আন্তর্জাতিক
আল-আকসায় ইসরায়েলি বর্বরতা
![](https://publisher.ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2017/07/24/photo-1500879999.jpg)
পৃথিবীতে যেসব পবিত্রতম স্থান রয়েছে, তার মধ্যে আল-আকসা তথা জেরুজালেম সবার শীর্ষে অবস্থান করছে। তার কারণ, এ জায়গা বিশ্বের তিনটি বৃহৎ ধর্মের কাছে অত্যন্ত পবিত্র। শতাব্দীর পর শতাব্দী কেটেছে যুদ্ধবিগ্রহে এই জেরুজালেমের দখলদারিত্ব নিয়ে। আগে অসংখ্যবার এ জায়গায় ভবন নির্মাণ ও ধ্বংসের ঘটনা ঘটেছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, হজরত ইব্রাহিম (আ.) পবিত্র কাবা নির্মাণের ৪০ বছর পর জেরুজালেমে এই মসজিদ নির্মাণ করেন। পরবর্তীকালে সোলাইমান (আ.) বায়তুল মোকাদ্দাস পুনর্নির্মাণ ও সম্প্রসারণ করেন। ইসলামের ইতিহাসে দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমরের (রা.) আমলে ৭৩৭ খ্রিস্টাব্দে জেরুজালেম মুসলমানদের দখলে আসে। এ সময়ে ডোম অব রখ বলে খ্যাত সবুজ গম্বুজটি নির্মিত হয়।
মুসলমানদের দখল থেকে জেরুজালেম উদ্ধারের জন্য খ্রিস্টানরা ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ শুরু করে। একাদশ শতাব্দী থেকে চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত জেরুজালেম দখলের জন্য অসংখ্য অভিযান পরিচালিত হয়। ১০৯৯ থেকে ১১৮৭ সাল পর্যন্ত খ্রিস্টানরা জেরুজালেমে তাদের নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত রাখতে সক্ষম হয়। ইতিহাসখ্যাত ফাতেমীয় সুলতান সালাহউদ্দিন খ্রিস্টানদের থেকে ১১৮৭ খ্রিস্টাব্দে জেরুজালেম পুনরুদ্ধার করেন। ১৫১৬ সালে তুর্কি উসমানীয় সুলতানাত জেরুজালেমের দখল বুঝে নেয়। ১৫৩৮ সালে মহান সুলতান সুলেমান জেরুজালেমের চারদিকে প্রাচীর নির্মাণ করে দেন।
প্রথম মহাযুদ্ধে জেরুজালেম আবার মুসলমানদের হাতছাড়া হয়ে যায়। ১৯১৭ থেকে ১৯৪৮ সাল কার্যত সেখানে ব্রিটিশ শাসন কায়েম থাকে। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল নামে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে জেরুজালেম নিয়ে সংকট আরো ঘনীভূত হয়। সে সময় আল-আকসা মসজিদসহ বায়তুল মোকাদ্দাস নিয়ন্ত্রণের জন্য ইসরায়েল, জর্ডান ও স্থানীয় ওয়াকফ এস্টেটের সমন্বয়ে একটি পরিচালনা কমিটি গঠিত হয়। ১৯৫০ সালে পূর্বে স্বাক্ষরিত চুক্তি অস্বীকার করে জেরুজালেমের আন্তর্জাতিক অবস্থান অগ্রাহ্য করে ইসরায়েল জেরুজালেমকে তাদের রাজধানী ঘোষণা করে। অবশ্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এতে স্বীকৃতি দেয়নি।
১৯৬৭ সালে ছয় দিনের লজ্জাজনক পরাজয়ের মাধ্যমে আরবরা পূর্ব জেরুজালেমের ওপর তাদের কর্তৃত্ব হারিয়ে ফেলে। পুরো জেরুজালেম দখল করে নেয় ইসরায়েল। এখন পর্যন্ত সে অবস্থানের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। আল-আকসা, বায়তুল মোকাদ্দাস তথা জেরুজালেম ইসরায়েলের অধিকৃত এবং সরাসরি নিয়ন্ত্রিত এলাকা। মসজিদে মুসলমানদের প্রবেশ, নামাজ আদায় এবং রক্ষণাবেক্ষণ ইসরায়েলি অনুগ্রহের ওপর নির্ভরশীল। দখলকৃত আল-আকসা তথা বায়তুল মোকাদ্দাসে ইসরায়েলি বর্বরতা আর সব ফিলিস্তিনি এলাকার মতো নিত্যনৈমিত্তিক।
এমনই আরেকটি বর্বরতা নিয়ে এখন আন্দোলিত গোটা ফিলিস্তিন। কয়েক দিন আগে সন্দেহভাজন এক ফিলিস্তিনি বন্দুকধারীর গুলিতে দুই ইসরায়েলি পুলিশ নিহত হলে আল-আকসা মসজিদে জুমার নামাজ পড়া বন্ধ করে দেয় ইসরায়েল। এরপর সপ্তাহজুড়ে বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের প্রতিবাদের মুখে মসজিদটি খুলে দেয় ইসরায়েল। কিন্তু সেখানে তারা নতুন করে বিধিনিষেধ আরোপ করে। ৫০ বছরের কম বয়সী মুসল্লিদের মসজিদে প্রবেশ করতে বাধা দেওয়া হয়। ইসরায়েলের বৈষম্যমূলক নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে গত শুক্রবার নামাজ পড়তে এসে ফুঁসে ওঠে মুসলিম জনগণ। তারা বিক্ষোভ শুরু করে ইসরায়েলি দখলদারদের বিরুদ্ধে। এতে ইসরায়েলি পুলিশ গুলিবর্ষণ করে। ঘটনাস্থলেই অন্তত তিনজন ফিলিস্তিনি নিহত হন। আরো ২০০ লোক আহত হয়। আল-আকসা মসজিদে ৫০ বছরের নিচের কোনো মুসলিম প্রবেশ করতে পারবে না বলে বিধিনিষেধ আরোপ করে। প্রতিবাদ আন্দোলনের একপর্যায়ে এক ইসরায়েলি সেটলার জেরুজালেমের রাস আলমুর এলাকায় ১৮ বছর বয়সী এক ফিলিস্তিনি বালককে গুলি করে হত্যা করে।
ফিলিস্তিনি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনী ও রেড ক্রিসেন্ট এ হত্যার কথা নিশ্চিত করেছে। আলজাজিরা জানায়, বিক্ষোভকারী জনগণের ওপর ইসরায়েলি পুলিশ টিয়ার গ্যাস, রাবার বুলেট ও গুলি ছোড়ে। আগেই বলা হয়েছে, আল-আকসা মসজিদ নিয়ে ইহুদি তথা ইসরায়েলিদের ষড়যন্ত্রের অন্ত নেই। ইন্টারনেটের সৌজন্যে এ ধরনের কিছু ঘটনা নিচে বর্ণনা করা হলো :
ইসরায়েলি আক্রমণ-পরম্পরা
১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দের ২১ আগস্ট অস্ট্রেলীয় পর্যটক ডেনিস মাইকেল রোহান কর্তৃক মসজিদে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। রোহান ওয়াল্ডওয়াইড চার্চ অব গড নামক এভাঞ্জেলিকাল খ্রিস্টান গোষ্ঠীর সদস্য ছিলেন। তার ধারণা ছিল যে মসজিদুল আকসা পুড়িয়ে ফেলার মাধ্যমে তিনি যিশুর দ্বিতীয় আগমনকে ত্বরান্বিত করতে পারবেন এবং ইহুদি মন্দির তৈরির পথ করতে পারবেন। রোহানকে এরপর একটি মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সেই বছর রাবাতে মুসলিম দেশগুলোর এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সৌদি আরবের তৎকালীন বাদশাহ ফাহাদ বিন আবদুল আজিজের উদ্যোক্তা ছিলেন। এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ওআইসি গঠনের ক্ষেত্রে প্রভাবকের ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৮০-এর দশকে গুশ এমুনিম আন্ডারগ্রাউন্ড নামক সংগঠনের সদস্য বেন শোশান ও ইয়েহুদা এতজায়ন আল-আকসা মসজিদ ও কুব্বাত আস সাখরা উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেন। এতজায়ন বিশ্বাস করতেন যে স্থাপনা দুটি উড়িয়ে দিলে তা ইসরায়েলের আধ্যাত্মিক জাগরণে ভূমিকা রাখবে এবং ইহুদি জনগণের সব সমস্যা সমাধান করবে। তারা এও ধারণা করতেন যে তৃতীয় মন্দির মসজিদের স্থানে নির্মিত হতে হবে।
প্রথম ইন্তিফাদা চলার সময় ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দের ১৫ জানুয়ারি ইসরায়েলি সেনারা মসজিদের বাইরে বিক্ষোভকারীদের ওপর রাবার বুলেট ও টিয়ার গ্যাস ছোড়ে এবং এতে ৪০ জন মুসলিম আহত হন। ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দের ৮ অক্টোবর দাঙ্গায় ইসরায়েলি সীমান্ত পুলিশ কর্তৃক ২২ জন ফিলিন্তিনি নিহত ও ১০০ জনের বেশি আহত হন। টেম্পল মাউন্ট ফেইথফুল নামক ইহুদি ধর্মীয় গোষ্ঠী তৃতীয় মন্দিরের ভিত্তি স্থাপন করতে যাচ্ছে ঘোষণা করলে এ প্রতিবাদ শুরু হয়েছিল। ২০০০ খ্রিস্টাব্দের ২৮ সেপ্টেম্বর ইসরায়েলের তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা অ্যারিয়েল শ্যারন এবং লিকুদ পার্টির সদস্যরা এক হাজার সশস্ত্র রক্ষীসহ আল-আকসা চত্বর পরিদর্শন করেন। ব্যাপক সংখ্যক ফিলিস্তিনি এর প্রতিবাদ করে। শ্যারন ও লিকুদ পার্টির সদস্যরা স্থান ত্যাগ করার পর হারাম আল শরিফের প্রাঙ্গণে ইসরায়েলি দাঙ্গা পুলিশের ওপর পাথর নিক্ষেপের মাধ্যমে বিক্ষোভ শুরু হয়। পুলিশ টিয়ার গ্যাস ও রাবার ছুড়লে ২৪ জন আহত হন।
এ পরিদর্শনের ফলে পাঁচ বছরব্যাপী আন্দোলন চলে সাধারণভাবে আল-আকসা ইন্তিফাদা নামে পরিচিত। তবে কিছু ধারাভাষ্যকার ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তা, যেমন ইমাদ ফালুজি ও আরাফাতের উদ্ধৃতি দিয়ে দাবি করেন যে ইন্তিফাদা কয়েক মাস আগে ইয়াসির আরাফাতের ক্যাম্প ডেভিড আলোচনা থেকে ফেরার পর থেকে পরিকল্পনা করা হয়েছিল। ২৯ সেপ্টেম্বর ইসরায়েলি সরকার মসজিদে দুই হাজার দাঙ্গা পুলিশ মোতায়েন করে। জুমার নামাজের পর একদল ফিলিস্তিনি মসজিদ ত্যাগ করার পর তারা পুলিশের ওপর পাথর নিক্ষেপ করে। পুলিশ এরপর মসজিদ চত্বরে প্রবেশ করে গুলি ও রাবার বুলেট ছোড়া শুরু করে, ফলে চারজন নিহত ও প্রায় ২০০ জন আহত হয়।
আল-আকসা মসজিদের গুরুত্ব
ইসলামে আল-আকসা মসজিদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মুসলমানরা বিশ্বাস করে, এটি পৃথিবীতে নির্মিত দ্বিতীয় মসজিদ, যা মসজিদুল হারামের পরে নির্মিত হয়। কোরআনে মিরাজের ঘটনা উল্লেখ করার সময় এই স্থানের নাম নেওয়া হয়েছে। রাশিদুন খিলাফতের পরও ইসলামী পণ্ডিতরা একে ঐতিহ্যগতভাবে ‘আল-ইসরা’ বলে উল্লেখ করতেন। এই সুনির্দিষ্ট আয়াতটি ইসলামে ‘আল-আকসা’র গুরুত্বকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এই আয়াতটিতে বলা হয়েছে, ‘পবিত্র ও মহিমাময় তিনি, যিনি তাঁর বান্দাকে রাতারাতি ভ্রমণ করিয়েছেন (মক্কার) মাসজিদুল হারাম হতে (ফিলিস্তিনের) মাসজিদুল আকসায়’ (সুরা-আল ইসরা, আয়াত নম্বর ১)। এই আয়াতটির অনুবাদ ও ব্যাখ্যায় প্রায় সব পণ্ডিতই সুনির্দিষ্টভাবে ‘আল-আকসা’ ও ‘মসজিদ আল-হারাম’ উল্লেখ করেছেন এবং বর্ণিত ‘আল-আকসা’টি যে ‘জেরুজালেমে’ অবস্থিত ‘আল-আকসা’ই তা নিশ্চিত করেছেন।
জেরুজালেম ইসলামে অন্যতম পবিত্র স্থান। কোরআনের অনেক আয়াতই জেরুজালেমকে নির্দেশ করেছে, যার কথা একদম শুরুর দিকের ইসলামী পণ্ডিতরাও বলেছেন। ‘জেরুজালেম’-এর কথা হাদিসেও অনেকবার উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে অবস্থিত মসজিদুল আকসা ইসলামে তৃতীয় সম্মানিত মসজিদ; এবং এ কথা মধ্যযুগের অনেক লিপিতেও উল্লেখ করা হয়েছে। নবী (সা.) বলেছেন, ‘একজন লোক ঘরে নামাজ পড়লে একটি নেকি পান, তিনি ওয়াক্তিয়া মসজিদে পড়লে ২৫ গুণ, জুমা মসজিদে পড়লে ৫০০ গুণ, মসজিদে আকসায় পড়লে ৫০ হাজার গুণ, আমার মসজিদে, অর্থাৎ মসজিদে নববিতে পড়লে ৫০ হাজার গুণ এবং মসজিদুল হারাম বা কাবার ঘরে পড়লে এক লাখ গুণ সওয়াব পাবেন।’ (ইবনে মাজা, মিশকাত) ধর্মীয় কারণে যে তিনটি স্থানে সফরের কথা মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, এই স্থান তন্মধ্যে অন্যতম। বাকি দুটি স্থান হলো মসজিদুল হারাম ও মসজিদে নববি। অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কোঅপারেশন (ওআইসি), ইসলামে তৃতীয় পবিত্র স্থান হিসেবে আল-আকসা মসজিদকে বোঝায় এবং এর ওপর আরবদের সার্বভৌম কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার দাবি করে।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে দেখা যায়, আল-আকসা মসজিদ তথা বায়তুল মোকাদ্দাস নিয়ে মুসলমানদের আবেগ, উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার কোনো কমতি নেই। অতীত ঘেঁটে এ কথা বলা যায় যে, জেরুজালেমের দখল মুসলমানদের ঐক্য, সংহতি ও পারিপার্শ্বিক শক্তির ওপর নির্ভরশীল। শতধাবিভক্ত মুসলিম বিশ্বের সাম্প্রতিক সংকট এই শিক্ষা দেয় যে জেরুজালেম পুনরুদ্ধারের জন্য মুসলমানদের সমন্বিত এবং ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস ভিন্ন গত্যন্তর নেই। যত দিন মুসলিম বিশ্ব তাদের অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা ও ক্ষমতার লড়াই অব্যাহত রাখবে, তত দিন তাদের জন্য কোনো সুসংবাদ নেই।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।