বাইডেনের বিজয় ও মার্কিন রাজনীতির ভবিষ্যৎ
যুক্তরাষ্ট্রের ২০২০ সালের নির্বাচনটি ইতিহাসে একটি মাইলফলক। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এত ভোট পড়েনি। এমনকি এত টানটান উত্তেজনাও অন্য কোনো নির্বাচনে ছিল না। সব উত্তেজনার প্রশমন ঘটিয়ে রেকর্ডসংখ্যক ভোট অর্জনের মাধ্যমে ইতিহাস গড়েছেন জো বাইডেন। দেশটির ইতিহাসে সবচেয়ে বয়স্ক প্রেসিডেন্ট হিসেবেও তাঁর অভিষেক হতে যাচ্ছে। এবারের ঘটনা ও উত্তেজনাবহুল মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বেশ কিছু রেকর্ড হয়েছে। এ নির্বাচনের মধ্য দিয়েই প্রথম নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট পেয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। অভিবাসনবিরোধী উত্তেজনা তৈরি করে ক্ষমতায় আসা ডোনাল্ড ট্রাম্পকে প্রত্যাখ্যানের মাধ্যমে মার্কিন জনগণ তাদের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে বেছে নিয়েছে কমলা হ্যারিসকে, যিনি শতভাগ মার্কিন বংশোদ্ভূত নন। ভারতীয় বংশোদ্ভূত এ নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার বিষয়টিকে উগ্র জাতীয়তাবাদের ওপর মার্কিন জনগণের স্পষ্ট চপেটাঘাতই বলা চলে।
বাইডেনের এ বিজয়ে উচ্ছ্বসিত ইউরোপে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশগুলোও। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দেশগুলোর সঙ্গে ট্রাম্পের আমলে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের শুধু অবনতিই হয়েছে। এবার বাইডেন ক্ষমতায় না এলে ট্রাম্প প্রশাসনকে নিয়ে কূটনৈতিকভাবে অনেক ঝামেলা পোহাতে হতো ইউরোপীয় নেতাদের। বাইডেনের বিজয় তাদের সে দুশ্চিন্তা অনেকাংশেই দূর করেছে। অন্যদিকে, প্যারিস চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে আনার মাধ্যমে পরিবেশবাদী মহলে ট্রাম্প যে উদ্বেগের জন্ম দিয়েছিলেন, সেটিও দূর করেছে বাইডেনের বিজয়।
তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প বর্তমানে গোটা নির্বাচনী ব্যবস্থাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করতে জোর প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন। বেশ কয়েক মাস ধরে চেষ্টা করে আসছেন কোনো প্রমাণ ছাড়াই নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগ এনে নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে হেয় করতে। নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগে ট্রাম্পের নির্বাচনী শিবির এবং রিপাবলিকানরা বেশ কিছু মামলা করেছে। তার মধ্যে জর্জিয়া, মিশিগান ও নেভাদার মামলা আমলে নিয়েছেন বিচারকেরা। তবে নিশ্চিত, এসব আইনি চ্যালেঞ্জ দিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ওপর কোনো প্রভাব ফেলবেন না। আইনি লড়াই চালিয়ে যাওয়ার জন্য এরই মধ্যে রিপাবলিকানরা একটি তহবিল গঠন করেছেন। এতে জমা পড়েছে কমপক্ষে ছয় কোটি মার্কিন ডলার।
ট্রাম্প যদি মর্যাদার সঙ্গে পরাজয় স্বীকার করে বিদায় না নেন, তাহলে তাঁর লিগ্যাসি ধ্বংস হয়ে যেতে পারে বলে উদ্বিগ্ন রিপাবলিকানরা। তাঁরা মনে করেন, এতে তাঁর ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক শক্তি ধ্বংস হয়ে যাবে। এমনকি ২০২৪ সালে তাঁর নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ নষ্ট হয়ে যাবে। বাইডেনের হোয়াইট হাউসের পথে যাত্রায় প্রক্রিয়াগত বাধা সৃষ্টি করতে এরই মধ্যে মিশিগানসহ কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে ট্রাম্পের প্রচারশিবিরের করা মামলা যথেষ্ট প্রমাণের অভাবে খারিজ হয়ে গেছে। তার পরও সুপ্রিম কোর্টে বিষয়টি উত্থাপনের সুযোগ খুঁজছেন ট্রাম্প। ট্রাম্পের দাবি, জালিয়াতি করে দ্বিতীয় মেয়াদে তাঁর প্রেসিডেন্ট হওয়া ঠেকিয়েছে ডেমোক্র্যাটরা। পরাজিত হওয়ার পরও বিদায়ী প্রেসিডেন্টের এমন একগুঁয়ে অবস্থানে মার্কিন রাজনীতিতে প্রচণ্ড নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এমনকি রিপাবলিকান রাজনীতিকেরাও এ বিষয়ে যথেষ্ট নাখোশ হয়ে উঠছেন। তাঁদের অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খোলাখুলি এর সমালোচনা করেছেন। তাঁদের মতে, ট্রাম্পের এ অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রে সাংবিধানিক অনিশ্চয়তা তৈরির পাশাপাশি সামাজিক বিভক্তি বাড়ানো ছাড়া আর কোনো কাজেই আসবে না। ট্রাম্পের এমন আচরণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের পথে প্রচণ্ড বাধা হিসেবেও বিবেচনা করা যায়।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়