জলবায়ু সম্মেলন
বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ
আবহাওয়া, জলবায়ু ও পরিবেশ- এই শব্দগুলো বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। কারণ সৃষ্টির সেরা মানবজাতিকে তাদের জন্য একমাত্র পৃথিবী নামক গ্রহটিতে বসবাস করতে হলে, একে মানুষের বসবাসযোগ্য করে নিতে হবে। একসময় ধারণা করা হতো, প্রাকৃতিক দুর্যোগের ওপর মানুষের কোনো হাত নেই, কিন্তু এ কথা আজ পুরোপুরি সত্য নয়। আজ এ কথা সবাই অকপটে স্বীকার করতে দ্বিধা করছেন না যে, প্রকৃতপক্ষে আমরাই আমাদের এ সুন্দর পৃথিবীকে ক্রমাগত ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছি। বিভিন্নভাবেই আমাদের চারপাশের পরিবেশ প্রতিনিয়ত ধ্বংস করছি। নিজেদের সাময়িক ভালো থাকার জন্য সুদূর পর্যবেক্ষণে প্রকৃতপক্ষে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি অগ্নিকুণ্ড রেখে যাচ্ছি।
মানুষের উন্নতির জন্য শিল্পবিপ্লবের ফলে কল-কারখানার বর্জ্য ও কালো ধোঁয়া, রাসায়নিক সংযুক্তি, ইটভাটার ক্ষতিকর কালো ধোঁয়া ইত্যাদির মাধ্যমে সর্বদা পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন (ইএসডিএ)-এর তথ্যমতে, প্রতিবছর এক কোটি ১০ লাখ টন ই-বর্জ্য পরিবেশে যুক্ত হচ্ছে। আমাদের বাংলাদেশে পরিবেশ নিয়ে কাজ করে আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ সংস্থা (আইইউসিএন)-এর গবেষণা রিপোর্টে এসব কারণে বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য নষ্ট হওয়ার বিষয়টি দীর্ঘদিন যাবৎ বলে যাচ্ছেন।
অপরদিকে ইন্টারন্যাশনাল ফান্ড ফর অ্যাগ্রিকালচারাল ডেভেলপমেন্ট (আইএফএডি-ইফাদ)-এর এক গবেষণা রিপোর্টে জানা যায় যে, জলবায়ুর ঝুঁকি প্রতিরোধ ও প্রতিকারে গণমাধ্যমের যে ভূমিকা থাকা প্রয়োজন, সেখানে কৃষিতে জলবায়ু ঝুঁকির বিষয়ে গণমাধ্যমের কোনো ভূমিকা নেই বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যা-ই হোক না কেন, জলবায়ুর যে প্রধান উপাদান বায়ু, পানি ও মাটি সেগুলো আজ দূষণের কবলে পড়ে জন-অস্তিত্ব আজ হুমকির মুখে। তার মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক দূষণ হলো বায়ুতে। বায়ুর অন্যতম প্রধান উপাদান কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বাড়লে তাপমাত্রা বেড়ে যায়, আর তাপমাত্রা বেড়ে গেলে জীবকুলের জন্য তা অভিযোজনে সমস্যা সৃষ্টি হয়। পাশাপাশি মেরু অঞ্চলের জমাকৃত বরফ গলে গিয়ে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়িয়ে দেয়। তলিয়ে যায় উপকূলবর্তী স্থান ও জনপদগুলো, হানা দেয় প্রাকৃতিক দুর্যোগ। মানুষ পরিণত হয় উদ্বাস্তুতে, একেই বলে জলবায়ু উদ্বাস্তু। আর এটাই হলো মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য সংক্ষিপ্ত ক্ষয়ক্ষতির চক্র। জলবায়ু পরিবর্তনের এ বিষয়টি বিশ্বের কোনো একটি একক দেশের বিষয় নয়। এটি একটি সর্বজনীন বিষয়। তাই এর গুরুত্ব অনুধাবন করেই ১৯৯২ সাল থেকেই এ বিষয়ে জোরেসোরে বিশ্বজনীনতা পেতে থাকে বিষয়টি। তারপর ১৯৯৫ সাল থেকে কনফারেন্স অব দ্য পার্টিজ (কপ) নামে প্রতিবছর বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মহাদেশের গুরুত্বপূর্ণ শহরে শীর্ষ পর্যায়ের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে যাচ্ছে। তাই এবারে কপ-২১ অনুষ্ঠিত হয়েছে ফ্রান্সের প্যারিসে তা আমরা সবাই জানি। এ সম্মেলনকে কেন্দ্র করেই প্রয়োজনীয় বিভিন্ন তথ্য প্রকাশিত হচ্ছে।
গবেষণামূলক পরিসংখ্যানে প্রকাশ, বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত প্রথম দশটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ। গত ৩ ডিসেম্বর ২০১৫ সালে জার্মানভিত্তিক জলবায়ু পরামর্শদাতা সংগঠন ‘জার্মান ওয়াচ’-এ প্রকাশিত ‘বৈশ্বিক জলবায়ু ঝুঁকি সূচক-২০১৬’ প্রতিবেদনে এ উদ্বেগজনক তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। সূচকের প্রথমদিকে থাকা অন্য দেশগুলো হলো- হন্ডুরাস, মিয়ানমার, হাইতি, ফিলিপাইন ও নিকারাগুয়া। তা ছাড়া তালিকায় বাংলাদেশের পরে রয়েছে এমন দেশগুলো হলো- ভিয়েতনাম, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড ও গুয়েতেমালা। তার আগে এবারের জাতিসংঘের ৭০তম সাধারণ অধিবেশনের সময় বাংলাদেশ, নেপাল ভুটানসহ ৭০ কোটি মানুষের ২০টি দেশের একটি সংগঠন ভালনারেবল-২০ যাত্রা শুরু করেছে। প্রয়োজনের তাগিদেই গঠিত হয়েছে ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম (সিভিএফ) নামের প্রতিষ্ঠান। আরেকটি রিপোর্ট থেকে জানা গেছে, কপ-২১ সম্মেলনে যোগ দেওয়া ১৯৫টি দেশের মধ্যে বিশ্বের মাত্র ১০টি দেশ ৭০ ভাগ ক্ষতিকারক গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত করে থাকে। আর বাদবাকি ১৮৫টি দেশ নির্গত করে মাত্র ৩০ ভাগ। বেশি গ্রিনহাউস নির্গমনকারী ১০টি দেশের তালিকায় রয়েছে চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপের কয়েকটি দেশ, ভারত, রাশিয়া, জাপান, ব্রাজিল, ইন্দোনেশিয়া, কানাডা প্রভৃতি। সেখানে জলবায়ুর ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলায় করণীয় ও প্রতিশ্রুত তহবিল সংগ্রহ সম্পর্কে আলোচনা হয়েছে সবচেয়ে বেশি। কারণ ক্ষতিগ্রস্ত ও অসহায় দেশেগুলো উন্নত দেশগুলোর সাহায্যের দিকে চেয়ে রয়েছে। সম্মেলনে বিভিন্ন পক্ষ তহবিলের জন্য অনুদান ও অর্থায়নে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি মিলছে। সেগুলোর প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে উন্নত দেশ, বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ বেশকিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠান। তবে সম্মেলনে যোগ দেওয়া ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত এবং প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মুকিত মজুমদার বাবু প্রমুখ বলেছেন, সব সম্মেলনে একই রকমভাবে প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি দিলেও শেষ পর্যন্ত তা ঠিক থাকে না; যেমন ঠিক ছিল না গত বছরের সম্মেলনের প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন।
সম্মেলনের মাঝামাঝি সময়ে এক আলোচনায় স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে জলবায়ু ফান্ডে অর্থ দেওয়ার প্রস্তাব আসার সঙ্গে তাদের মধ্য থেকে ব্যাপক প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। পরে ১৩৪ দেশের জি-৭৭ ও চীন বলেছে যে, শিল্পোন্নত বিশ্বের ৩৭ দেশ ঐতিহাসিকভাবে কার্বন নিঃসরণের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী, কাজেই তারাই এর মোকাবিলায় অর্থ জোগান দেবে। কোপেনহেগেনে জলবায়ু সম্মেলনে হওয়া চুক্তি অনুযায়ী শিল্পোন্নত ৩৭টি দেশ বলেছিল তারা ২০২০ সালের মধ্যে জাতিসংঘ জলবায়ু তহবিলে ১০০ কোটি মার্কিন ডলার দেবে। ২০০৯ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে অর্থের পরিমাণ ১০০ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়াবে। কিন্তু সে অঙ্গীকার তারা পূরণ না করে মাত্র ১০ বিলিয়নের মতো টাকা দিয়েছে। এবার উন্নত দেশগুলো ১০.১ বিলিয়ন ডলার সবুজ জলবায়ু তহবিলে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। একই গ্রুপের ১১টি দেশ স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য ২৪৮ বিলিয়ন ডলার দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে যা এনভায়রনমেন্ট ফ্যাসিলিটি তহবিলের মাধ্যমে দেওয়া হবে, বিশ্বব্যাংক বলেছে, আগামী ২০২০ সালের মধ্যে তারা ২১-২৮ শতাংশ পর্যন্ত এ সহায়তা বৃদ্ধি করবে।
এশিয়া ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক আগামী ২০২০ সালের মধ্যে ৬ বিলিয়ন ডলার দেবে, কানাডা ২.৬ বিলিয়ন, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন দুই বিলিয়ন ইউরো, ফ্রান্স তিন থেকে বাড়িয়ে পাঁচ বিলিয়ন ডলার, যুক্তরাজ্য আগের তুলনায় ৫০ ভাগ বাড়িয়ে ৫.৮ বিলিয়ন ডলার, বেলজিয়াম ২০ মিলিয়ন ইউরো। এ ছাড়া প্রতিশ্রুতির তালিকায় আরো রয়েছে সুইডেন, ডেনমার্ক, পোল্যান্ড, নরওয়ে, নিউজিল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, লুক্সেমবার্গ, লিথুনিয়া, জাপান, ইতালি, জার্মানিসহ আরো অনেক দেশ। ৭ ডিসেম্বর থেকে সম্মেলনের দ্বিতীয়ার্ধে মার্কিন সাবেক ভাইস-প্রেসিডেন্ট ও পরিবেশকর্মী আল গোরের সঙ্গে ‘ফ্রেন্ডস অব দ্য ফিউচার’ শিরোনামে সম্মেলন শেষের আগে বিভিন্ন দেশের ভাবনা নিয়ে জলবায়ু প্রতিরোধবিষয়ক এক মিটিংয়ে বাংলাদেশের পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু অংশ নিয়েছেন। সেখানে বাংলাদেশকে জলবায়ুবিষয়ক উদ্যোক্তা দেশ হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। সেখানে বাংলাদেশ ছাড়াও ব্রাজিল, নেদারল্যান্ড, চিলি, যুক্তরাজ্য, সুইডেন, ত্রিনিদাদ, কঙ্গো, মেক্সিকো, কানাডা, গ্রেনাডা, মার্শাল আইল্যান্ড ও কোস্টারিকার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
একটি কার্যকর চুক্তি বের করে আনার জন্য কপ-২১-এর প্রেসিডেন্ট ও ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী লরেন্ট ফ্যাবিয়াস ১৪ সদস্যের একটি দল গঠন করে দিয়েছেন। দলের সদস্যরা হলেন- গ্যাবনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইমানুয়েল ইসোজ-নগডেট, জার্মানির পরিবেশমন্ত্রী জোসেন ফ্লাসবার্থ, ব্রাজিলের পরিবেশমন্ত্রী ইসাবেলা টেক্সেইরা, সিঙ্গাপুরের পরিবেশমন্ত্রী ভিভিয়ান বালাকৃষ্ণান, নরওয়ের জলবায়ু ও পরিবেশমন্ত্রী টনি সানডটফ, সেন্ট লুসিয়ার প্রযুক্তিমন্ত্রী জেমস ফ্লেচার, জাম্বিয়ার পরিবেশমন্ত্রী ওসমান জারজু, যুক্তরাজ্যের জ্বালানি সেক্রেটারি আম্বার রুড, বলিভিয়ার পরিবেশমন্ত্রী রিনি ওরেলান্না, সুইডেনের পরিবেশ ও জলবায়ু বিষয়কমন্ত্রী আছা রমসন, পেরুর পরিবেশমন্ত্রী ম্যানুয়েল পুলগার ভিডাল, কানাডার পরিবেশমন্ত্রী ক্যাথেরিন ম্যাককানা, ইকুয়েডরের পরিবেশমন্ত্রী ভিসেন্ট ওর্তেগা পাসিসো, সংযুক্ত আরব আমিরাতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুলতান আহমেদ আল-জাবের। সব ধরনের উদ্যোগের ফলে সম্মেলনে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, সেগুলো সামনের দিনগুলোতে বাস্তবায়ন করতে পারলে এবং প্রত্যেকে যার যার জায়গা থেকে সচেতনভাবে সম্মিলিত ব্যবস্থা নিলেই সফল হওয়া যাবে।
লেখক : কৃষিবিদ ও ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল।