স্পেন সংকট
কাতালোনিয়ার স্বাধীনতা, ইউরোপের মাথাব্যথা
ইউরোপের ফুটবল অঙ্গনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় লড়াই- স্পেনের দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রিয়াল মাদ্রিদ ও বার্সেলোনার দ্বৈরথ। বিশ্ব ফুটবলে যা পরিচিত ‘এল ক্লাসিকো’ নামে। ইউরোপের সবচেয়ে সফল দুটি ক্লাবও রিয়াল-বার্সা। ফলে ফুটবলের কারণে বছরজুড়েই বিশ্বের অনেক মানুষের নজর থাকে স্পেনের দিকে। এবার বিশ্বের দৃষ্টি স্পেনের দিকে পড়তে পারে রাজনৈতিক কারণেও। এখানেও একে-অপরের প্রবল প্রতিপক্ষ মাদ্রিদ (স্পেন) ও বার্সেলোনা (কাতালোনিয়া)।
সম্প্রতি দীর্ঘদিন ধরে জারি থাকা স্বাধীনতার দাবিতে আবার মুখরিত হয়েছে কাতালোনিয়ার রাজপথ। ২৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে কাতালোনিয়ার পার্লামেন্ট নির্বাচন। আর এই ভোটাভুটিকে দেখা হচ্ছে স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ নির্ধারণী নির্বাচন হিসেবে। পার্লামেন্ট নির্বাচনে কাতালোনিয়ার স্বাধীনতার পক্ষ জয়ী হলে জোরতালে শুরু হবে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কর্মকাণ্ড। বার্সেলোনা হবে সেই নতুন দেশের রাজধানী।
অন্যদিকে সমূহ বিপদের আশঙ্কায় কাতালানদের এই দাবি মেনে নিতে নারাজ স্প্যানিশ সরকার। কাতালোনিয়া স্বাধীন হয়ে গেলে খুবই ঝুঁকির মুখে পড়ে যাবে আগে থেকেই টালমাটাল অবস্থার মধ্যে থাকা স্প্যানিশ অর্থনীতি। খুব কাছেই সতর্কবার্তা হয়ে ঝুলে আছে গ্রিস ট্র্যাজেডি। গ্রিসের মতো ঋণগ্রস্ত স্পেনও আছে দেউলিয়া ঘোষণা হওয়ার আশঙ্কায়। স্পেনের পাশাপাশি ইউরোপের মোড়লরাও হয়তো চাইবেন না কাতালোনিয়ার আলাদা হয়ে যাওয়া। কারণ তাহলে নতুন করে আরেকটি বড় সংকটের মধ্যে পড়তে হবে ইউরোপের নীতিনির্ধারকদের। এমনিতেই গ্রিস ও সাম্প্রতিক অভিবাসী পরিস্থিতি বেশ জর্জরিত করে রেখেছে তাদের। কিন্তু কাতালানরাও নাছোড়বান্দা। বহু দিনের লালিত স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে এবার বাস্তবে রূপ দিতে বদ্ধপরিকর কাতালোনিয়ার মুক্তিকামী মানুষ।
১১৬৪ সাল পর্যন্ত খুবই শক্তিশালী একটি স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল কাতালোনিয়া। তারপর এটি যুক্ত হয় অ্যারাগনের সঙ্গে। আর ১৪৬৯ সালে অ্যারাগনের রাজা ফার্দিনান্দ ও স্পেনের রানী ইসাবেলার বিবাহবন্ধনের মধ্য দিয়ে স্পেনের সঙ্গে মিলন ঘটে অ্যারাগন ও কাতালোনিয়ার। তখন থেকেই ধীরে ধীরে স্পেনের কেন্দ্রীয় শাসনের নিয়ন্ত্রণে চলে যেতে থাকে কাতালানরা। ১৭১৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্ত করে দেওয়া হয় কাতালান রাষ্ট্র। তারপর থেকেই নিজেদের স্বকীয় সংস্কৃতি-ঐতিহ্য-ভাষা চর্চার স্বাধীনতা হারাতে হয়েছে বলে অভিযোগ কাতালোনিয়ার মানুষদের। যে নিপীড়ণের চরম রূপ দেখা গিয়েছে জেনারেল ফ্রাঙ্কোর সামরিক শাসনের (১৯৩৯-১৯৭৫) সময়। ১৯৭০ এর দশকের শেষে স্পেনে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর কাতালোনিয়াকে দেওয়া হয় স্পেনের ১৭টি স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চলের মর্যাদা। তবে ভেতরে ভেতরে স্বাধীনতার সুপ্ত বাসনাটাও সবসময় লালন করে গেছে কাতালানরা। সেই দাবি আরও জোড়ালো হয়েছে ২০০৭-০৮ সালের অর্থনৈতিক ধ্বসের পর। নানাবিধ কৃচ্ছ্রতানীতি যারপরনাই অসন্তোষ তৈরি করেছে কাতালোনিয়ায়। ২০১০ সালে কাতালানরা স্প্যানিশ সরকারকে কর দিয়েছে ৬১.৮৭ বিলিয়ন ইউরো। আর তাদের কাছে এসেছে ৪৫.৩৩ বিলিয়ন। কেন্দ্রীয় স্প্যানিশ সরকারের হাতে বিপুল পরিমাণ টাকা চলে না গেলে আরও উন্নয়ন করা যেত বলে কড়া মন্তব্য করেছিল কাতালোনিয়া সরকার।
গত বছরের নভেম্বরে কাতালোনিয়ার স্বাধীনতা নিয়ে আয়োজন করা হয়েছিল একটি অনানুষ্ঠানিক গণভোট। মাদ্রিদে স্পেনের কেন্দ্রীয় সরকার অনেক চেষ্টা করেছিল সেটা রুখে দিতে। কিন্তু শেষপর্যন্ত সফল হয়নি। ২.২ মিলিয়ন ভোটারের ভোটে বিপুলভাবে জয়ী হয়েছিল স্বাধীনতার দাবি। ৮০.৭ শতাংশ মানুষ ভোট দিয়েছিলেন কাতালোনিয়ার স্বাধীনতার পক্ষে।
এবারের পার্লামেন্ট নির্বাচনে অনেকখানি আনুষ্ঠানিক রূপ পেতে যাচ্ছে সেই স্বাধীনতার দাবি। কাতালোনিয়ান পার্লামেন্টের ১৩৫টি আসনের মধ্যে ৬৮টি আসনে জয়লাভ করলেই স্পেন থেকে পৃথক হওয়ার কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করে দেবে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিরা। ইতিমধ্যে তারা গঠন করেছে ‘জান্টস পেল সি’ বা ‘টুগেদার ফর ইয়েস’ নামের একটি জোট। যেখানে আছে কাতালোনিয়ার বর্তমান ও সাবেক তিন প্রধানমন্ত্রীর পার্টি। এই জোট থেকে নির্বাচনে দাঁড়াচ্ছেন বার্সেলোনার সাবেক কোচ পেপ গার্দিওলাও। এই জোটের সঙ্গে আলাদাভাবে কাজ করবে বামপন্থী দল সিইউপি। আর স্বাধীনতার বিপক্ষে লড়বে স্পেনের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মারিনো রাহোর পার্টি পার্তিদো পপুলার (পিপি) ও কাতালোনিয়ার সোশ্যালিস্ট পার্টি (পিএসসি)।
২৭ সেপ্টেম্বরের নির্বাচনে জয়ী হলে দ্রুতই স্বাধীন হওয়ার কাজ শুরু করে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন ‘টুগেদার ফর ইয়েস’ জোটের প্রার্থী রাউল রোমেভা। এল পাইস পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘আমরা স্বাধীনতার ব্যাপারে খুবই আন্তরিক। আর সবাইকে এটা বুঝতে হবে যে আমরা সত্যিই এই প্রক্রিয়া শুরু করব। আমরা সম্ভাব্য সব উপায়ে এটা করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু তারা (স্পেনের কেন্দ্রীয় সরকার) এটা আমাদের করতে দেয়নি। ২০১৪ সালের ৯ নভেম্বরের গণভোটের পর আমরা যেটা করতে পারিনি সেটা করার সময় এবার এসে গেছে।’ নিজেদের স্বাধীন সব প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হবে বলে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন কাতালোনিয়ার প্রেসিডেন্ট আর্থার মাস। কেন্দ্রীয় ব্যাংক, কর কর্তৃপক্ষ, কূটনৈতিক প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ছোট আকারের একটা সেনাবাহিনীও গড়ে তোলার কথা ভাবছেন মাস।
গত ১১ সেপ্টেম্বর কাতালোনিয়ার জাতীয় দিবসে বার্সেলোনার রাজপথ আবার মুখরিত হয়েছিল স্বাধীনতার দাবিতে। প্রায় ১.৪ মিলিয়ন মানুষ কাতালোনিয়ার পতাকা নিয়ে বর্ণিল র্যালি করেছিলেন বার্সেলোনার রাজপথে। তরুণ তরুণীরা নেচে গেয়ে উদযাপন করেছিলেন কাতালানদের স্বকীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। স্বাধীনতার দাবিতে গলা চড়িয়েছেন অনেক প্রবীনও। ফ্রাঙ্কোর একনায়ক শাসনামলে স্বাধীনতার কথা বলতে গিয়ে দীর্ঘদিন জেল খাটতে হয়েছিল ৯১ বছর বয়সী জোয়াকিম ব্যাটলকে। এখন তিনি হাঁটেন ক্রাচে ভর দিয়ে। কিন্তু তাতে বিন্দুমাত্রও কমেনি তাঁর স্বাধীনতার স্পৃহা। ব্যাটল বলেছেন, ‘আমি প্রবল আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছি কাতালোনিয়ার স্বাধীনতার দিকে। আমরা এ জন্য অনেক শতক ধরে অপেক্ষা করছি। আর আমার বিশ্বাস এখন সেই সময় চলে এসেছে।’
২৭ সেপ্টেম্বরের নির্বাচনের পর স্পেন যদি সত্যিই স্বাধীনতার পথে হাঁটা শুরু করে তাহলে আবার বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে স্প্যানিশ অর্থনীতি। কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থমন্ত্রী লুইস ডি গুইনডোস অবশ্য সবাইকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছেন যে, এমন কিছু হওয়া কখনোই সম্ভব না। কিন্তু বিনিয়োগকারীরা এতে আস্থা পাবেন কি না, শেয়ারবাজারে অস্থিরতা শুরু হবে কি না, সেটা নিশ্চিত করে বলার উপায় নেই। কাতালোনিয়ার স্বাধীনতা তখন শুধু স্পেনের সমস্যা হয়ে থাকবে না। পুরো ইউরোপকেই আবার পড়তে হবে নতুন টালমাটাল পরিস্থিতির মধ্যে।
কাতালোনিয়ার স্বাধীনতা নতুন করে ভাবাবে ইউরোপিয়ান ফুটবল অঙ্গনকেও। কাতালোনিয়া স্বাধীন রাষ্ট্র হয়ে গেলে বার্সেলোনা-ভ্যালেন্সিয়ার মতো দলগুলো স্প্যানিশ লিগে খেলবে কি না, বার্সেলোনা ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নস লিগে অংশ নিতে পারবে কি না- ইত্যাদি প্রশ্ন ঝুলে আছে ইউরোপের মাথাব্যথার কারণ হয়ে।
লেখক : সাংবাদিক, এনটিভি অনলাইন।