নেপালের দিনলিপি-২
নির্মাণত্রুটির জন্যই ভবন ধসে
২৭ তারিখ সকাল। আগের রাতটি মোটামুটি নির্ঘুম কেটেছে। বারকয়েক ভূমিকম্পের কারণে কয়েক দফায় তিনতলা থেকে একতলা দৌড়াদৌড়ি করে শরীর রীতিমতো ক্লান্ত। তার ওপর পেটের ভেতরে ছুঁচো দৌড়াচ্ছিল। হোটেল থেকে নেমে রাস্তায় বের হলাম নাশতা করার জন্য। বিধি বাম, হোটেলের ত্রি-সীমানায় কোনো রেস্তোরাঁ খোলা নেই। মোটামুটি হাফ কিলো রাস্তা ঘুরে অবশেষে একটা ছোট্ট দোকান পেলাম খোলা। মেন্যু বলতে কিছু নেই, শুধুই আলু-পরোটা আর রং চা। কথায় আছে, ক্ষুধা লাগলে বাঘেও ঘাস খায়, আর এ তো রীতিমতো পরোটার মধ্যে আলু সেদ্ধ। গপাগপ দুটি পরোটা আর দুই কাপ চা সেটে দিলাম। এবার কাজে নামার পালা।
আগের রাতেই ত্রিভুবন বিমানবন্দরে নেমে অফিসে পাঠানোর জন্য একটা এজ-লাইভ ভিডিও করে রেখেছিলাম। কিন্তু ইন্টারনেট সুবিধার অভাবে পাঠাতে পারিনি। এমনকি আমি সুস্থ আছি কি না বা নেপালে পৌঁছাতে পেরেছি কি না, তা-ও জানে না অফিস কিংবা বাসার কেউই। তাই নেপালি মোবাইল সিম কেনাটা জরুরি হয়ে পড়ল। বহু খোঁজাখুঁজি করে সকাল ১০টার দিকে পেলাম বহু আরাধ্য সেই দোকান—প্রশান্ত জেনারেল স্টোর।
পাঠক জানিয়ে রাখা ভালো, নেপালে কোনো বিদেশি পর্যটক সিম কিনতে গেলে পাসপোর্টের ফটোকপি, এক কপি পাসপোর্ট সাইজ ছবি এবং দুই হাতে বুড়ো আঙুলের টিপসই দিতে হয়। যাহোক, সিম কিনলাম মোটামুটি তিন গুণ দামে। সিমের আসল দাম ১২০ নেপালি রুপি, কিন্তু সুযোগ বুঝে ৩০০ রুপির নিচে বেচল না দোকানি প্রশান্ত থাপা। সে সঙ্গে ফোন রিচার্জ কার্ড। সিম কেনা শেষ, কিন্তু সিম তো আর কাজ করে না। ঘণ্টাখানেক দোকানের সামনেই দাঁড়িয়ে রইলাম। সিম অ্যাকটিভ হয় না। দোকানি বলল, মোবাইলের টাওয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় নেটওয়ার্ক ডাউন। সার্ভার চালু হলেই সিম অ্যাকটিভেট হয়ে যাবে। কী আর করা, সিম মোবাইলে ভরে বের হলাম রিপোর্টের সন্ধানে। তারও প্রায় ঘণ্টা দুয়েক বাদে সিম চালু হলো। অফিসে ফোন করে জানালাম, বেঁচে আছি।
রাতের বেলায় কাঠমান্ডুতে নামায় ভূমিকম্পের ধ্বংসযজ্ঞের মাত্রাটা ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি প্রথমে। কিন্তু দিনের আলোয় যখন শহর ঘুরতে শুরু করলাম, তখন বিস্ময়ে হতবাক হওয়া ছাড়া আর কিছুই করার নেই। রাস্তার দুধারে শুধু ভেঙে পড়া ভবন। ভাঙা ল্যাম্পপোস্ট আর ইলেকট্রিক লাইনের খুঁটি। দেখে মনে হচ্ছিল, পুরো শহরের ওপর দিয়ে বুঝি এক শক্তিশালী টর্নেডো বয়ে গেছে।
আগের রাতেই হোটেলের জানালা দিয়ে দূরে আগুনের শিখা দেখেছিলাম বেশ কয়েকটি। দিনের বেলায় সেখানে গিয়ে দেখলাম, সেটি বিখ্যাত ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ পশুপতি এলাকা। ভেতরে ঢোকায় কড়া বিধিনিষেধ, ছবিও তোলা যায় না। তবে দূর থেকে যা দেখলাম, তা মন-খারাপ-করার মতোই ঘটনা। মন্দিরের পাশেই শ্মশানঘাট। সেখানে এক সারিতে গোটা বিশেক চিতা সাজানো হয়েছে, প্রতিটিতে আটটি করে লাশ দাহ করার জন্য রাখা হয়েছে। চিতায় আগুন দেওয়ার মিনিট বিশেক পরেই আবারো নতুন আটটি লাশ চড়ানো হলো চিতায়। এভাবে একটি চিতায় চার দফায় ৩২ জনের লাশ দাহ করা হলো আমার চোখের সামনেই। অর্থাৎ একসঙ্গে প্রায় ৬০০ মানুষের লাশ। মস্তিষ্কের মধ্যে দ্রুত খেলে গেল এক ঠান্ডা শিহরণ, তবে কি মৃতের সংখ্যা সব ধারণা ছাড়িয়ে যাবে। প্রথম দিনেই আমার মনে হয়েছে, নেপালের সরকার যেভাবে ১০ হাজার মানুষ মারা যাওয়ার খবর বলছে, বাস্তবে সংখ্যাটা হয়তো তার তিন গুণের বেশি হবে।
পশুপতি থেকে বের হয়ে একটা ট্যাক্সি নিলাম ভাড়ায়। কেউ মিটারে যাবে না। সবাই চুক্তিতে। মনে মনে হাসলাম ঢাকার ট্যাক্সি ড্রাইভারদের কথা ভেবে। কারণ, যে ভাড়া নেপালের ট্যাক্সি ড্রাইভার চাইল তা উল্লেখ না করাটাই ভালো, আমাদের দেশে না আবার ট্যাক্সি ভাড়া বেড়ে যায়।
ট্যাক্সি ড্রাইভারকে বললাম, কাঠমান্ডু শহরের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে নিয়ে যেতে। সে আমায় নিয়ে গেল বালাজু পয়েন্ট নামে এক জায়গায়। যাওয়ার পথে দেখলাম, কাঠমান্ডুর মোড়ে মোড়ে একটি-দুটি করে অসংখ্য ‘রানা প্লাজা’। তার মধ্যে বালাজু পয়েন্টেই হতাহত সবচেয়ে বেশি। বালাজুতে বেশ কয়েকটি মার্কেট ছিল। পুরো ভবনটিই ধসে পড়েছে, সে সঙ্গে ধসে পড়েছে আশপাশের আরো পাঁচ-ছয়টি ভবন।
ভবনগুলোর কাছাকাছি যেতেই নাকে এসে লাগল লাশপচা গন্ধ। এর আগে রানা প্লাজার উদ্ধারকাজ কাভার করেছি টানা প্রায় ১৭ দিন, বারবার যেতে হয়েছে হাসপাতালের হিমঘরে, লাশের গন্ধ আমার কাছে নতুন কিছু নয়। তাই সেই তীব্র দুর্গন্ধের মধ্যেই চালিয়ে গেলাম কাজ। ক্যামেরায় ধরা পড়ল একের পর এক লাশ উদ্ধারের দৃশ্য। নেপালের সেনাবাহিনী আর পুলিশ ফোর্স তাদের সীমিত সাধ্য আর স্বল্প দক্ষতা নিয়েই কাজ করে চলেছে নিরলস। মানুষের কোনো চিৎকার নেই, কোনো ঠেলাঠেলি নেই। আছে শুধু হারানো স্বজনের জন্য এক শূন্য দৃষ্টি।
বালাজু পয়েন্টে ক্রেনের একটানা ঘরঘর শব্দ, মাঝেমধ্যেই লাশ খুঁজে পাওয়ার চিৎকার। তার পর সব চুপ, শাবল আর গাইতি দিয়ে একটু একটু করে লাশ টেনে বের করা। তার পর আবার সেই ক্রেনের শব্দ।
সারা দিন কাঠমান্ডুর বালাজু পয়েন্টের আশপাশের এলাকায় কাজ করে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ল তা হলো, কাঠমান্ডুর ভবনগুলোর নির্মাণ উপকরণ। যেসব ভবন ধসে পড়েছে, সেগুলোর বেশির ভাগই ইট আর চুন-সুরকি দিয়ে বানানো ম্যাসনারি স্টাইলের। তাই ভূমিকম্পের প্রথম ধাক্কাতেই ধসে পড়েছে সেগুলো। কিন্তু নতুন নির্মিত ভবনগুলো ভেঙে পড়ার কারণ, ঢালাইয়ে অপর্যাপ্ত পরিমাণ রড ব্যবহার, রডের গুণগত মান ঠিক না হওয়া আর নির্মাণকাজে ব্যবহৃত সিমেন্ট-বালুর পরিমাণ ঠিক না থাকা। এসব তথ্য জানালেন নেপালি উদ্ধারকারী কর্মকর্তারা। তা ছাড়া ভবনের নকশার ত্রুটি তো রয়েছেই। সব মিলিয়ে যা বোঝা গেল তা হলো, কাঠমান্ডু শহরের ভবন নির্মাণ পদ্ধতি বেশ ত্রুটিপূর্ণ। পাঠক এবার ভেবে দেখুন, বাংলাদেশের ঢাকা শহরের কথা। আমরাই বা কতটা মেনে চলি বিল্ডিং কোড। এমন একটা ভূমিকম্প যদি বাংলাদেশে হয়, কেমন হবে ঢাকা বা চট্টগ্রাম শহরের চেহারা?
সারা দিন কাঠমান্ডু শহরের বেশ কয়েকটি পয়েন্টে ঘুরে বেড়ানোর ফাঁকে মোবাইল ফোন-সংক্রান্ত নতুন তথ্য আবিষ্কার করলাম। সেটা হলো, মোবাইল ফোন থেকে লোকাল এবং ইন্টারন্যাশনাল কল করা যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু ইন্টারনেট ব্যবহার করা যাচ্ছে না। তাই সন্ধ্যার দিকে কাঠমান্ডুর বসুন্ধরা চক্রপতে বাংলাদেশ দূতাবাসে হাজির হলাম।
দূতাবাসে স্বাগত জানালেন অ্যাম্বাসাডর মাশফি বিনতে শামস, ফার্স্ট সেক্রেটারি মঈন ভাই এবং শামীমা আপা। আর প্রযুক্তি-সংক্রান্ত বিষয়ে ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হলেন দূতাবাসের কর্মকর্তা বারিকুল ভাই। সারা দিনে কাঠমান্ডু শহরের বেশির ভাগ এলাকাতেই প্রায় ১৬ ঘণ্টার ওপর বিদ্যুৎ ছিল না, কিন্তু দূতাবাস ঠিকই বিদ্যুৎ পেয়েছে। রহস্যটা হলো সোলার প্যানেল। তাই সারা দিনের ক্লান্তি দূর করে দূতাবাসের ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ ব্যবহার করে ফুটেজ পাঠালাম ঢাকায়, আর শুরু হলো দূতাবাসের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানা।
(চলবে)