামরিক প্রস্তুতি, গ) গুরুত্বপূর্ণ সামরিক সক্ষমতা বিনিময় ইত্যাদি। মজার বিষয়, বৈঠক শেষে প্রকাশিত ঘোষণায় ইরানের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তিকে সমর্থন জানানো হয়। যদিও মনে করা হচ্ছে, এই লৌকিকতার বাইরে তাদের মনোভাব আগের মতোই রয়েছে। প্রেসিডেন্ট ওবামা সৌদি আরব এবং তাঁর মিত্রদের সমর্থনে : ১. ইসলামিক স্টেট তথা আইএসের বিরুদ্ধে মার্কিন সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেন, ২. ইয়েমেনে সংঘাত অবসানের আহ্বান জানান, ৩. সিরীয় সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের আহ্বান জানান।
প্রেসিডেন্ট ওবামার সৌদি আরব সফরের মধ্য দিয়ে সম্পর্ক পুনর্নির্মাণে সম্পূর্ণ সফলতা না এলেও নিঃসন্দেহে উত্তেজনা প্রশমিত হয়েছে। সৌদি রাজতন্ত্র এবং উপসাগরীয় নেতাদের সঙ্গে মার্কিন সম্পর্ক ক্ষমতানির্ভর। শুধুমাত্র ক্ষমতাকে নিশ্চিত, নিশ্ছিদ্র এবং নিষ্কণ্টক করার জন্য এই দৌড়ঝাপ কূটনীতি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও তার স্থায়ী স্বার্থ নিশ্চিত করবার জন্য এদের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখবে। পররাষ্ট্রনীতির নিয়মানুযায়ী সম্পর্ক হবে –রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের, জনগণের সঙ্গে জনগণের, ব্যক্তি বা বংশের সঙ্গে নয়। সে ক্ষেত্রে জনতুষ্ট সম্পর্ক সুদূর পরাহত। সৌদি আরবের উচিত সাত সমুদ্র তের নদী পেরিয়ে আমেরিকা বা ইউরোপের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে দেশের জনগণ এবং ভ্রাতৃপ্রতিম পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর ওপর নির্ভরশীল হওয়া। মুসলিম বিশ্বের জনগণ আশা করে -চিরাচরিত শত্রুতা ভুলে ইরান এবং সৌদি আরব এক কাতারে দাঁড়াবে। মুসলিম বিশ্বের এই ক্রান্তিকালে ঐক্য আকাঙ্ক্ষিত, আবশ্যকীয় এবং অবধারিত। গোটা মুসলিম উম্মাহর উদ্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য ক্ষমতার সমীকরণ নয়, জনতার সমীকরণ প্রয়োজন।
লেখক : অধ্যাপক সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।