ট্রাম্পের মাথায় ভরাডুবির ভূত
রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প এ মুহূর্তে দারুণ মুসিবতে আছেন। একের পর এক নারী কেলেঙ্কারির ঘটনা প্রকাশিত হওয়ায় ধ্বস্তবিধ্বস্ত হচ্ছে তাঁর প্রচারণা। আজ শেষ বিতর্কেও হিলারির কাছে হেরে গেছেন ট্রাম্প। জনমত জরিপে হিলারি ৫২ শতাংশ ও ট্রাম্প ৩৯ শতাংশ সমর্থন পেয়েছেন।
গত ১৪ অক্টোবর দ্বিতীয়বারের মতো ট্রাম্পের নারী কেলেঙ্কারির ভিডিও টেপ প্রকাশিত হয়। এর আগে এ ধরনের আরো একটি ভিডিও টেপ প্রকাশিত হয়েছিল। এ পর্যন্ত ১০ জন নারী ট্রাম্পের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এটি ‘অক্টোবর সারপ্রাইজ’ বলে অভিহিত হয়েছে।
এসব অভিযোগের উত্তরে ট্রাম্প বলেছেন, ‘সবই মিথ্যা।’ তিনি হিলারি এবং তাঁর প্রচারণা গোষ্ঠীকে বৈরী প্রচারণার জন্য দায়ী করেছেন। এর আগে ট্রাম্প দ্বিতীয় বিতর্কে এমন চারজন নারীকে উপস্থিত করেছিলেন, যাঁরা হিলারির স্বামী ক্লিনটন কর্তৃক ধর্ষিত হওয়ার অভিযোগ করেছিলেন।
অক্টোবর মাসটি ভালো যাচ্ছে না ট্রাম্পের। এ মাসের প্রথম সপ্তাহে মার্কিন দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমস তাদের প্রকাশিত প্রতিবেদনে ট্রাম্পকে বড় ধরনের কর ফাঁকির অভিযোগে অভিযুক্ত করে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৯৫ সালে ট্রাম্প ছলচাতুরী করে তাঁর ব্যবসায় ৯৯৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার লোকসান দেখান। পরবর্তী ১৮ বছর তিনি ফেডারেল কর দেননি।
এ ধরনের স্পর্শকাতর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ট্রাম্পের জনপ্রিয়তায় ধস নেমেছে। সাধারণ নাগরিক তো বটেই, খোদ রিপাবলিকান শীর্ষ নেতৃবৃন্দ ট্রাম্পকে সমর্থন বা সহযোগিতা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার পল রায়ান, রিপাবলিকান পার্টির চেয়ারম্যান রেইনসি প্রিবাস, সিনেটের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা মিক কননেল, রিপাবলিকান সিনেটর কেলি আয়োতি, সাবেক সিনেটর মার্ক কির্ক, সাবেক প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী মিট রমনি, সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের ছোট ভাই জেব বুশ প্রমুখ। তাঁরা সবাই প্রেসিডেন্টের মতো মর্যাদাপূর্ণ পদে ট্রাম্পকে অযোগ্য এবং অগ্রহণযোগ্য বলে ঘোষণা করেন।
তাঁদের মতে, ট্রাম্পের দায়িত্বহীন মন্তব্যে গোটা বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাঁরা আব্রাহাম লিঙ্কন ও আইজেন হাওয়ারের ঐতিহ্যমণ্ডিত রিপাবলিকান পার্টির এই হালে হতাশা প্রকাশ করেন। তাঁদের অনেকেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচন থেকে ট্রাম্পকে সরিয়ে দেওয়ার পক্ষে। তবে চরমপন্থায় বিশ্বাসী রিপাবলিকানরা ট্রাম্পের সঙ্গেই রয়েছেন।
এত দিন ধরে দেখে এসেছি, আমেরিকা আমাদের মডেল। আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তথা আমেরিকা কর্তৃক প্রভাবিত হই। বর্তমান নির্বাচনী প্রচারণা দ্বারা প্রমাণিত হচ্ছে যে তারাও আমাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ডোনাল্ড ট্রাম্প এখন আত্মরক্ষায় ব্যর্থ হয়ে ষড়যন্ত্র-তত্ত্বের ওপর ক্রমে নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন। নারী কেলেঙ্কারিকে তিনি ‘ষড়যন্ত্র’ বলছেন। তাঁর অভিযোগের পেছনে রয়েছে হিলারি ক্লিনটন এবং মূলধারার মার্কিন গণমাধ্যম। তিনি হিলারির বিরুদ্ধে মাদক গ্রহণের অভিযোগ এনেছেন। তবে এর পক্ষে কোনো তথ্যপ্রমাণ তিনি হাজির করতে পারেননি। ট্রাম্পের আরো অভিযোগ, দুর্নীতিগ্রস্ত গণমাধ্যম তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ প্রচার করছে।
ট্রাম্প আরো অভিযোগ করেন, নির্বাচনী ফল উল্টে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। তিনি তাঁর এ আশঙ্কাকে সাধারণ মার্কিন নাগরিকদের মধ্যে সংক্রমিত করছেন। নির্বাচনী গবেষণা সংস্থা ‘পলিটিকো’র সর্বশেষ জাতীয় জরিপ অনুসারে ৭৩ শতাংশ রিপাবলিকান মনে করেন, নির্বাচনের ফল চুরি হতে পারে। এদের ১৭ শতাংশ মনে করেন, বর্তমান নির্বাচনে কারচুপি হতে পারে।
মার্কিন দৈনিক ওয়াশিংটন পোস্ট মনে করে, হেরে গেলে ট্রাম্প নির্বাচনের ফল নাও মেনে নিতে পারেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন জায়গায় ট্রাম্পের লোকেরা প্রতিপক্ষকে ভয় দেখাতে শুরু করেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা হয়, ভার্জেনিয়ার পালমিরায় ডেমোক্রেটিক পার্টির একটি অফিসে মাস্তানদের মহড়া দিতে দেখা গেছে। তারা বলছে, ‘রিপাবলিকানদের ভোট দিতে দেওয়া হবে না।’
নির্বাচনের আগেই এর ফল প্রত্যাখ্যানের চেষ্টা মার্কিন ঐতিহ্য এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিরোধী। এ ধরনের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক মহলে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। এই মানসিকতা মার্কিন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ওপর প্রবল নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী প্রক্রিয়ার ওপর গোটা বিশ্বের আস্থা রয়েছে। হিলারিশিবির থেকে জানানো হয়েছে, গণতন্ত্রের জন্য নিরাপদ ও সম্পূর্ণ স্বচ্ছ পরিবেশে ভোট গ্রহণ নিশ্চিত করা নির্বাচনী প্রক্রিয়ার একটি পূর্বশর্ত। প্রেসিডেন্ট ওবামা ‘নির্বাচন ব্যবস্থা দুর্নীতিগ্রস্ত’—এ অভিযোগকে ‘অসত্য ও হাস্যকর’ বলে অভিহিত করেন।
মার্কিন নির্বাচন ব্যবস্থা সম্পর্কে অভিজ্ঞজনরা বলছেন, ভোটের ব্যবধান সামান্য হলে সংক্ষুব্ধ পক্ষ পুনরায় ভোট গণনার দাবি করতে পারে। আর যেকোনো বিরোধ মীমাংসার জন্য সর্বোচ্চ আদালতের রায়ই শেষ কথা। স্মরণ করা যেতে পারে যে, ২০০০ সালে এমন ঘটনা ঘটেছিল। জর্জ বুশ ও আল গোরের মধ্যে ফ্লোরিডার কয়েকটি নির্বাচনী এলাকার প্রতিটি ভোট পুনরায় গণনা করার জন্য আবেদন জানানো হয়। শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্ট ৫-৪ ভোটে জর্জ বুশকে বিজয়ী ঘোষণা করেছিলেন।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।