টেকনো ড্রাগস ও সরকারি কর্মকর্তাদের বিনিয়োগ ইস্যুতে উত্থানে পুঁজিবাজার
টেকনো ড্রাগসের প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) আবেদনে আটকে থাকা অর্থ বিনিয়োগকারীদের বেনিফিশিয়ারি ওনার্সে (বিও) রিফান্ড, সরকারি কর্মকর্তারা পুঁজিবাজারে আসতে পারে ও পুঁজিবাজারের অনিয়মকারীদের বিরুদ্ধে সরকার কঠোর- এসব খবরে পুঁজিবাজার চাঙ্গা বলে মনে করছেন পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, ঈদের পর থেকে পুঁজিবাজারে চাঙ্গাভাব দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে গত সপ্তাহে (রোববার থেকে বৃহস্পতিবার) চার কর্মদিবসের মধ্যে দুই দিনে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) লেনদেন সাতশ কোটি টাকার ওপরে হয়েছে। সপ্তাহটিতে সব ধরনের সূচক উত্থান হয়েছে। ডিএসইতে মূলধন বেড়েছে ৯ হাজার ৫৫৫ কোটি টাকা। ৮০ শতাংশ কোম্পানির শেয়ারেও দর উত্থান হয়েছে।
আইপিওতে অনুমোদন পাওয়া টেকনো ড্রাগসের আবেদনে দীর্ঘদিন বিনিয়োগকারীদের দুই হাজার ৪০০ কোটি টাকা আটকে ছিল জানিয়ে পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সম্প্রতি সেই আবেদনের রেজাল্ট (শেয়ার বরাদ্দ) ঘোষণা করেছে কোম্পানিটি। ফলে বিনিয়োগকারীদের সেই আটকে যাওয়া দুই হাজার তিনশ কোটি টাকা রিফান্ড হয়েছে বিনিয়োগকারীদের বিওতে। সেই অর্থ অনেকেই পুঁজিবাজারের অন্য কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করেছেন। এতে পুঁজিবাজার চাঙ্গা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুঁজিবাজারে সরকারি কর্মকর্তাদের বিনিয়োগের অনুমতি দিতে পারে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯ এর একটি খসড়া সম্প্রতি সংশোধনী আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছিল। যা যাচাই-বাছেইয়ের পর ফেরত এসেছে- এমন খবর ছড়িয়ে পড়েছে পুঁজিবাজারে। এতে গত সপ্তাহের শেষ কর্মদিবসে (বৃহস্পতিবার) পুঁজিবাজারে সূচকের বড় উত্থান হয়েছে। এতে দিনশেষে সূচক ডিএসইএক্স উত্থান হয় ১২৩ পয়েন্ট। ওইদিনেই বেড়েছে ৯২ শতাংশ কোম্পানির শেয়ার দর। লেনদেনও ৭৭০ কোটি টাকার ঘরে।
পুঁজিবাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বেড়েছে জানিয়ে তারা বলেন, শেয়ার জালিয়াতি সাথে জড়িত বড় কিছু অসাধু লোকের নাম সম্প্রতি উঠে এসেছে গণমাধ্যমে। নিয়মের তোয়াক্কা না করেই পুঁজিবাজারে এসেই প্লেসমেন্টসহ সেকেন্ডারি মাকের্টের শেয়ার নিয়ে জালিয়াতি করে মন্দা পুঁজিবাজারের আয় করেছেন কোটি কোটি টাকা। এসব তথ্যে নড়ে বসেছে সরকার, তাদের ধরতে কঠোরও হয়েছেন। পুঁজিবাজার থেকে কোটি কোটি টাকা আয়ের বিষয়ে ইতোমধ্যে গণমাধ্যমে রাজস্ব কর্মকর্তা মতিউর রহমানের নাম ওঠে এসেছে। পুঁজিবাজার থেকে তার এতো আয় খতিয়ে দেখছেন সরকারি সংস্থাগুলো। ওই তালিকায় আরও অনেকেই রয়েছে, তাদেরকেও খুঁজছেন। ফলে পুঁজিবাজারের এক ধরনের স্বচ্ছতা বেড়েছে। বেড়েছে জবাবদিহিতাও। এসব প্রভাবেও পুঁজিবাজার উত্থান।
সুনির্দিষ্ট কয়েকটি ইস্যুতে পুঁজিবাজার চাঙ্গা বলে মনে করছেন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাবেক প্রেসিডেন্ট ও বর্তমান পরিচালক শাকিল রিজভী। তিনি বলেন, সরকারি কর্মকর্তারা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে পারবে এমন বিষয় আমলে নিয়ে কাজ করছে সরকার। শিগগিরই এ বিষয়ে একটি নির্দেশনা আসতে পারে। অপরদিক, টেকনো ড্রাগসের আবেদনে দীর্ঘদিন পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের দুই হাজার ৪০০ কোটি টাকা আটকে ছিল। সেই কোম্পানিটির আইপিও শেয়ার বরাদ্দ ইতোমধ্যে বিনিয়োকারীরা পেয়েছেন। ফলে আটকে থাকা বিনিয়োগকারীদের প্রায় দুই হাজার ৩০০ কোটি টাকা রিফান্ড বিনিয়োগকারীদের বিওতে পৌছে গেছে। সেই অর্থ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ হচ্ছে।
শেয়ার জালিয়াতির সাথে জড়িত বড় কিছু অসাধু লোকের নাম সম্প্রতি উঠে এসেছে গনমাধ্যমে জানিয়ে শাকিল রিজভী বলেন, পুঁজিবাজারে বিভিন্ন অনিয়মের সাথে জড়িত থেকে অনেকে কোটি কোটি টাকা আয় করছে। সরকার তাদের ধরতে কঠোর হয়েছে। এর ফলে পুঁজিবাজারের প্রতি অনেকের আস্থা ফিরছেন।
টেকনো ড্রাগসের আইপিও আবেদনে আটকে যাওয়া অর্থ রিফান্ড প্রসঙ্গে জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহয়োগী অধ্যাপক মো. আল আমিন বলেন, আটকে পড়া দুই হাজার ৩০০ কোটি টাকা মুক্ত হয়েছে। ওই অর্থ বিনিয়োগকারীরা এখন থেকে সেকেন্ডারি মার্কেটে বিনিয়োগ করতে পারবে। অনেকেই সেই অর্থ বিনিয়োগ করেছেন। এতে পুঁজিবাজার কিছুটা চাঙ্গাভাব।
বিভিন্ন অনিয়ম ধরাতে আগের চেয়ে পুঁজিবাজারে স্বচ্ছতা বেড়েছে জানিয়ে অধ্যাপক আল আমিন বলেন, সরকারি কর্মকর্তারা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে পারবে এ ধরনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসতে পারবে এমন খবরেও বাজার উত্থান হয়েছে।
ডিএসইর ওয়েবসাইট সূত্রে জানা যায়, গত ১০ অক্টোবর পুঁজিবাজারে সরকারি বন্ডের লেনদেন শুরু হয়। এরপর ডিএসইতে ২৫০ বন্ডের লেনদেন হয়। এতে ডিএসইর শেয়ারবাজার মূলধন ২ লাখ ৫২ হাজার ২৬৩ কোটি ১৩ লাখ টাকা থেকে বেড়ে ৭ লাখ ৭৩ হাজার ৯৩৯ কোটি ৫৮ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছিল। এরপর গত ২৭ অক্টোবর শেয়ারবাজার মূলধন কমে দাঁড়িয়েছিল সাত লাখ ৬৯ হাজার ৪৬৫ কোটি ৭২ লাখ টাকা। গত সপ্তাহের শেষ কার্যদিবস বৃহস্পতিবার পুঁজিবাজার মূলধন দাঁড়ায় ছয় লাখ ৭১ হাজার ৬৩ কোটি ২৫ লাখ টাকায়। যা আগের সপ্তাহের শেষ কার্যদিবস বৃহস্পতিবারে মূলধন দাঁড়িয়েছিল ছয় লাখ ৬১ হাজার ৫০৮ কোটি ১৪ লাখ টাকায়।
গেল সপ্তাহে ডিএসইতে প্রতিদিন গড়ে লেনদেন হয় ৬১৫ কোটি ৮২ লাখ টাকা। আগের সপ্তাহে গড়ে লেনদেন হয়েছিল ৫৬০ কোটি ৪২ লাখ টাকা। গেল সপ্তাহে ডিএসইতে তালিকাভুক্ত ৪১২টি কোম্পানির শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়। এর মধ্যে শেয়ার দর বেড়েছে ৩২৯টির বা ৭৯ দশমিক ৮৫ শতাংশ, দর কমেছে ৪০টির ও অপরিবর্তিত রয়েছে ২৪টি কোম্পানির। লেনদেন হয়নি ১৯টি কোম্পানির শেয়ার।
সপ্তাহটিতে সব ধরনের সূচক উত্থানে লেনদেন শেষ হয়। এক সপ্তাহের ব্যবধানে প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ১৪২ দশমিক ১৫ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়ায় পাঁচ হাজার ৪৯৭ দশমিক ৫৬ পয়েন্টে। শরিয়াহ সূচক ডিএসইএস ২৫ দশমিক ১৮ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক হাজার ২০৮ দশমিক ৭০ পয়েন্টে। ডিএসই৩০ সূচক ২৮ দশমিক ৭৭ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৯৫১ দশমিক ৩৪ পয়েন্টে। এছাড়া ডিএসএমইএক্স সূচক ২৬ দশমিক ৩৫ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৪৭৯ দশমিক ৪০ পয়েন্টে।