সেমিকন্ডাক্টর খাতে চাহিদা মেটাতে ৫০ হাজার দক্ষ জনবল প্রয়োজন
ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেছেন, দেশে সেমিকন্ডাক্ট শিল্পখাতের যথাযথ বিকাশে আমাদেরকে চিপ ম্যানুফেকচারিং, এ্যাসেম্বিলিং ও প্যাকেজিংয়ের ওপর আরও বেশি হারে গুরুত্বারোপ করতে হবে। তাছাড়া সেমিকন্ডাক্টর খাতের চাহিদা মেটাতে ৫০ হাজার দক্ষ জনবল তৈরি একান্ত প্রয়োজন।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত বাংলাদেশে সেমিকন্ডাক্টর শিল্পখাতের সম্ভাবনা শীর্ষক সেমিনার আজ বুধবার (১৫ মে) ডিসিসিআই অডিটোরিয়ামে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রতিমন্ত্রী এসব কথা বলেন।
জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, সামনের দিনগুলোতে প্রযুক্তিখাতের সকল স্তরে ন্যানো চিপের বহুমুখী ব্যবহার বাড়বে, তাই আমাদেরকে এ ব্যাপারে এখনই মনোযোগী হতে হবে। বিশেষ করে শিল্পখাতের প্রয়োজনের নিরিখে দক্ষ জনবল তৈরিতে শিক্ষা ক্যারিকুলাম যুগোপযোগীকরণের করার উপর জোরারোপ করেন। বর্তমান সরকারের উদ্যোগী সারাদেশে বিদ্যুৎ প্রাপ্তি সহ তথ্য-প্রযুক্তিখাতে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও নীতি সহায়তার কারণেই বর্তমানে এখাতে দেশীয় উদ্যোক্তাদের পাশাপাশি বিদেশি উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগের আগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বাংলাদেশে বর্তমানে চারটি প্রতিষ্ঠান সেমিকন্ডাক্টিং খাতে বেশ ভালো করছে জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, তবে এখাতের যথাযথ বিকাশে আমাদেরকে চিপ ম্যানুফেকচারিং, এ্যাসেম্বিলিং ও প্যাকেজিংয়ের উপর আরও বেশি হারে গুরুত্বারোপ করতে হবে। তাছাড়া সেমিকন্ডাক্টর খাতের চাহিদা মেটাতে ৫০ হাজার দক্ষ জনবল তৈরি একান্ত আবশ্যক।
সর্বোপরি এখাতের সার্বিক উন্নয়নে একটি সেমিকন্ডাক্টর পলিসি প্রণয়ন করা হবে বলে মন্ত্রী আশ্বাস দেন এবং উদ্যোক্তাদের আর্থিক সহায়তার জন্য বাজেট বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন বলে মত প্রকাশ করেন। সেই সাথে এখাতের বিকাশে একটি কার্যকর ইকোসিস্টেম তৈরির পাশাপাশি শিল্প ও শিক্ষা খাতের সাথে সরকারের মধ্যকার কার্যকর মেলবন্ধন একান্ত অপরিহার্য বলে জানান।
মন্ত্রী আরও বলেন, ২০৪১ সালে আমাদের ৫০ বিলিয়ন রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে সেমিকন্ডাক্টর খাতের রপ্তানি ১০ বিলিয়ন ডলারের উন্নীত করা আবশ্যক এবং সকলের সম্মিলিত সহযোগিতায় এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব। স্মার্ট বাংলাদেশ বির্নিমাণে বর্তমান সরকার যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে, সেখানে পৌঁছাতে হলে আমাদের স্মার্ট গভর্নমেন্ট, স্মার্ট ইকোনোমির পাশাপাশি স্মার্ট প্রাইভেট সেক্টরের সমন্বয় আবশ্যক।
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জি এস এম জাফরউল্লাহ্ বলেন, এখাতের বিকাশে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের এখনই সময় এবং এলক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সকলকে আরও মনোযোগী হতে হবে। হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের পক্ষ হতে ১০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে টেকনিক্যাল হাব স্থাপন করা হচ্ছে, যেগুলো দক্ষ জনবল তৈরিতে ভূমিকা রাখবে। পদ্মার পাড়ে শিবচরে প্রায় ৭০ একর জমিতে শেখ হাসিনা ইনস্টিটিউট অফ ফ্রন্টওয়ার টেকনোলোজি (শিফট) নামক একটি ইনস্টিটিউিট স্থাপন করা হবে, যেখানে তথ্য-প্রযুক্তিখাতের তরুণ জনগোষ্ঠীকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে গড়ে তোলা হবে, যার অর্থনীতিতে আরও বড় অবদান রাখতে সক্ষম হবে। সারাদেশে ৯৪টি হাইটেক পার্ক স্থাপন করা হবে, যার মধ্যে ২১টি নির্মাণ কাজ প্রায় সম্পন্ন হয়েছে। ঢাকা, সিলেট, রাজশাহী ও যশোরের হাইটেক পার্কগুলোতে শিল্প স্থাপনের জন্য জমি ও প্রয়োজনীয় সুবিধা প্রদান করা যাবে।
অনুষ্ঠানের স্বাগত বক্তব্যে ঢাকা চেম্বার সভাপতি আশরাফ আহমেদ বলেন, বাংলাদেশের রপ্তানির তৈরি পোশাক খাতের নির্ভরতা কাটিয়ে উঠতে আমদানি বিকল্প শিল্পখাতের বিকাশ ও পণ্যের বহুমুখীকরণের লক্ষ্যে সম্ভাবনাময় সেমিকন্ডাক্টর খাতকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে। মোবাইল হ্যান্ডসেট, রিফ্রিজারেটর, এসি ও গাড়ির ব্যবহৃত যন্ত্রাংশ ও কাঁচামাল আমদানিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২৩ অর্থবছরে আমাদের ব্যয় ছিল ১১৮ দশমিক ১৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
ডিসিসিআই সভাপতি বলেন, স্থানীয় শিল্পের বিকাশের পাশাপাশি এখাতে বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণে আমাদেরকে দক্ষ জনবল তৈরির কোন বিকল্প নেই এবং এজন্য আমাদের শিক্ষাক্রমের আমূল পরিবর্তন ও নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার বাড়ানোর উপর মনোযোগী হতে হবে। এছাড়াও সেমিকন্ডাক্টর খাতের বিকাশে ব্যবসা পরিচালনায় লাইসেন্স প্রাপ্তি প্রক্রিয়া সহজীকরণ, সহায়ক নীতি সহায়তা নিশ্চিতকরণ, ঋণ সহায়তা প্রদান বিশেষকরে এখাতের এসএমইদের স্বল্পসুদে ঋণ সুবিধা প্রাপ্তি, ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি বন্ডেড ওয়্যারহাউজ, কর অব্যাহতি সুবিধা প্রদান সহ একটি সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন একান্ত জরুরি মত প্রকাশ করেন আশরাফ আহমেদ।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যানোমেটিরিয়ালস অ্যান্ড সিরামিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. এ এস এম এ হাসীব সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করে বলেন, ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক্স পণ্যের ডিজাইন, চিপ ফেব্রিকশন, এ্যাসেম্বেলিং, টেস্টিং ও প্যাকেজিং প্রভৃতি বিষয়সমূহ প্রধানত সেমিকন্ডাক্টর খাত হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে এবং বর্তমানে এ শিল্পখাতের বৈশ্বিক বাজার ৬৭৩ দশমিক ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যা, ২০৩২ সালে ১ হাজার ৩০৭ দশমিক ৭ বিলিয়নে পৌঁছাবে। তবে এখাতের পণ্যের ডিজাইনে বাংলাদেশের বার্ষিক আয় ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এটি অত্যন্ত শ্রমঘন শিল্পখাত যার প্রায় বৈশ্বিক এটিপির কমপক্ষে ৮১ শতাংশ এশিয়ার দেশসমূহে অবস্থিত।
ড. এ এস এম এ হাসীব উল্লেখ করেন, তাওয়ান, দক্ষিণ-কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, চীন, জাপান ও ভারতের মতো দেশগুলো এখাতে প্রভূত উন্নতি সাধন করছে এবং উল্লেখিত দেশসমূহের সরকার এখাতের বিকাশে ঋণ ও ইকুইটি ইনভেস্টমেন্ট, প্রয়োজনীয় নীতি সহায়তা, কর অব্যাহতি এবং গবেষণা কার্যক্রমে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদান করেছে। যেহেতু আমাদের তরুণ দক্ষ জনবল রয়েছে, এমতাবস্থায় এখাতের ভূরাজনৈতিক সুবিধা গ্রহণের লক্ষ্যে আমাদেরকে সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের আরো মনোযোগী হতে হবে।
সেমিনারের নির্ধারিত আলোচনায় বন্ডস্টেইন টেকনোলোজি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মীর শাহরুখ ইসলাম, সফটওয়্যার টেটোন প্রাইভেট লিমিটেডের সহ-প্রতিষ্ঠা ও ভাইস চেয়ারম্যান রাজীব হাসান, ওয়ালটন ডিজি-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডর অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক লিয়াকত আলী এবং যুক্তরাজ্যের রিডিং বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং অধ্যাপক ড. এম নিয়াজ আসাদুল্লাহ অংশগ্রহণ করেন। ডিসিসিআই ঊর্ধ্বতন সহ-সভাপতি মালিক তালহা ইসমাইল বারী এবং পরিচালনা পর্ষদের সদস্যবৃন্দ সহ সংশ্লিষ্ট খাতের সরকারি ও বেসরকারিখাতের প্রতিনিধিরা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।