বিশ্ব রাজনীতিকে উত্তপ্ত করার দায় ট্রাম্পের!
মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে আতঙ্ক অনেক দিনের। চলমান এক অস্থির পরিবেশের মধ্যে ইরান-যুক্তরাষ্ট্র সম্ভাব্য যুদ্ধ নতুন শঙ্কা তৈরি করেছে। একের পর এক ঘটনাপ্রবাহ দুটি দেশকে মুখোমুখি করে তুলেছে। কুদস ফোর্সের কমান্ডার কাসেম সোলেইমানিকে হত্যার মধ্য দিয়ে যেন অনানুষ্ঠানিকভাবে সেই সংকটের সূচনা হলো। এরই মধ্যে ‘উপযুক্ত সময়ে, যথাস্থানে’ কাসেম সোলেইমানিকে হত্যাকাণ্ডের চরম প্রতিশোধ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে ইরান। জনপ্রিয় সমরকৌশলবিদ হিসেবে পরিচিত কমান্ডারকে হারিয়ে ক্ষোভে ফুঁসছে ইরান ও বিশ্বের শিয়া সম্প্রদায়। একই সঙ্গে চীন, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য এ হামলার সমালোচনা করে মধ্যপ্রাচ্যে ইরান-যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধের আশঙ্কা ব্যক্ত করেছে। ওয়াশিংটনের তুলনায় তেহরানের সামরিক শক্তি সামান্য হলেও খামেনির প্রতিশোধের হুঙ্কার বাস্তবে রূপ নিলে যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী বলে অনুমান করা যায়।
সোলেইমানিকে হত্যার পর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রথম জাতীয় পতাকা ব্যবহার করে একটি টুইটে মন্তব্য করেন, সোলেইমানিকে আরো আগেই হত্যা করা উচিত ছিল। ট্রাম্পের এমন মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে এবং হত্যাকাণ্ডের কারণ নির্ধারণে নানামুখী আলোচনায় প্রথমেই যে বিষয়টি সামনে চলে আসছে, সেটি হলো আসন্ন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। মূলত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হতে তিনি এমন জুয়া খেলতে নেমেছেন বলে মনে করছেন অনেকে। কারণ নির্বাচনের বছরে যখন যুক্তরাষ্ট্র প্রবেশ করছে, তখন দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যাচ্ছেন অভিশংসনের মতো এক অস্বস্তিকর প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। উপরন্তু আন্তর্জাতিক পরিসরে তাঁর হাতে তেমন কোনো অর্জন নেই। কিন্তু নির্বাচনের আগে অন্তত একটি বিজয় অর্জন করতেই হয়তো তিনি কাসেম সোলেইমানিকে হত্যা করেছেন।
সঙ্গত কারণেই এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আসন্ন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। নির্বাচনে জয়লাভ করতেই ট্রাম্প এমন ন্যক্কার হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন। সোলেইমানিকে হত্যার পর বর্তমান পরিস্থিতিতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পুনরায় ক্ষমতায় আশা এবং বিশ্ব অর্থনীতিতে এর প্রভাবের ধরন আলোচনায় চলে আসছে। কেননা এক দশকের মন্দাভাব কাটিয়ে যখন প্রবৃদ্ধির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে বিশ্ব অর্থনীতিতে, ঠিক তখনই বিশ্ব রাজনীতিকে উত্তপ্ত করে তোলার দায় ট্রাম্পের ওপরই বর্তাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে চলমান আলোচনা বিশ্ব অর্থনীতিতে স্বস্তি ফেরার ইঙ্গিত দিচ্ছিল। বিশ্বের বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আস্থা ফিরছিল। এমন সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ইরানের সবচেয়ে শক্তিশালী জেনারেলকে হত্যার বিষয়টি কোনোভাবেই ইতিবাচক নয়। এ ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে আন্তর্জাতিকভাবে জ্বালানি তেলের দর বেড়ে গেছে ৪ শতাংশের মতো। ইরান ঘোষণা অনুযায়ী প্রতিক্রিয়া দেখালে জ্বালানি তেলের দরে আগুন লেগে যাবে। তাতে আবারও দুর্বল হয়ে পড়বে বিশ্ব অর্থনীতি। তবে কাশেম সোলেইমানি হত্যার ঘটনায় ইরান কী প্রতিক্রিয়া দেখায়, তার ওপরই নির্ভর করছে অনেক কিছু।
ইরান যদি চুপ থাকে, তাহলে তার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবে। কারণ ট্রাম্প যে জুয়ায় নেমেছেন, তাতে ইরানের চুপ থাকলে তাঁর জয়ের সুযোগ তৈরি হবে। সামরিক শক্তির তুলনায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সামনে ইরান কিছুই না। কিন্তু প্রতিশোধ ছাড়া ইরানের সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই বললেই চলে। সোলেইমানি হত্যার উপযুক্ত প্রতিশোধ, আন্তর্জাতিক বিশ্বে অর্থনীতির নেতিবাচক প্রভাব প্রভৃতি বিষয় এখন সারা পৃথিবীতে তোলপাড় চলছে। অবশ্য সোলেইমানিকে হত্যা করে খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিন্দার মুখে পড়েছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। তাঁর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী ডেমোক্র্যাট দলের নেতারা এই হত্যাকাণ্ডকে ট্রাম্পের বোকামি বলে ‘আখ্যা’ দিয়েছেন। আর মার্কিন সিনেটররা দেশটির প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের যুদ্ধের নির্দেশ দেওয়ার ক্ষমতা প্রত্যাহার করে নিতে মার্কিন কংগ্রেসের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। কারণ এ ঘটনা নতুন করে বিভিন্ন দেশে সহিংসতা ছড়ানোর ক্ষেত্রে কোনো রকম উসকানি হিসেবে দেখা দেবে কি না, সেটা বড় প্রশ্ন।
ইরান-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র হিসেবে পরিচিত বিভিন্ন দেশ কোন পক্ষকে সমর্থন দেবে এটাও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। আগামীতে যেকোনো যুদ্ধ শুরুর পর অতীতের মতো মিত্র হিসেবে পরিচিত দেশগুলো ঢালাওভাবে কোনো দেশকে সমর্থন দেবে না। যুদ্ধ সত্যি বাধবে কি না, সে বিষয়টি নিশ্চিত না হলেও ইরান যে কড়া জবাব দেবে, সেটি নিশ্চিত করেই বলা যায়।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়