নেপালের দিনলিপি-১
কখনো জীবন বাঁচানোই সাহসিকতা
২৫ ও ২৬ এপ্রিল ২০১৫। এ দুটি দিনের কথা হয়তো খুব ভালোভাবেই জীবনের বাকিটা সময় মনে রাখবে বাংলাদেশের মানুষ। অন্তত যাঁরা ওই দুদিনের ভূমিকম্প অনুভব করতে পেরেছিলেন।
২৫ এপ্রিল ভূমিকম্পের পর আমার কর্মক্ষেত্র এটিএন নিউজের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত এবং আমার আগ্রহের পরিপ্রেক্ষিতে ২৬ এপ্রিল ভূমিকম্প বিধ্বস্ত নেপালে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়, যা আমি সানন্দে লুফে নিয়েছিলাম। সেটা যতটা না সাহসের পরিচয় দেওয়া, তার চেয়ে অনেক বেশি সাংবাদিকতা জীবনের অর্জনের খাতায় একটি নতুন অধ্যায় লেখার লোভ। কারণ, বাংলাদেশের মতো একটি তৃতীয় বিশ্বের দেশের সংবাদকর্মীর সাংবাদিকতা জীবনে এমন সুযোগ খুব কমই আসে। তার ওপর ক্যারিয়ারের বয়স আর অভিজ্ঞতার অভাবের কারণেই বিশেষ প্রতিনিধি বা সিনিয়র রিপোর্টার নই, নিতান্তই একজন স্টাফ রিপোর্টার।
২৬ এপ্রিল বিকেল ৪টায় আমার ফ্লাইট। বিজি ৭০৩। নির্ধারিত সময়ের প্রায় দেড় ঘণ্টা পর বিকেল ৫টা ২৫ মিনিটে বিমান ছাড়ল। যাত্রী মোট ৭৫ জন। এর মধ্যে আমরা জনাদশেক সাংবাদিক, ৩০ জন নেপালি ডাক্তার (যাঁরা বাংলাদেশে এসেছিলেন একটা কনফারেন্সে যোগ দিতে, নিজ দেশে ভূমিকম্পের খবর শুনে দেশের পথ ধরেছেন উদ্ধারকাজে অংশ নিতে), ২০ জনের একটি নেপালি স্কুলের মেয়েদের ফুটবল টিম আর তিনজনের একটি বাংলাদেশি পরিবার ঘুরতে যাচ্ছেন নেপালে। ওনাদের জিজ্ঞেস করলাম, সবাই যখন নেপাল ছাড়ছে, তাঁরা কেন এই দুর্যোগের মধ্যে নেপালে যাচ্ছেন। ওনারা যা বললেন, তা শুনে মায়াও লাগল আবার রাগও হলো। স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে ঘুরতে যাওয়া ভদ্রলোক বেশ অসহায় কণ্ঠেই বললেন, ট্রাভেল এজেন্টকে টাকা দিয়ে ট্যুর প্যাকেজ কিনেছিলেন, এখন এজেন্ট আর টাকা ফেরত দেবে না, তাই বাধ্য হয়েই দুর্যোগের মধ্যেই বেড়াতে যাচ্ছেন। একগাদা টাকা খরচ হয়ে গেছে, না গেলে পুরোটাই গচ্চা। হাসব না কাঁদব বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
যা বলছিলাম, ফ্লাইট দেরিতে ছাড়ার কারণটি খুবই ন্যায্য। সেদিন দুপুরের বিজি ৭০১ ফ্লাইটটিকে ততক্ষণে ঢাকায় ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছে নেপালের ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। নেপালে তখন জরুরি অবস্থা আর ত্রিভুবনে কোনো কমার্শিয়াল ফ্লাইট ভিড়তে পারবে না, রেসকিউ ফ্লাইটের চাপে। তাই আমাদের ফ্লাইটটিকে রেসকিউ ফ্লাইট ঘোষণা করা হয়। ছোট বিমানের পরিবর্তে দেওয়া হয় বোয়িং ৭৩৭। তোলা হয় প্রচুর ত্রাণসামগ্রী আর পুরোপুরি ভরে নেওয়া হয় জেট ফুয়েল। ক্যাপ্টেন জানান, বিভিন্ন দেশের রেসকিউ ফ্লাইটের চাপের কারণে কাঠমান্ডুর আকাশে চক্রাকারে উড়তে হতে পারে অনেকক্ষণ। তাই পর্যাপ্ত জ্বালানি প্রয়োজন। শেষ পর্যন্ত সেই কথাই ফলে গেল। কাঠমান্ডু থেকে প্রায় ৬৫ নটিক্যাল মাইল দূরে প্রায় ৩৪ হাজার ফুট উচ্চতায় আড়াই ঘণ্টা ধরে পাক খেল বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইট বিজি ৭০৩। বিমানের জানালা দিয়ে চোখে পড়ল বাইরের প্রচণ্ড ঝড়ো বৃষ্টি আর বজ্রপাত। বজ্রাহত হয়ে প্লেন ক্র্যাশ করার দুঃস্বপ্নও যে দু-একবার মনের মধ্যে উঁকি দেয়নি তা নয়।
যাই হোক, প্রায় পাঁচ ঘণ্টা আকাশে থাকার পর বিমান নামল ত্রিভুবনে। ইমিগ্রেশন পেরিয়ে বাইরে আসতেই চক্ষু রীতিমতো ছানাবড়া। বিমানবন্দর ভবনের বাইরেই হাজার হাজার মানুষ বৃষ্টিতে ভিজছেন। কারণ জানতে চাইলে অনেকেই বললেন, আবার যদি ভূমিকম্প হয় আর বিমানবন্দরের ছাদ যদি ভেঙে পড়ে সে আশঙ্কা তো রয়েছেই, তার ওপর এত মানুষকে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিমান নেই। যাত্রীদের বেশির ভাগই দেখলাম ভারতীয়। তাদের সবাই আশায় আছেন ভারত সরকার ত্রাণবাহী যেসব ফ্লাইট পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে, তাতে করে দেশে ফিরবেন তাঁরা বিনা খরচেই। সেই হাজারো মানুষের ভিড়ে অসংখ্য গৃহহীন নেপালিরাও ছিলেন, যাঁরা বলছিলেন ভারতীয়রা নেপালে বসে রোজগার করল, আর বিপদের সময় নিজের দেশে ভেগে গেল, এ জন্যই নাকি নেপালিরা ভারতীয়দের খুব একটা ভালো চোখে দেখে না। যদিও নেপালিদের প্রায় ৪০ শতাংশই বেশ ভালো হিন্দি ভাষা বোঝে এবং বলতে পারে।
ভূমিকম্পের কারণে ত্রিভুবন বিমানবন্দর চলছে হাতেগোনা কয়েকজন লোকবল দিয়ে। ডিউটি ফ্রি শপ বন্ধ, নেপালি ফোনের সিমকার্ড কেনার উপায় নেই, নেই কোনো ডলার ভাঙানোর মানি এক্সচেঞ্জ। এমনকি গোটা এয়ারপোর্টে একটা ট্যাক্সিও নেই। সঙ্গী হিসেবে ছিলেন আরো প্রায় জনাদশেক সাংবাদিক, সেটাই ভরসা। বিপদে শুধু আমি একা পড়িনি।
সময় গড়াতেই ক্ষুধা আর ঘুমের কাছে হার মানতে থাকে সব অসহায়ত্ব। বৃষ্টির মধ্যেই কোনোমতে রাত দেড়টার দিকে জোগাড় হয় ট্যাক্সি। ভাড়া সাড়ে ৬০০ ভারতীয় রুপি। আগেই জানতাম নেপালে ভারতীয় রুপি চলে। ১০০ ভারতীয় রুপির বিনিময়ে পাওয়া যায় ১০০ ৬০ নেপালি রুপি। সে হিসেবে প্রায় এক হাজার ৪০ নেপালি রুপি ভাড়া। কী আর করা, একে তো নেপালে প্রথম, তার ওপর ভূমিকম্পের কারণে কাঠমান্ডুর হোটেল বেশির ভাগই বন্ধ। তাই, ট্যাক্সি ড্রাইভারের ওপরই ভরসা। তো সেই ট্যাক্সি ড্রাইভার আমাদের নিয়ে গেলেন নারায়ণা নামের এক ছয়তলা ভবনবিশিষ্ট হোটেলে, যার সাবেক নাম হোটেল মহারাজা। কিন্তু বিমানবন্দর থেকে হোটেলের দূরত্ব মাত্র দেড় কিলোমিটার। তখন মনে হলো, ঢাকার সিএনজি অটোরিকশাচালকরা রীতিমতো দেবদূত।
হোটেলে ঢুকতেই রুম পেলাম তৃতীয় তলায়। চাবি নিয়ে রুমের দিকে উঠতে যেতেই ম্যানেজার ডাকলেন পেছন থেকে। হাতে ধরিয়ে দিলেন একটা বালিশের কাভার আর একটা চাদর। বললেন, ভূমিকম্পের ভয়ে হোটেলের সব স্টাফরাই পালিয়ে গেছে। শুধু তিনি রয়ে গেছেন পরিবার নিয়ে, ঘুমাচ্ছেন লবিতেই তোষক পেতে। যাতে করে ভূমিকম্প হলেই দৌড়ে বেরিয়ে যেতে পারেন সামনের রাস্তায়। বোঝেন অবস্থা, আমাদের রুম তিনতলায়। তখনই জিজ্ঞেস করলাম, খাবার-দাবারের কী হবে? ম্যানেজার বললেন, তাঁদের বাবুর্চিরাও ভেগে গেছে। হাতে ধরিয়ে দিলেন প্যাকেট নুডলস আর এক বোতল পানি। খেতে হবে শুকনোই। পানি গরম করারও ব্যবস্থা নেই। ভাবছেন, এমন অবস্থায় হোটেল ভাড়া নিশ্চয় কম হবে, তাই না? সেটাই তো হওয়া উচিত! ভুল ভাবছেন, ভূমিকম্পে গোটা কাঠমান্ডুতে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে পড়ে অন্যতম এলাকা হোটেলপাড়া থামেল। তাই অন্য এলাকার হোটেল মালিকরা এ সুযোগে ব্যাপক দাম হাঁকাচ্ছেন, আমাদের হোটেল ভাড়াও তাই আকাশছোঁয়া। কিন্তু কী আর করা, রাতে তো ঘুমাতে হবে।
প্যাকেট নুডলস আর পানি খেয়ে যখন ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছি, তখনো কেঁপে উঠল ধরিত্রী। কোনোমতে পড়িমরি করে আমরা ১০ জনই তিনতলা থেকে নেমে এলাম রাস্তায়। কিছুক্ষণ পর আবার রুমে। আধঘণ্টা পরই আবারও ভূমিকম্প, আবারও দৌড়। শেষ পর্যন্ত গোটা রাতে ঘুমালাম বড়জোর ১৫-২০ মিনিট। ভূমিকম্প অনুভব করলাম গোটা সাতেক।
শুরুতে যেমনটা বলছিলাম, কখনো কখনো জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করাটাই সার্থকতা, সাহসিকতা। আর এ কথাটি আমাকে হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দিল হিমালয় কন্যা নেপাল, তার ভূমিকম্প বিধ্বস্ত বুকে আমার প্রথম রাত্রিযাপনেই।
(চলবে)