যিশু খ্রিস্ট- অব্রাহামের বংশ

Looks like you've blocked notifications!

শুভ বড়দিন! এ দিনে বিশ্বের সব মানুষের শান্তি কামনা করি। আমি কৃতজ্ঞ যে, এ দিনে আমাদের দেশের সরকারি প্রশাসন, স্থানীয় জন-প্রতিনিধি ও সঙ্গে সাধারণ জনগণ সহযোগীতা করছেন যাতে খ্রিস্টানরা তাদের বড়দিন উৎসব পালন করতে পারে। আমাদের দেশের বৃহত্তম ধর্মের অনুসারী ও আমাদের শুরু সম্পর্কে লিখতে চাই। দেখতে চাই অব্রাহাম ও যিশু কতটুকু সম্পর্কিত।

বাইবেলের তোরাহ থেকে একটি ঘোষণা দিয়ে শুরু করি। সদাপ্রভু [‘সদাপ্রভু’ বাইবেলে বর্ণিত ঈশ্বরের ব্যক্তিগত নাম] ঈশ্বর অব্রাহামের কাছে ঘোষণা করেন, “আমি তোমা হতে এক মহাজাতি উৎপন্ন করব, এবং তোমাকে আশীর্বাদ করে তোমার নাম মহৎ করব; তাতে তুমি আশীর্বাদের আকর হবে। যারা তোমাকে আশীর্বাদ করবে তাদেরকে আমি আশীর্বাদ করব; যে কেউ তোমাকে অভিশাপ দেবে, তাকে আমি অভিশাপ দেব; এবং তোমাতে ভূম-লের যাবতীয় গোষ্ঠী আশীর্বাদ-প্রাপ্ত হবে” (তোরাহ আদিপুস্তক ১২: ২-৩)। এখানে উল্লেখ্য অব্রাহামের আগেশার নাম ছিল ‘অব্রাম’ যার অর্থ ‘মহাপিতা’, আর ‘অব্রাহাম’ নামের অর্থ ‘বহু লোকের পিতা’। ঈশ্বর এর পরে অব্রাহামকে বলেন, “চোখ তুলে এ যে স্থানে তুমি আছ, এ স্থান হতে উত্তর-দক্ষিণে ও পূর্ব-পশ্চিমে দৃষ্টিপাত কর; কেননা এ যে সমস্ত দেশ তুমি দেখতে পাচ্ছ, এ আমি তোমাকে ও যুগে যুগে তোমার বংশকে দেব” (তাওরাত আদিপুস্তক ১৩: ১৪-১৫)।
 
ইহুদিরা মনে করে, তারা অব্রাহামের সত্যিকারের বংশ, বংশধর ও উত্তরাধিকার। তারা এখনও মনে করে যে, তারা অব্রাহামের কাছে প্রতিজ্ঞাত আশীর্বাদ-প্রাপ্ত জাতি, অন্য কেউ নয়। কেননা তারা অব্রাহামের দৈহিক বংশধর। অব্রাহাম, অব্রাহামের ছেলে ইসহাক ও ইসহাকের ছেলে যাকোব এ তিনজন তাদের পিতৃপুরুষের উত্তরাধিকারের ধারা। বাইবেলের বর্ণনা মতে ঈশ্বর নিজে যাকোবের নাম পরিবর্তন করে ইসরাইল [অর্থাৎ ঈশ্বরের সঙ্গে যুদ্ধকারী] দেন। এ যাকোব বা ইসরাইল থেকে বারো ছেলে এবং বারো ছেলে থেকে বারো বংশ হয়। বাইবেলে অব্রাহাম, ইসহাক ও যাকোব এ তিনজনকে ‘পিতৃপুরুষ’ [Patriarch]   আখ্যা দেয়া হয়েছে। ঈশ্বর অব্রাহামকে যে প্রতিজ্ঞা করেন, তার ভুল ব্যাখ্য থেকে ইহুদি ও খ্রিস্টানদের মাঝে বিশ্বাস ও ধর্মতাত্ত্বিক পার্থক্য শুরু হয়। কেননা এখান থেকেই যিশু খ্রিষ্টের সময়কার ইহুদি ও যিশু খ্রিষ্টের মধ্যেই পার্থক্য শুরু হয়। কেউ কেউ আছেন যারা ইহুদি ও খ্রিস্টানদের মধ্যে মিল দেখান, আর অপপ্রচার করেন যে, ইহুদি ও খ্রিস্টান বিশ্বাস ও ধর্মতত্ত্বের দিক থেকে এক। আর ধর্মীয় এ ধারণার কারণে বিশ্ব-রাজনীতিকেও ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হয়। আমাদের মনে রাখা দরকার, ইহুদিরাই যিশু খ্রিস্টকে প্রত্যাখ্যান করেছিল, তারাই তাঁকে পাথর মেরে হত্যা করতে চেয়েছিল, তারাই শেষমেশ তাঁকে রোমান আইনের সাহায্য নিয়ে ঈশ্বর-নিন্দা ও রোমান সম্রাটের-নিন্দার অভিযোগে অভিযুক্ত করে ক্রুশে হত্যা করেছিল।

অথচ বিশ্বের অনেক দেশে খ্রিস্টানরা ইহুদিদের কাজের পরিণতি বহন করে চলেছে। ইহুদি ও অন্যান্য ধর্মের ভিতরকার যুদ্ধ ও অশান্তির জন্য খ্রিস্টানরা অভিযুক্ত হচ্ছে, মার খাচ্ছে, এবং আক্রান্ত হচ্ছে। যখনই ইহুদি ও অন্য কোনো ধর্মের সমস্যা হয়, তখন বিশ্বের সব খ্রিস্টান শংকার মধ্যে পড়ছে, কোথাও গির্জায় হামলা হচ্ছে, খ্রিস্টানদের বাড়িতে আগুন দেওয়া হচ্ছে। আমি ইহুদি বা কোনো ধর্ম-বিদ্বেষী নই। কিন্তু ইহুদিদের কারণে খ্রিস্টানদের যে মূল্য দিতে হচ্ছে, তা তুলে ধরার চেষ্টা করছি। ইহুদি ধর্ম সত্য বা মিথ্যা, তা প্রমাণ করাও আমার কাজ নয়। কিন্তু আমি খ্রিস্টান হিসেবে আত্মরক্ষার জন্য আমাদের অবস্থান সম্পর্কে বলছি। আমরা খ্রিস্টানরা এ দেশে সবার সঙ্গে বিশেষভাবে বৃহত্তম ধর্মাবলম্বীসহ সব ধর্মের বিশ্বাসীর সঙ্গে সহ-অবস্থান করে বাস করতে চাই।

খ্রিস্টানদের আক্রান্ত হওয়ার আরেকটি কারণ হচ্ছে বিশ্বের কোনো কোনো উন্নত পশ্চিমা দেশ ইহুদিদের সমর্থন করছে। এতে খ্রিস্টানদের কি? সেই সব দেশ কি খ্রিস্টান দেশ? এসব উন্নত বিশ্ব-মাতব্বর দেশগুলো ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ [[Secular]  দেশ। এসব রাষ্ট্রে ধর্ম কোনো বিষয় নয়, সেখানে সব ধর্মের সমান অধিকার। কে বিশ্বাস করবে যে, পাশ্চত্য বিশ্বে খ্রিস্টধর্ম প্রচার করা যায় না। কেননা তারা একে তাদের ব্যক্তি-স্বাধীনতা ও নিজ নিজ বিশ্বাসের অধিকারে হস্তক্ষেপ বলে বিবেচনা করে, এমনিক আইনের আশ্রয় নিতে পারে। সেখানে কোনো বিদ্যাপীঠে কোনো ধর্মই পড়ানো হয় না। কেননা পড়াতে হলে সব ধর্ম পড়াতে হবে যা আমাদের দেশে চালু আছে। তবে বর্তমানে এসব দেশকে খ্রিস্টান দেশ বলা যাবে না। খ্রিস্টধর্মীয় বিশ্বাস ও নৈতিকতা সেখানে মার খাচ্ছে। যদি ইহুদি ও পাশ্চাত্য বিশ্বের সখ্যতা থাকে, তা রাজনৈতিক এবং তাদের আধিপত্য বিস্তার ও বজায় রাখার কারণে, সেখানে খ্রিস্টধর্মের কোন বিষয়ের স্থান নেই। এসব দেশে বহু ভালো খ্রিস্টান আছে- এ কথা সত্য। বিশ্বব্যাপী কোনো কোনো খ্রিস্টান ব্যক্তিগতভাবে  বিশ্বাস করে যে, ইহুদিরা আবার সারা বিশ্ব থেকে একত্রিত হবে এবং পুরো বিশ্বের উপরে রাজত্ব করবে। কেউ কেউ বিশ্বাস করে যে, ইহুদিরা সবাই একদিন যিশু খ্রিষ্টকে তাদের প্রভু হিসেবে মানবে। এসব ধারণা খ্রিস্টধর্মের মধ্যেই বিতর্কিত। সত্যিকারের বাইবেল অনুসারী খ্রিস্টানরা বিশ্বাস করে যে, ইহুদি ধর্ম ও অইহুদি অন্যান্য ধর্ম মিলিয়ে সারা বিশ্বের মধ্যে সবাই যে যিশুকে বিশ্বাস করবে এমন নয়; কিন্তু কেউ কেউ বিশ্বাস করবে।

নতুন নিয়ম গালাতীয় ৩: ১৬ পদে বর্ণিত আছে, ‘ভালো, অব্রাহামের প্রতি ও তার বংশের প্রতি প্রতিজ্ঞাসব উক্ত হয়েছিল। তিনি বহুবচনে ‘আর বংশ সবার প্রতি’ না বলে, একবচনে বলেন, ‘আর তোমার বংশের প্রতি’; সেই বংশ খ্রিস্ট।” নতুন নিয়মের এ কথার অর্থ হচ্ছে যে, অব্রাহামের আসল প্রতিজ্ঞাত বংশ ইসহাক নন, কিন্তু খ্রিস্ট। তোরাহ গ্রন্থে উল্লিখিত ইসহাক যিশুর নমুনা মাত্র, কিন্তু ইসহাকই শেষ লক্ষ্য নন। অব্রাহামের কাছে প্রতিজ্ঞাত বংশের পূর্ণতা হচ্ছেন আসলে যিশু খ্রিস্ট। আর এ কারণেই খ্রিস্টানরা অব্রাহামকে এত শ্রদ্ধা করে, তাদের বিশ্বাসের আদিপিতা হিসেবে মানে। খ্রিস্টানরা অব্রাহামের আশীর্বাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। নতুন নিয়ম রোমীয় ৯ : ৮ পদে বর্ণিত হয়েছে, ‘যারা মাংসের [দৈহিক] সন্তান, তারা যে ঈশ্বরের সন্তান, এমন নয়, কিন্তু প্রতিজ্ঞার সন্তানগণই বংশ বলে গণিত হয়।‘ তবে আমরা খ্রিস্টানদের নতুন নিয়ম থেকে দেখলাম যে, যারা যিশু খ্রিস্টকে বিশ্বাস করে, তারাই অব্রাহামের সত্যিকারের আত্মিক বংশধর। ঈশ্বর অব্রাহামকে প্রতিজ্ঞা করে তার বংশকে যে আশীর্বাদ করার কথা বলেছিলেন, সে বংশধররা হচ্ছে যিশু খিস্টের অনুসারী, ইহুদিরা নয়।

অব্রাহামের বংশকে যে আশীর্বাদ করার কথা বলা হয়েছে, তা জাগতিক আশীর্বাদ নয়; কিন্তু আত্মিক আশীর্বাদ। তাই যে দেশ দেওয়ার বলা হয়েছে, তা জাগতিক কোনো দেশ নয়। কেননা খ্রিস্টানরা নিজেদের এ পৃথিবীর আধিপত্যকারী দল বলে বিশ্বাস করে না। তারা বিশ্বাস করে স্বর্গীয় রাজ্যে। এ জগতে তারা প্রবাসী, কেননা স্বর্গ তাদের আসল চিরস্থায়ী আবাস। যিশু খ্রিস্ট সেজন্য এসেছেন এ জগতে তাঁর জাগতিক রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে নয়, তিনি এসেছেন পাপী মানুষের পাপ ক্ষমা করে, তাদের অন্তরে ঈশ্বরের রাজ্য স্থাপন করতে। সেজন্য আজকের এ বড়দিনে মনে করা দরকার যে, তাদের এ জাগতিক রাজ্য, জমি-জমা, বা যেকোনো সম্পদে মগ্ন থাকার কথা নয়। যিশু এ বলেছেন যে, শিয়ালের গর্ত আছে, পাখির বাসা আছে, কিন্তু তাঁর মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। নিঃস্ব অবস্থায় এসে তিনি চলে গেছেন। কোনো রাষ্ট্র তিনি তৈরি করেননি, তার রাজাও তিনি হননি। যিশু এ পৃথিবীতে এসে ঈশ্বরের রাজ্য প্রতিষ্ঠা করার কাজ করেন যা আগত স্বর্গীয় রাজ্যের নিদর্শন, যা চোখে দেখা যায় না, ছোঁয়া যায় না। কিন্তু সে আগত রাজ্যে খ্রিস্টীয় বিশ্বাসীরা চিরকাল থাকবে।

শেষে বলতে হচ্ছে, যেকোনো ধর্মের অনুসারীরা অব্রাহামকে তাদের পূর্বপুরুষ বা আদিপিতা মানেন, অথবা মনে করেন যে, তাদের বিশ্বাস অব্রাহাম থেকে এসেছে, তাদের সঙ্গে আমাদের মিলেমিশে থাকতে কোনো অসুবিধা নেই। কেউ বা ইশ্মায়েলের ধারায়, আবার কেউ বা ইসহাকের ধারায় এসেছে। খ্রিস্টানরা বিশ্বাস করে যিশু খ্রিস্ট অব্রাহামের আসল বংশ, কেউ বা বিশ্বাস করে অব্রাহামের বড় ছেলে ইশ্মায়েলের ধারায় তাদের ধর্ম এসেছে। এ দুই দলেরই মনে করতে হবে যে, তারা উভয়েই অব্রাহামের থেকে এসেছে। তাই তাদের মধ্যে বিশ্বাসগত পার্থক্য থাকতে পারে, পার্থক্য থাকবে, থাকা স্বাভাবিক; কিন্তু সে পার্থক্যকে মেনে নিয়ে পরস্পরকে শ্রদ্ধা করে চলতে হবে।

লেখক : রেভারেন্ড এডওয়ার্ড আইয়ুব