মার্কিন নির্বাচন
ট্রাম্পের ইউটোপিয়া বনাম হিলারির বাস্তবতা?
যুক্তরাষ্ট্রের আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অন্তত একটা জায়গায় বিশ্ববাসীকে একমত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে, আর তা হলো মার্কিনিরা নিজেদের যাই ভাবুক না কেন, তাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বেশ বড় একটি ফাটল দেখা দিয়েছে। সে ফাটল ধরা পড়েছে প্রেসিডেন্সিয়াল বিতর্কে ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন হিলারি ক্লিনটনকে 'ন্যাস্টি ওম্যান' বলে গালি দেয় কিংবা একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ হয়ে হিলারি যখন ট্রাম্পের বিরুদ্ধে নারীবিষয়ক সস্তা বিজ্ঞাপনের পেছনে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার খরচ করেন। মূলত যুক্তরাষ্ট্রের এবারের নির্বাচনে জনগণকে 'মন্দের ভালো'কে বেছে নিতে হবে বেশ জটিল হিসাব-নিকাশ কষে। ট্রাম্পের নির্বাচনী ক্যাম্পেইন পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায় যে তিনি আমেরিকান জনগণকে একটা ইউটোপিয়ার স্বপ্ন দেখাচ্ছেন। মিথ হয়ে যাওয়া সেই পুরাতন 'আমেরিকান ড্রিম' মদকে তিনি 'মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন' নামক বোতলে ঢুকিয়েছেন রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যসুবিধা, কর্মসংস্থান ও ট্রিলিয়ন ডলারের উপাদান দিয়ে। অন্যদিকে, হিলারি আবির্ভূত হয়েছেন ওবামা প্রশাসনের লিগ্যাসি হয়ে। তিনি ওবামার সফল কার্যক্রমগুলো চালিয়ে নিতে চান আরো সামনের দিকে আর ব্যর্থ কার্যক্রমগুলো চান ঢেলে সাজাতে।
তিনটি বিতর্কেই ট্রাম্প ওবামা প্রশাসনের গৃহীত অভ্যন্তরীণ পদক্ষেপগুলো ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক চুক্তিগুলো 'সবচেয়ে বাজে' বলে আখ্যায়িত করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ইরানের সঙ্গে করা পারমাণবিক চুক্তিটি (যা ইরানকে প্রায় ১৫০ বিলিয়ন ডলারের সুবিধা এনে দিতে পারে) এমন একটি চুক্তি, যা ইরানের পারমাণবিক প্রকল্পগুলোকে খুব নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ এনে দিয়েছে। ট্রাম্পের মতে, এটি ইরানকে আরো শক্তিশালী করেছে আর বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র পায়নি কিছুই। একইভাবে তিনি সমালোচনা করেছেন ইরাক ও সিরিয়া পরিস্থিতি সামাল দেওয়ায় ব্যর্থতা ও ন্যাটো জোটে আমেরিকার কর্তৃত্ব হ্রাস কিংবা চাঁদার অর্থ আদায়ে ব্যর্থতার বিষয়ে। ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন যে তিনি নির্বাচিত হলে আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলো রিভিউ করবেন। মিত্র রাষ্ট্রগুলোর কাছ থেকে নিরাপত্তা সুবিধা দেওয়ার বিনিময়ে আর্থিক সুবিধা আদায় করে তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে গড়ে তুলবেন একটি সম্পদশালী রাষ্ট্র হিসেবে। পক্ষান্তরে, হিলারি ইরান চুক্তিকে দেখছেন কূটনৈতিক সফলতা হিসেবে। আর্থিক সুবিধার চেয়ে বড় করে দেখছেন মিত্র রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে বিশ্বাস আরো দৃঢ় সম্পর্ক স্থাপনকে।
সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও ওবামা প্রশাসনের গৃহীত 'Affordable Care Act', যা 'ওবামাকেয়ার' নামে পরিচিত, আমেরিকার জনগণের একটি বড় অংশকে স্বাস্থ্যসেবার আওতায় নিয়ে এসেছে, যারা পূর্বে ছিল স্বাস্থ্যবিমার আওতার বাইরে। ট্রাম্পের মতে, ওবামাকেয়ার একটি 'ডিসএ্যাস্টার'। তিনি এই অ্যাক্ট বাতিল করে এমন কিছু করবেন, যা হবে সবার সাধ্যের আওতায়। তিনি স্বপ্ন দেখাচ্ছেন আমেরিকার সব জনগণ (অবশ্যই অবৈধ অভিবাসীদের বাদ দিয়ে, কারণ তিনি তাদের এরই মধ্যে হয় জোর করে দেশে পাঠিয়ে দেবেন কিংবা জেলে পুরে দেবেন!) একটি গ্রহণযোগ্য ও স্বাস্থ্যবিমার আওতায় চলে আসবে। অন্যদিকে, হিলারি মেনে নিয়েছেন 'ওবামাকেয়ার'-এর সীমাবদ্ধতাগুলো। তিনি ভালো করেই জানেন যে বাস্তবে সবার জন্য স্বাস্থ্যবিমা নিশ্চিত করার জন্য যথেষ্ট অর্থনৈতিক ও কাঠামোগত সামর্থ্য এখনো যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে ওঠেনি। তাই তিনি চান, বর্তমান ওবামাকেয়ার-এর ভুলগুলো শুধরে একে আরো গ্রহণযোগ্য করে গড়ে তুলতে।
অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ট্রাম্প সব অবৈধ অভিবাসীকে সার্ভিলেন্সের আওতায় নিয়ে আসার কথা বলেছেন। তিনি সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপ করে শরণার্থীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দেবেন। আমেরিকায় শুধু আমেরিকানদের স্বার্থকেই তিনি সর্বাগ্রে গুরুত্ব দেবেন। এই চরম জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে হিলারি দাঁড়িয়েছেন নারী ও শিশু শরণার্থীদের প্রতি সেই গতানুগতিক মানবিকতার বুলি নিয়ে।
কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে ট্রাম্প আমেরিকানদের দেখাচ্ছেন এক অতিউচ্চাভিলাষী স্বপ্ন। বিদেশি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর সুবিধা কমিয়ে তিনি দেশি প্রতিষ্ঠানগুলো চাঙ্গা করার কথা বলেছেন, প্রয়োজনে ভর্তুকি ও আইনি সুবিধা দিয়ে। তাঁর মতে, এভাবে সৃষ্টি হবে প্রায় ২০ মিলিয়ন নতুন কর্মসংস্থান। মূলত ট্রাম্প আমেরিকাকে গড়ে তুলতে চান তাঁর নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের আদলে, যেখানে শুধু যোগ্যরাই টিকে থাকবে। তিনি জ্বালানি খাতকে ঢেলে সাজাবেন, বৈদেশিক চুক্তিগুলো সম্পাদন করার জন্য নিয়োগ করবেন সফলতম ব্যবসায়িক নেগোশিয়েটরদের। আর এভাবেই যুক্তরাষ্ট্র হয়ে উঠবে ঋণমুক্ত একটি সম্পদশালী দেশ।
‘আমেরিকান ড্রিম’ এমন একটি ভূখণ্ডের স্বপ্ন, যেখানে জীবন হলো সম্পূর্ণ, সবার জন্য প্রাচুর্য আর সামর্থ্য অনুযায়ী সম্ভাবনায় ভরা। এই আমেরিকান ড্রিম বরাবরই একটি মিথ, কোনোকালেই বাস্তবতার মুখ দেখেনি। ট্রাম্প ব্রত নিয়েছেন, এই মিথকে পুনরুজ্জীবন দান করার। অন্যদিকে, হিলারি তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের বাস্তবতাকে পুঁজি করে চেষ্টা করছেন আমেরিকার গৌরবকে ধরে রাখতে। দেখা যাক, ৮ নভেম্বর আমেরিকার জনগণ কী বেছে নেয়—ইউটোপিয়া নাকি বাস্তবতা?
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।