স্মরণ
বিপ্লবের ধ্রুবতারা চে গেভারা
নয়টি গুলি বিঁধে ছিল তার বুকে। শরীরকে বিদ্ধ করে ফেলা বুলেটের ক্ষত চিহ্নের পথ ধরে নেমে এলো রক্ত স্রোত...। এক আমৃত্যু বিপ্লবী মারা গেল। শোষণের ঘরে যিনি ছিলেন এক মহাতঙ্ক।
মানুষটি মরে যাওয়ার আগে বন্দি অবস্থায় হ্যান্ডক্যাফ পরিহিত হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বলেছিলেন- ‘আমি জানি তোমরা আমাকে মারতে এসেছ। কাপুরুষ গুলি করো। তোমরা একজন মানুষকে হত্যা করছ মাত্র। বিপ্লবের মৃত্যু নেই।’
যাকে হত্যা করা হচ্ছে তার দেহটিই মারা যাচ্ছে মাত্র। কিন্তু যে আদর্শের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দিলে তার মৃত্যু নেই। শেষ পর্যন্ত অমোঘ এই বাণী শুনে কেপে ওঠে মদ্যপ সৈনিকটি। চোখ বন্ধ করে গুলি করে। প্রথম গুলিটি লাগে হাতে। তারপর এলোপাতাড়ি গুলি তার শরীরকে বিদ্ধ করে ফেলে...। বুক থেকে যে রক্ত ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর এই জমিনে সেই রক্ত হাজার হাজার মুক্তিকামী সেনা তৈরি করে দিল। যাদের প্রত্যেকের হৃদয়ে ধ্রবতারা হয়ে জ্বলজ্বল করে জ্বলছে একটি নাম আর্নেস্তো চে গেভারা ।
হ্যাঁ উপরের রূপকথার মতো সত্যটির জনকের নাম চে গেভারা । আর্জেন্টাইন এই মানুষটি দেশ-কাল-গণ্ডির সীমানা পেরুনো এক বিপ্লবী মহাপুরুষ। ১৯৬৭ সালের ৯ অক্টোবর বলিভিয়ায় নিরস্ত্র অবস্থায় নয়টি গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল বন্দি চে গেভারাকে ।
১৯২৮ সালের ১৪ জুন আর্জেন্টিনায় জন্ম গ্রহণ করেন চে গেভারা । তাঁর প্রকৃত নাম আর্নেস্তো গুয়েভারা দেলা সের্না । সারা বিশ্বে তিনি চে গেভারা নামেই পরিচিত। তিনি ছিলেন একজন আর্জেন্টিনীয় তাত্ত্বিক মার্ক্সবাদী ও বিপ্লবী, লেখক, চিত্রগ্রাহক, বুদ্ধিজীবী, গেরিলা নেতা, কূটনীতিক, সামরিক তত্ত্ববিদ ও কিউবার এবং পরবর্তী সময়ে সমগ্র ল্যাটিন আমেরিকার বিপ্লবের প্রধান ব্যক্তিত্ব।
তরুণ বয়সে চিকিৎসা বিজ্ঞানে পড়ার সময় চে দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চল ভ্রমণ করেন। সেখানে দেখতে পান মানুষে মানুষে কী বৈষম্য। শোষণ-পীড়নের যাঁতাকলে মানুষ কত অসহায়। যা তাকে অসহায় মানুষের দুঃখ কষ্ট অনুধাবন করার সুযোগ এনে দেয়। চে বুঝতে পারেন ধনী-গরিবের এই ব্যবধান ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য বিপ্লব ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
বিপ্লব অনিবার্য—এই বোধে পৌঁছাতে চে দীক্ষা নিয়েছিলেন মার্ক্সবাদে। গুয়াতেমালায় গিয়ে টিকে থাকার ব্যর্থ চেষ্টার পর চলে গিয়েছিলেন মেক্সিকোয়, নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। সেখানেও একই দৃশ্য। লাতিন আমেরিকাজুড়ে চলমান সিআইএর হিংস্র তাণ্ডবলীলা। সবখানেই শ্রেণি-বৈষম্য আর শ্রেণিশোষণ। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসন। চে বিপ্লবের জন্য অস্থির হয়ে ওঠেন। মুক্তি চাই তাঁর এই শোষণের নরক থেকে।
১৯৫৫ সালের জুলাইয়ে ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে দেখা হলো তাঁর। কাস্ত্রো তখন কিউবার স্বৈরশাসক বাতিস্তার বিরুদ্ধে লড়ছেন। তাঁর গেরিলা দলে যোগ দিলেন চে। ১৯৫৬ সালের ২৫ নভেম্বর কিউবার উদ্দেশে যাত্রা করে কাস্ত্রোর গেরিলা দলের যুদ্ধজাহাজ গ্র্যানমা। ১৯৫৭ সালে কাস্ত্রোর গেরিলা বাহিনীর কমান্ডার নির্বাচিত হলেন। ১৯৫৮ সালের ডিসেম্বরের শেষ দিকে সান্তা ক্লারার যুদ্ধে তাঁর সফল নেতৃত্ব যুদ্ধের নিয়তি নির্ধারণ করে দিল। কিউবার স্বৈরশাসক বাতিস্তা সদলবলে পালালেন কিউবা ছেড়ে। বিপ্লব হলো কিউবায়।
১৯৬১ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত চে কিউবার শিল্পবিষয়ক মন্ত্রী ছিলেন। এ সময় তিনি কিউবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় কিউবান নোটগুলোতে তাঁর স্বাক্ষরে শুধু ‘চে’ লেখা থাকত।
১৯৬৫ সালে চে আবার বিপ্লবের ময়দানে ঝাপিয়ে পড়েন। আফ্রিকায় নিষ্পেষিত মানুষের জন্য লড়াই করার জন্য অস্ত্র তুলে নেন হাতে। তার ইচ্ছা ছিল কঙ্গো-কিনশাসা ও বলিভিয়াতে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা এবং সেখানকার মানুষের মুক্তি। বলিভিয়াতে বিপ্লব করতে গিয়ে ১৯৬৭ সালের ৭ অক্টোবর তিনি সিআইএ মদদপুষ্ট বলিভিয়ান বাহিনীর কাছে ধরা পড়েন। এরপর তাঁকে হত্যা করা হয়।
কিন্তু আদর্শের মৃত্য হয় না। চে গেভারা মুক্তির যে মহামন্ত্রধ্বনি উচ্চারণ করেছিলেন, তা আজও দেশে দেশে দুঃশাসনের অন্ধকারে ধ্রুবতারা হয়ে জ্বলছে। মুক্তির লড়াইয়ে যে হয়ে ওঠেন প্রেরণা শক্তির একটি নাম। চে গেভারা বলতেন, ‘আসতা লা ভিকতোরিয়া সিয়েম্প্রে’। বিজয় না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাও। তিনি আরো বলেছেন, ‘তুমি যদি প্রতিটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে জ্বলে ওঠ তাহলে তুমি আমার একজন সহযোদ্ধা।’
চের প্রতিকৃতি আজ হয়ে উঠেছে মুক্তিকামী মানুষের প্রেরণা। চে’র ছবি হয়ে উঠেছে যেন মুক্তির মিথ। কবিতায় গল্পে গানে স্লোগানে চে বেঁচে আছেন সারা বিশ্বে। বাংলা সাহিত্যেও চে গেভারাকে নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে গান, কবিতা, নাটক, গল্প।
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কালজয়ী কবিতা চে গেভারার সেই লড়াইকে শ্রদ্ধা জানিয়ে লিখেছিলেন-
‘চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়
আমার ঠোঁট শুকনো হয়ে আসে, বুকের ভেতরটা ফাঁকা
আত্মায় অভিশ্রান্ত বৃষ্টিপতনের শব্দ
শৈশব থেকে বিষণ্ন দীর্ঘশ্বাস
চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরধী করে দেয়’