যুক্তরাজ্যের নির্বাচন
জয় পরাজয়ের খতিয়ান
ব্রিটিশ রাজতন্ত্রে তথা যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচন এখনো বৈশ্বিক বিবেচনায় তাৎপর্যপূর্ণ। ক্ষয়িষ্ণু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের প্রতিভূ ইংল্যান্ডের এই নির্বাচন জাতিসংঘের কার্যব্যবস্থা এবং ন্যাটো প্রতিরক্ষা জোটে কি প্রভাব ফেলে তা দেখার জন্য উম্মুখ সারা বিশ্ব। হাউজ অব কমনস্ নামে কথিত ব্রিটিশ পার্লামেন্টের এই সাধারণ নির্বাচনই ব্রিটিশ জনগণের ভাগ্য নিয়ামক। দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্টের উচ্চ পরিষদের নাম : হাউজ অব লর্ডস। এই উচ্চ পরিষদ মনোনীত। আর নিম্ন পরিষদের নাম : হাউজ অব কমনস্ । এটি আমাদের জাতীয় সংসদের মতো নির্বাচিত। ইতিহাসের অনেক চড়াই উৎড়াই পেরিয়ে হাউজ অব কমনস এখন ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের মূল ক্ষমতার মালিক-মোখতার। বস্তুত হাউজ অব কমনসই সার্বভৌমত্বের প্রায়োগিক প্রতিষ্ঠান।
সংসদীয় শাসন ব্যবস্থার সূতিগাকার বলে অভিহিত যুক্তরাজ্যে নির্বাচন ব্যবস্থা সংবিধান দ্বারা সুনিশ্চিত। প্রতি পাঁচ বছর পরপর একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠান অবধারিত। গত শুক্রবার, ৭ মে ২০১৫ তারিখে অনুষ্ঠিত নির্বাচনটি ছিল সেই ধারাবাহিকতারই অনুশীলন। ব্রিটিশ বাউন্ডারি কমিশন কর্তৃক নির্বাচনী এলাকার হ্রাসবৃদ্ধি ঘটলেও হাউজ অব কমনসের সদস্য সংখ্যা মোটামুটি ৬৫০। একই সাথে কয়েকটি অঞ্চলে স্থানীয় পরিষদের নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হয়। মূলত এ নির্বাচন যুক্তরাজ্যের চারটি রাজ্য-ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, ওয়েলস এবং নর্দান আয়ারল্যান্ডে একসাথে অনুষ্ঠিত হয়। আশংকা করা হচ্ছিল- নির্বাচনটি প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে। জয় পরাজয় নির্ধারণ কঠিন হবে। কিন্তু না সহজেই জয় পেয়েছে ক্ষমতাসীন রক্ষণশীল দল। নির্বাচনের মাঝ পথে স্কটিশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি (এসএনপি), লেবার পার্টির পরাজয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এমনিতেই স্কটল্যান্ড ঐতিহ্যগতভাবে লেবার পার্টির ঘাঁটি ছিল। কিন্তু এবার স্বাধীনতাকামী এসএনপি প্রায় সবকটি সিট দখল করে নেয়। সর্বশেষ প্রাপ্ত সংবাদ অনুযায়ী এক নজরে নির্বাচনী ফলাফল এরূপ :
কনজারভেটিভ পার্টি-৩৩১, লেবার পার্টি-২৩২, এসএনপি-৫৬, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি)-৮, ডেমোক্রেটিক ইউনিয়নিস্ট পার্টি (ডিইউপি)-৮, গ্রিন পার্টি-১, অন্যান্য-১৪; মোট-৬৫০।
জয় পরাজয়ের কারণ হিসেবে বলা যায় ব্রিটিশ জাতি সবসময়ই রক্ষণশীল। কনজারভেটিভ নেতা প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন পাঁচ বছর ধরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, আন্তজার্তিক রাজনীতিতে ভারসাম্যপূর্ণ নীতি এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকার ব্যাপারে রক্ষণশীল ভূমিকা পালন করছিলেন। বিগত বছরগুলোতে যুক্তরাজ্যের নির্ভরশীল মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ক্যামেরন সতর্কতামূলক ভূমিকা পালন করে আসছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র চায় আরো আগ্রাসী ব্রিটিশ ভূমিকা । ব্রিটিশ জনগণ ওই আগ্রাসী ভূমিকা চায় না। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং রাজনৈতিক স্থীতিশীলতা ক্যামেরন প্রশাসনের অনুসৃত নীতি হওয়ায় নাগরিক সাধারণ তাদের নীতিভঙ্গির প্রতি আস্থা অব্যাহত রেখেছে। যুক্তরাজ্যের বৈশ্বিক মর্যাদার সাথে আরেক সম্ভাব্য ইস্যু হচ্ছে বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম এই অর্থনীতির দেশটির ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকা না থাকা। ব্রিটিশ ডলারের সংহত অবস্থান এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর নাগরিকদের ধীরে ধীরে ব্রিটেনে অবাধ আগমন-এ দুটো বিষয়ের বিবেচনা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তাঁরা জয়ী হলে ২০১৭ সালের মধ্যে ব্রিটেন ইইউই ছাড়বে কি না, সে প্রশ্নে গণভোট দেবেন। মনে করা হয় অধিকাংশ ব্রিটিশ জনগণ এই মুহূর্তে ইইউ ছাড়ার পক্ষপাতি না হলেও দীর্ঘ মেয়াদে তারা তাদের স্বাতন্ত্রের এবং আধিপত্যের পক্ষে ঝুঁকে আছে। নির্বাচনী ফলাফল এর প্রমাণ। অন্য আরেকটি বিষয় নির্বাচনী ফলাফলকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে- সেটি হলো স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতা। এসএনপি নেতা নিকোলা স্টার্জিওন চূড়ান্ত নির্বাচনী প্রচার অভিযানের সময় ইঙ্গিত দিয়েছিলেন- ‘এবারের নির্বাচনে স্কটিশরা তাদের ঐতিহ্যবাহী পছন্দ লেবার পার্টিকে পরিত্যাগ করে সন্ধিক্ষণের সূচনা করতে পারে।’ কয়েক প্রজম্ম ধরে লেবার পার্টিই স্কটিশদের প্রতিনিধিত্ব করেছে। কিন্তু এবার লেবার পার্টিকে বর্জন করে খোদ যুক্তরাজ্যের কেন্দ্রীয় কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করেছে তারা। স্মরণ করা যেতে পারে যে, গত সেপ্টেম্বরে স্বাধীনতা প্রশ্নে অনুষ্ঠিত গণভোটে স্বাধীনতার পক্ষ, সামান্য ব্যবধানে হেরে যায়। এবারের নির্বাচনে এসএনপি ৫৯ টি স্কটিশ অসনের মধ্যে ৫৬ টিতে জয় লাভ করেছে। ২০১০ সালের নির্বাচনে এরা মাত্র ছয়টি আসন পেয়েছিল। লেবার পার্টি ওই বার পেয়েছিল ৪১টি আসন। তাহলে বোঝা যাচ্ছে স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার দাবি ধীরে ধীরে অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠছে। এর বিপরীতে শক্ত অবস্থানে রয়েছে জয়লাভকারী কনজারভেটিভ পার্টি। ব্রিটেনের অন্যান্য অঞ্চলের জনগণ নিশ্চয়ই খণ্ডিত ব্রিটেন দেখতে চায় না। এ বিষয়টিও কনজারভেটিবদের ভোট বৃদ্ধির কারণ হয়েছে হয়তো। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হচ্ছে লেবার পার্টির স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতাবিরোধী অবস্থান। তারা স্কটিশদের স্বাধীনতাবাদে আর সবকিছু দিতেই রাজি। তারা ক্ষমতাসীন হওয়ার সম্ভাবনা হারিয়েছে। কিন্তু দেশপ্রেম বির্সজন দেয়নি। গ্রেট ব্রিটেন নিয়মাতন্ত্রিক রাজনীতির মাধ্যমে এ ধরনের বিচ্ছিন্নতাবাদ ধারণ, সংরক্ষণ ও সংশোধনের ক্ষমতা রাখে।
অন্যদিকে এই নির্বাচনে আর একটি চমক তিন বাংলাদেশ বংশোদ্ভূত নারীর জয়লাভ। বিশ্ব সভায় বাংলাদেশের মানুষরা যে বিশেষ ভুমিকা পালনে সক্ষম- এ বিজয়ের মাধ্যমে তা আবারও প্রমাণিত হলো। এরা হলেন- শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক, সিলেটি মেয়ে রুশনারা আলী এবং পাবনার মেয়ে রূপা হক।
‘ব্রিটেনে রাজা বা রানী রাজত্ব করেন, শাসন করেন না।’ শাসন করে হাউজ অব কমনসে বিজয়ী, সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দল। সুতরাং রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ যথারীতি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী কনজারভেটিব পার্টিপ্রধানকে শিগগিরই মন্ত্রিসভা গঠনের আমন্ত্রণ জানাবেন। কারণ গৃহীত নির্বাচনে কনজারভেটিভ পার্টি মন্ত্রিসভা গঠনের জন্য ন্যূনতম ৩২৬ আসনের বেশি অর্থাৎ ৩৩১ টি আসন পেয়েছে। ২০১০ সালের নির্বাচনে তারা একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সাথে কোয়ালিশন সরকার গঠন করে। এবার তারা আট আসন পেয়েছে। রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে এলডিপিকে সাথে রাখলে ক্যামেরন বুদ্ধিমানের কাজ করবেন। তবে সবকিছু নির্ভর করে দলীয় নীতি কৌশলের ওপর। ব্রিটিশ সংসদীয় গণতন্ত্রের চিরাচরিত ঐতিহ্য অনুযায়ী বিরোধী লেবার পার্টি প্রধান এড মিলিব্যান্ড পরাজয় মেনে নিয়েছেন। শুধু তাই নয় পরাজয় দায়িত্ব স্বীকার করে পদত্যাগ করেছেন, যা আমাদের দেশে অকল্পনীয়। ‘গণতন্ত্রের দোলনা’ বলে কথিত হাজার বছর ধরে অনুসৃত আনুষ্ঠানিকতার একটুও হেরফের হওয়ার সুযোগ নেই। আগত ১৮ মে আনুষ্ঠানিকভাবে হাউজ অব কমনসের অধিবেশন বসবে। রানী এলিজাবেথ ২৭ মে পার্লামেন্টে তার ঐতিহ্যগত ভাষণ দেবেন। মে মাসের শেষের দিকে বা জুনের প্রথম সপ্তাহে রানির ভাষণের ওপর ভোটাভুটি হবে। এ ভোটাভুটি সাধারণত নতুন সরকারের ওপর আস্থা ভোট হিসেবে দেখা হয়।
ব্রিটেনের মতো উন্নত দেশে যে সরকারই নির্বাচিত হোক না কেন তাদের জাতীয় মৌলিক বিষয়ে ঐকমত্য রয়েছে।এ কথা মনে করার কোনো কারণ নেই যে এড মিলিব্যান্ডরা জিতলে অথবা ক্যামেরনরা হারলে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রনীতিতে বিরাট ধরনের হেরফের হয়ে যাবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক বিন্যাসে, ইউরোপীয় সংহতি সাধনে, ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি অব্যাহত নিগৃহ নীতিতে এবং বাংলাদেশের প্রতি সতত মিত্রতার নীতিতে হয়তো কোনো পরিবর্তন সাধিত হবে না। তার কারণ জাতীয় স্বার্থই তাদের পররাষ্ট্রনীতির নিয়ামক। সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লর্ড পামারস্টোনের বহুল কথিত মনোভঙ্গিটি এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করা যায় : ‘গ্রেট ব্রিটেনের কোনো স্থায়ী শত্রু বা স্থায়ী মিত্র নেই। গ্রেট ব্রিটেনের শুধু স্থায়ী স্বার্থ রয়েছে।‘
ড. আবদুল লতিফ মাসুম : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়