পুঁজিবাজারের আকার বছরে ৩ শতাংশ হারে সঙ্কুচিত হচ্ছে : বিএসইসি কমিশনার

তথ্য প্রকাশে স্বচ্ছতা এখনও পুঁজিবাজারের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ, যা বিনিয়োগকারীদের দীর্ঘদিন ধরে ভোগান্তির কারণ হয়ে আছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কমিশনার মো. সাইফুদ্দিন। তিনি বলেন, যারা পুঁজিবাজারে আছেন তাদের সম্পদ বাড়ছে না, বরং বাজারের আকার বছরে ৩ শতাংশ হারে সঙ্কুচিত হচ্ছে।
বিশ্ব বিনিয়োগ সপ্তাহ ২০২৫ এর ধারাবাহিক কর্মসূচির অংশ হিসেবে বুধবার (৮ অক্টোবর) হাইব্রিড পদ্ধতিতে ‘এমপাওয়ারিং ইনভেস্টরস থ্রু ইমারজিং টেকনোলজি অ্যান্ড ডিজিটাল ফিন্যান্স’ শীর্ষক সেমিনারে প্রধান অতিথি বক্তব্যে এসব কথা বলেন মো. সাইফুদ্দিন।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ, ডিএসই ব্রোকারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ এবং সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ যৌথ উদ্যোগে সেমিনারটি অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে সভাপতিত্বে করেন ডিবিএর প্রেসিডেন্ট সাইফুল ইসলাম। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা ছিলেন ডিএসইর সহকারী মহাব্যবস্থাপক কামরুন নাহার।
মো. সাইফুদ্দিন বলেন, ‘আমাদের পুঁজিবাজারে একটি সম্পূর্ণ ইনভেস্টমেন্ট ইকোসিস্টেম গড়ে তুলতে আমরা এখন কোথায় আছি, তা স্পষ্টভাবে বুঝতে হবে। প্রযুক্তিগত দিক থেকে আমাদের বর্তমান অবস্থা, কাঠামোগত ঘাটতি এবং জবাবদিহিতার জায়গাগুলো চিহ্নিত করা জরুরি। তথ্য প্রকাশে স্বচ্ছতা এখনও পুঁজিবাজারের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ, যা বিনিয়োগকারীদের দীর্ঘদিন ধরে ভোগান্তির কারণ হয়ে আছে।’
মো. সাইফুদ্দিন আরও বলেন, ‘পুঁজিবাজারের প্রযুক্তিগত কাঠামোয় রয়েছে এক্সচেঞ্জ ও অন্যান্য স্টেকহোল্ডার, যেমন সিডিবিএল, সিসিবিএল ইত্যাদি। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এখনও যথাযথ যোগাযোগ ও সমন্বয়ের অভাব আছে। এখন সময় এসেছে সব প্রতিষ্ঠানের একসঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করার।’
বিএসইসি সম্প্রতি একটি বড় উদ্যোগ নিয়েছে—এসবিআরএম ফরম্যাটে আর্থিক প্রতিবেদন দাখিলের ব্যবস্থা চালু করার বলেও জানান বিএসইসি কমিশনার। তিনি বলেন, ‘এটি একটি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন মেশিন-রিডেবল ফরম্যাট, যা আইএফআরএস স্ট্যান্ডার্ড অনুসারে তৈরি। এতে গবেষণা, বিশ্লেষণ ও নজরদারি অনেক সহজ হবে। এটি করতে হলে অডিটরসহ সব স্টেকহোল্ডারদের সহযোগিতার প্রয়োজন।’
প্রোডাক্ট ডাইভার্সিফিকেশন প্রসঙ্গে মো. সাইফুদ্দিন বলেন, ‘অনেকে প্রোডাক্ট ডাইভার্সিফিকেশনের কথা বলেন, কিন্তু প্রকৃত অর্থে এটি ইনভেস্টেবল অ্যাসেট বা বিনিয়োগযোগ্য সম্পদের প্রসার ঘটানো বোঝায়। কেবল নতুন পণ্য নয়, এমন সম্পদ তৈরি করতে হবে যেখানে মানুষ তার ভবিষ্যতের প্রবৃদ্ধি দেখতে পাবে।’
বিএসইসি কমিশনার আরও বলেন, ‘বাস্তবতা হচ্ছে বাজারের অংশগ্রহণ কমছে, ফলে সম্পদের বৈষম্য বাড়ছে। যারা পুঁজিবাজারে আছেন তাদের সম্পদ বাড়ছে না, বরং বাজারের আকার বছরে প্রায় ৩ শতাংশ হারে সঙ্কুচিত হচ্ছে, যা দেশের সামগ্রিক প্রবৃদ্ধির বিপরীত চিত্র। এখনই সময় যৌথভাবে দায়িত্ব নেওয়ার। আর্থিক ইকোসিস্টেমকে পুনর্গঠনের এই দায়িত্ব অত্যন্ত পবিত্র। যত আত্মপক্ষ সমর্থনই করা হোক, বাস্তব ফলাফলই আসল মানদণ্ড।’
‘প্রযুক্তি এখন আমাদেরকে নতুনভাবে গড়ে ওঠার সুযোগ দিয়েছে’ মন্তব্য করে সাইফুদ্দিন বলেন, ‘আগে যেসব কাজে সীমাবদ্ধতা ছিল, আজ তা সম্ভব। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ও আধুনিক প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে আমরা যদি উদ্যোগ নিই, তাহলে পুরো কাঠামোকে বদলে দেওয়া সম্ভব। আসুন, আমরা সবাই মিলে সেটি বাস্তবায়ন করি।’
বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে পুঁজিবাজারে নতুন নতুন প্রোডাক্ট আসছে জানিয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলাম বলেন, ‘সাথে সাথে পুঁজিবাজারে দক্ষতা ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমরা প্রযুক্তিতে বড় বড় বিনিয়োগ করেছি। কিন্তু সেখান থেকে সুফল খুব ভালভাবে পাইনি। একটা বড় কারণ হলো পুঁজিবাজারের স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে সম্বয়ের অভাব। আর্থিক খাত ও পুঁজিবাজারের টেকনোলজি আর্কিটেক্ট করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপের জন্য যদি অবাধ তথ্য প্রবাহ না থাকে, তবে প্রযুক্তির মাধ্যমে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন তার অনেক কিছু সিস্টেম ধরতে পারছে না। এজন্য অনেক অনিচ্ছাকৃত নন-কমপ্লায়েন্স হচ্ছে। এক্ষেত্রে আমাদের কাজ করার সুযোগ রয়েছে।’
মমিনুল ইসলাম আরও বলেন, ‘ফাইন্যান্সিয়াল প্রোডাক্ট নির্ভর করে তার আন্ডারলাইন অ্যাসেটের ওপর। ডিএসইর প্রোডাক্টগুলোর অধিকাংশই হলো ইক্যুইটি। একটি বড় অংশের কোম্পানির তথ্যগুলো সঠিকভাবে আসছে না। সেক্ষেত্রে পুরো দেশের ইকোসিস্টেম পরিবর্তনের প্রয়োজন আছে। আমাদের কার্যক্রমগুলোকে টেকনোলজি ব্যবহার করে ডিজিটাইলাইজ করতে পারলে স্বচ্ছতা বৃদ্ধি পাবে। সেক্ষেত্রে শুধু পুঁজিবাজার নয়, ব্যাংকিং খাত ও রাজস্ব আদায়সহ আরও সব ক্ষেত্রে দক্ষতা বৃদ্ধি করে অর্থনীতিকে আরও দ্রুত সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব।’
পুঁজিবাজারে অটোমেশন ও ডিজিটালাইজেশনের পরও কিছু অনিয়ম ও প্রতারণা ঘটেছে মন্তব্য করে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান এ কে এম হাবিবুর রহমান বলেন, যা ইঙ্গিত করে যে প্রযুক্তির সঠিক প্রয়োগ ও তদারকি এখনও পুরোপুরি কার্যকর হয়নি।
হাবিবুর রহমান আরও বলেন, প্রযুক্তি ব্যবহারের মূল উদ্দেশ্য হলো দক্ষতা, স্বচ্ছতা ও উত্পাদনশীলতা বৃদ্ধি। তবে তা সফল করতে রিপোর্টিং, সারভেলেন্স ও মনিটরিং সিস্টেম শক্তিশালী করা জরুরি।
পুঁজিবাজারের ইকোসিস্টেমে এখনও কিছু ‘মিসিং লিংক’ রয়েছে, যা স্ক্যামের ঝুঁকি বাড়ায় জানিয়ে হাবিবুর রহমান বলেন, এজন্য তথ্যের সঠিক ব্যবহার, যাচাই ও ডিজিটাল টুলস ব্যবহারে দক্ষতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ৭৫ শতাংশের বেশি মানুষের আর্থিক জ্ঞান সীমিত, ফলে অনেক বিনিয়োগকারী গুজবের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেন ও ক্ষতিগ্রস্ত হন। বিনিয়োগের আগে তথ্য যাচাই, উপযুক্ত প্রযুক্তি ব্যবহার ও আর্থিক সাক্ষরতা বৃদ্ধি করতে হবে। প্রযুক্তি সহায়ক হলেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে বিনিয়োগকারীর সচেতনতা ও জ্ঞানই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
বিশ্বের পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়কারী ও তাদের বৈশ্বিক মান নিরূপণকারী প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অব সিকিউরিটিজ কমিশনের (আইওএসসিও) আহ্বানে প্রতিবছরের মত এবছরও বিএসইসির বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সুরক্ষা ও বিনিয়োগ সচেতন করতে নবম বারের মত ৬ থেকে ১২ অক্টোবর ‘বিশ্ব বিনিয়োগকারী সপ্তাহ-২০২৫’ ঘোষণা করে। বিশ্ব বিনিয়োগ সপ্তাহের প্রচারণায় ২০২৫ সালে আইওএসসিও তিনটি প্রধান বিষয়কে গুরুত্ব দিয়েছে। এগুলো হলো—প্রযুক্তি ও ডিজিটাল ফাইন্যান্স, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) এবং জালিয়াতি ও কেলেঙ্কারি প্রতিরোধ।
গত ৬ অক্টোবর ভার্চুয়ালি প্ল্যাটফর্মে পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন স্টেকহাল্ডারদের অংশগ্রহণে ‘বিশ্ব বিনিয়োগকারী সপ্তাহ-২০২৫’ এর শুভ উদ্ভোধন করা হয়। বিএসইসি কার্যালয়ে বিএসইসি চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন।
উদ্বোধনীতে খন্দকার রাশেদ মাকসুদ বলেন, এই সপ্তাহটি বিশ্বব্যাপী বিনিয়োগকারীদের শিক্ষা ও সুরক্ষা প্রচার এবং ব্যক্তি ও সম্প্রদায়ের মধ্যে বিনিয়োগ শিক্ষা বৃদ্ধি করার একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ। আমরা আমাদের বাজারে স্বচ্ছতা এবং বিশ্বাসকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেই। সুশাসন ও জবাবদিহিতার মান বজায় রাখতে এবং নিয়ন্ত্রক কাঠামো আরও শক্তিশালী করতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এর ফলে আমাদের বিনিয়োগকারীরা তাদের লেনদেনে নিরাপদ বোধ করবে এবং বিনিয়োগে আত্মবিশ্বাসী হবে। আসুন, আমরা এই বিশ্ব বিনিয়োগকারী সপ্তাহকে সচেতনতা, ক্ষমতায়ন এবং সহযোগিতার দিকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিই।