আন্তর্জাতিক
স্বাধীন কুর্দিস্তানের স্বপ্ন সফল হবে কি?
![](https://publisher.ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2017/10/24/photo-1508837101.jpg)
হাজার বছর ধরে আত্মনিয়ন্ত্রাধিকারের জন্য লড়াই করছে কুর্দি জনগোষ্ঠী। ইতিহাসের অনেক নেতিবাচক বাঁক অতিক্রম করে অবশেষে গত ২৫ সেপ্টেম্বর গণভোটে স্বাধীনতার পক্ষে রায় দেয় কুর্দিস্তানের বাসিন্দারা। ইতিহাস যে কুর্দিস্তানের কথা বলে আজকের স্বাধীনতাকামী কুর্দিস্তান সে বিশাল জনপদের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সাম্রাজ্যবাদের কূটকৌশলে কুর্দি জাতি আজ নানা ভূখণ্ডে বিভক্ত। এখন আমরা যে কুর্দিস্তানের কথা বলছি তা ইরাকের একটি আঞ্চলিক সরকার। গৃহীত সাম্প্রতিক গণভোটের পর বাগদাদ সরকারের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটে কুর্দিস্তানের আঞ্চলিক সরকারের। ইরাক সরকার কুর্দিদের স্বাধীনতার প্রয়াসকে দেশের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন হিসেবে দেখছে। কুর্দি অঞ্চলগুলো তেল সম্পদ সমৃদ্ধ। তাই ইরাক তাদের দিতে চায় না স্বাধীনতা। স্বাধীনতা গণভোটের তিন সপ্তাহের মধ্যে গত ১৭ অক্টোবর ২০১৭ ইরাকি কেন্দ্রীয় বাহিনী অভিযান চালায় কুর্দিস্তানে।
প্রথম দিকে খানিকটা প্রতিরোধের চেষ্টা করে কুর্দি বাহিনী। শহরের দক্ষিণে গোলাগুলি হয়। তারা ইরানের সীমান্তবর্তী গুরুত্বপূর্ণ এলাকা থেকেও সরে আসে। তেল সমৃদ্ধ কিরকুক এলাকা পুনর্দখল করে তারা। যদিও এটি ইরাকি কুর্দিস্তানের বাইরে অবস্থিত, সেখানে অনেক কুর্দি বসবাস করে। তারা গণভোটে অংশ নিয়েছিল। কিরকুকের তেলক্ষেত্রগুলোর মালিকানা নিয়ে বিরোধ চলছেই। যেহেতু এটি কুর্দিদের কাছাকাছি অঞ্চলে অবস্থিত তাই তারা দাবি করে তেলক্ষেত্রগুলো তাদের। অপরদিকে বাগদাদ সরকার তাদের সার্বভৌমত্তের সীমারেখোর দোহাই দিয়ে তেলক্ষেত্রগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে। যেহেতু তেলক্ষেত্রগুলো কুর্দিদের অর্থনীতির প্রাণশক্তি, তাই অভিযানের প্রথম থেকেই তেলক্ষেত্রগুলো নিয়ন্ত্রণে নেওয়া ইরাকি বাহিনীর প্রাথমিক লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। বার্তা সংস্থা এএফপি আরো বলেছে যে, ইরাকি বাহিনী আরো কয়েকটি তেলক্ষেত্র দখলে নিয়েছে।
উল্লেখ্য যে, কুর্দিস্তান আঞ্চলিক সরকারের ক্ষমতাবলে দিনে ছয় লাখ ব্যারেল তেল রপ্তানি করে। এর মধ্যে দখলিকৃত ক্ষেত্রগুলো থেকে দিনে আড়াই লাখ ব্যারেল তেল পাওয়া যেত। তেলক্ষেত্রগুলো নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পর সেখানে কুর্দিদের পতাকা নামিয়ে ফেলে ইরাকি বাহিনী। এই তেলক্ষেত্রগুলোর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলায় কুর্দিদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন কঠিন হয়ে পড়বে। উল্লেখ্য, কুর্দি অঞ্চলে গৃহীত স্বাধীনতার গণভোটের স্বপক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন খুবই সীমিত। প্রতিবেশী দেশগুলো তাদের আওতায় থাকা ভবিষ্যৎ কুর্দি বিচ্ছিন্নতার আশংকায় কঠোর মনোভাব গ্রহণ করেছে। এর আগে কুর্দিদের স্বাধীনতার প্রতি যুক্তরাষ্ট্রকে সহানুভূতিশীল বলে মনে হলেও এখন তারা বলছে গণভোট নিয়ে সৃষ্ট সংকটে কোনো পক্ষ অবলম্বন করবে না যুক্তরাষ্ট্র। বরং চলমান সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে দুই পক্ষকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছে তারা। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র নাওয়ার্ট বলেছেন, কেন্দ্রীয় ও আঞ্চলিক সরকার যৌথভাবে শান্তিপূর্ণ উপায়ে ওই অঞ্চলের প্রশাসন চালাবে এটাই যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাশা।
গণভোটের ইতিকথা
ইরাকের স্বৈরাচারী শাসক সাদ্দাম হোসেনের পতনের পর পাশ্চাত্যের বিভাজন নীতি অনুযায়ী কুর্দি জনগোষ্ঠী কিছুটা রাজনৈতিক সুবিধা অর্জন করে। সাদ্দাম হোসেন কর্তৃক নির্যাতিত কুর্দি জনগোষ্ঠী মার্কিনিদের স্বাগত জানায়। ১৯৯০-এর দশকে প্রতিকূল ভূরাজনৈতিক পরিবেশ সত্ত্বেও কুর্দিরা রাজনৈতিক সুবিধা লাভ করে। ১৯৯২ সালের নির্বাচনে সে সুবিধার প্রতিফলন দেখা যায়। ঐতিহাসিক নির্বাচন এবং পশ্চিমাগোষ্ঠী কর্তৃক ইরাকের উত্তরাঞ্চলে ‘নো ফ্লাই জোন’ সৃষ্টির কারণে কুর্দিরা কৌশলগত সুবিধা ভোগ করে। কুর্দি জাতি আঞ্চলিক বিভক্তির কারণে কখনো অভিন্ন নীতি গ্রহণ করতে পারেনি। ১৯৯০-এর দশক থেকে তুরস্ক ইরাকি কুর্দিস্তানকে ক্ষমতার গুটি হিসেবে ব্যবহার করে তুর্কি কুর্দিস্তানকে সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেছে। উল্লেখ্য, তুরস্কে বিগত ৪০ বছর ধরে কুর্দি জনগোষ্ঠী স্বাতন্ত্রের জন্য লড়াই করে আসছে। কুর্দিস্তান ওয়ার্কাস পার্টি- পিকেকে নিয়মতান্ত্রিক এবং অবশেষে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে স্বতন্ত্র জাতিসত্তার জন্য সংগ্রাম করছে। অথচ কুর্দিদের অপর দুটি রাজনৈতিক দল- কেডিপি ও পিইউকে তুর্কি সরকারের সঙ্গে রয়েছে।
২০০৩ সাল থেকে ইরাকি কুর্দিস্তানকে এক রকম মেনে নেওয়ার চেষ্টা করে তুরস্ক। রাষ্ট্রিক বিভাজনের কারণে আঙ্কারা মনে করছিল যে, ইরাকি কুর্দিস্তান তাদের মিত্র হয়ে থাকবে এবং ওই অঞ্চলের গ্যাস সম্পদে তারা ভাগ বসাতে পারবে। এ ছাড়া ইরাকি কুর্দিস্তান তুরস্ক ও ইরান প্রভাবিত বাগদাদ সরকারের মধ্যবর্তী ‘বাফার স্টেট’ হিসেবে কাজ করবে বলে তুর্কিদের ধারণা ছিল। এ সময়ে তুর্কিরা ইরাকি কুর্দিস্তানে ভালো বিনিয়োগ করে। সাম্প্রতিক সিলীয় যুদ্ধে সামগ্রিকভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে। ইরাকের দুর্বল রাষ্ট্রীয় কাঠামো এবং গৃহযুদ্ধের সুযোগে কুর্দিরা শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এর ধারাবাহিকতায় ইরাক, তুরস্ক ও ইরানের সংযোগস্থলে অবস্থিত ইরাকি কুর্দিস্তানের আঞ্চলিক পার্লামেন্ট স্বাধীনতার প্রশ্নে ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭ গণভোট অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নেয়। গৃহীত প্রস্তাব অনুযায়ী ২৫ সেপ্টেম্বর তিনটি আঞ্চলিক প্রদেশে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। তবে অস্থিতিশীল মধ্যপ্রাচ্যের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা এই অঞ্চলের স্বাধীনতা অর্জনের তৎপরতায় নাখোশ যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান। আন্তর্জাতিকভাবে পরস্পর বৈরিতা সত্ত্বেও কুর্দি দমনে উভয় পক্ষ একমত। তুরস্ক পূর্বেকার সখ্যতা ভুলে ইরাকি কুর্দিস্তানের গণভোটে বিপদের আংশকা করছে। তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগান ইতিমধ্যে কুর্দি প্রশ্নে অভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তেহরান সফর করেছেন। ইরাকি কুর্দিস্তানের আঞ্চলিক সরকারের প্রেসিডেন্ট ও ক্ষমতাসীন দলের নেতা মাসুদ বারজানি গণতান্ত্রিক উপায়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের বিষয়টি এগিয়ে নিতে চান। তবে সংলগ্ন প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো সবাই কুর্দি স্বাধীনতার বিরোধী।
কুর্দিদের পরিচয়
কুর্দিরা ইন্দো ইউরোপীয় জনগোষ্ঠীর লোক। তাদের ভাষা কুর্দিস-ফারসি ভাষা উদ্ভূত। বর্তমান পর্যায়ে তারা আরব, আর্মেনীয়, সিরীয়, আজারবাইজানি এবং তুর্কি জনগোষ্ঠীতে একীভূত। প্রায় সব কুর্দি ইসলাম ধর্মের অনুসারী। কিছু অংশ ইহুদি, খ্রিস্টান, ইয়াজিদি, আলেভিস ধর্মেরও আছে। প্রায় সব ইহুদিই এখন ইসরায়েলের স্থায়ী বাসিন্দা।
কুর্দিদের ইতিহাস
পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন জনগোষ্ঠী এই কুর্দিরা। প্রাচীন আমল থেকেই হরমুজ থেকে আনাতোলিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল তাদের বিচরণ। পারস্য এবং পরে রোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল এই অঞ্চল। আলেকজান্ডারের সময়ে অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতাব্দীতে কার্ডুসি বা কুর্দিস্তান নামে জনপদের সন্ধান পাওয়া যায়। প্রাচীন আশেরীয় ও ব্যবিলনীয় সভ্যতার দাবিদার এই কুর্দি জনগোষ্ঠী একাদশ এবং দ্বাদশ শতাব্দীতে এসব অঞ্চলে বেশ কয়েকটি কুর্দি শাসিত সমৃদ্ধ রাজ্য ছিল। এসব রাষ্ট্র ইসলামী খেলাফতের প্রতি আনুগত্যশীল ছিল। ১৮০৩ সালের এক মানচিত্রে কুর্দি শাসিত অঞ্চল প্রদর্শিত হয়। ষোড়শ শতাব্দীতে কুর্দি জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত অঞ্চল অটোমান সাম্রাজ্য এবং সাফাভিত সাম্রাজ্যে বিভক্ত ছিল। তখন থেকে প্রথম মহাযুদ্ধে উসমানীয় সালতানাতের পতন পর্যন্ত কুর্দি শাসিত রাজ্যগুলোর স্ব-স্বাধীন অবস্থা ছিল। প্রথম মহাযুদ্ধের পর মিত্রশক্তি যোদ্ধাজাতি কুর্দিদের সিভার্স চুক্তি অনুযায়ী কয়েকটি দেশের মধ্যে বিভক্ত করে দেয়। এই বিভাজন অনুযায়ী কুর্দিরা অন্তত পাঁচটি রাষ্ট্রের মধ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে।
এসব রাষ্ট্র হচ্ছে ইরাক, ইরান, সিরিয়া, তুরস্ক এবং আর্মেনিয়া। মিত্রশক্তি পুরো কুর্দি অঞ্চল তাদের মধ্যে বিভাজনে অবশেষে ব্যর্থ হয়। তুর্কি বীর কামাল পাশার অগ্রাভিযানের ফলে তারা লাওসানি চুক্তি স্বাক্ষরে বাধ্য হয়। এইভাবে কুর্দিদের জন্য একটি পৃথক রাষ্ট্র গঠনের পরিবর্তে কুর্দিরা নানা রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে পড়ে। উল্লেখ্য, ইরাক ও সিরিয়া প্রথম মহাযুদ্ধের সমাপ্তি চুক্তি অনুযায়ী ব্রিটেন ও ফ্রন্সের নিয়ন্ত্রণাধীন তথাকথিত তদারকি রাষ্ট্রে পরিণত হয়। ১৯৪৫ সালে জাতিসংঘ সম্মেলনে কুর্দি প্রতিনিধিদল পৃথক কুর্দি রাষ্ট্রের আবেদন জানায়। তারা ইরাকের বসরা থেকে তুরস্কের জাগ্রজ পর্যন্ত বিরাট অঞ্চলের উপর তাদের সার্বভৌমত্ত দাবি করে। প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের পর ১৯৯২ সালে ইরাকি কুর্দিস্তান প্রথম বারের মতো বিরাজিত আন্তর্জাতিক বাস্তবতার সুযোগে আঞ্চলিক সরকার ও সংসদ লাভ করে।
২০১০ সালে প্রকাশিত মার্কিন প্রতিবেদনে ২০৩০ সালের মধ্যে কুর্দিস্তানের স্বাধীন সত্তার আভাস দেওয়া হয়। ২০১৪ সালে ইরাক এবং সিরীয় অঞ্চলে তথাকথিত ইসলামিক স্টেটের আবির্ভাব হলে কুর্দি জনগণের জন্য স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের সুযোগ সৃষ্টি হয়। ওই বাস্তবতায় তুর্কিরা ইরাকি কুর্দিস্তানের প্রতি নমনীয় থাকলেও বর্তমানে তুরস্কে এর প্রভাব চিন্তা করে তারা ব্যাপক বৈরিতা প্রদর্শন করছে।
কুর্দিদের ভৌগোলিক দাবি
Encyclopedia Britannica-এর মতে কুর্দিদের দাবিকৃত ভৌগোলিক অঞ্চলের পরিমাণতিন লাখ ৯২ হাজার বর্গকিলোমিটার। এদের তুর্কি প্রধান শহর দিয়া-আর-বাকির। ইরবিল এবং সোলেমানী ইরাকি প্রধান শহর। ইরানে অবস্থিত কুর্দিদের বড় বড় শহর হচ্ছে কেরমান শাহ্, সানান্দাজ, ইলাম ও মাহাবাত। ইসলামি বিশ্বকোষের হিসাব মতে, তুরস্কে তাদের অঞ্চলের পরিমাণ এক লাখ ৯০ হাজার বর্গকিলোমিটার, ইরানে এক লাখ ২৫ হাজার বর্গকিলোমিটার, ইরাকে ৬৫ হাজার বর্গকিলোমিটার এবং সিরিয়ায় ১২ হাজার বর্গকিলোমিটার। ইরাকে কুর্দি অধ্যুষিত ছয়টি প্রদেশ রয়েছে। ইরানি কুর্দিস্তান প্রদেশ এবং পশ্চিম আজারবাইজান, কেরমান শাহ্ এবং ইলাম নিয়ে ইরানি কুর্দি জনগোষ্ঠীর বসবাস।
সিরীয় কুর্দিরা দেশের উত্তরাঞ্চলে বসবাস করে। যেসব অঞ্চলে কুর্দিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ সেগুলো হচ্ছে আল হাশাকাহ, উত্তর রাক্কা, আলেপ্পো এবং জাবাল আল আকরাদ। তুরস্কের পূর্ব আনাতোলিয়া অঞ্চল এবং দক্ষিণ পূর্ব আনাতোলিয়া নিয়ে তুর্কি অঞ্চল গঠিত। এখানে ১৫ থেকে ২০ মিলিয়ন কুর্দি বসবাস করে। ভূগোলবিদরা সমগ্র অঞ্চলকে দুভাগে বিভক্ত করেন- উচুঁ অঞ্চল ও নিম্ন অঞ্চল।
কুর্দিদের স্বাধীনতার সংগ্রাম
তুর্কি বীর কামাল পাশা যখন পূর্ব আনাতোলিয়ার কুর্দি জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত অঞ্চল দখল করেন তখন থেকেই কুর্দিরা স্বাধীনতার আন্দোলন করে আসছে। এই অঞ্চলে কুর্দি বিরোধী অনেক সহিংসতা ঘটে। কুর্দিরা বারবার বিদ্রোহ করে। এভাবে ১৯২০, ১৯২৪, ১৯৩৭ এবং বর্তমানে তারা তুরস্ক সরকারের সশস্ত্র যুদ্ধে অবতীর্ণ রয়েছে। ১৯২৫ সাল থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত কুর্দি অঞ্চল সামরিক অঞ্চল ঘোষিত হয়। সেখানে বিদেশী পর্যটকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকে।
১৯৯১ সালে তুরস্ক তাদের কুর্দি জাতিসত্তা মুছে দেওয়ার প্রয়াসে তাদেরকে পার্বত্য তুর্কি হিসাবে অভিহিত করে। এমনকি কুর্দি, কুর্দিস্তান এবং কুর্দি ভাষা সংস্কৃতি নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৯০ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত কুর্দিদের রাজনৈতিক দল গঠন এবং কুর্দিদের প্রতিনিধিত্ব নিষিদ্ধ থাকে। ১৯৮৩ সালে কুর্দি অঞ্চলে সামরিক শাসন জারি করা হয়। এ সময় Kurdistan Workers Party নামে স্বাধীনতাকামী সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। ৮০ থেকে ৯০ সাল পর্যন্ত গেরিলা যুদ্ধ চলে। হাজার হাজার মানুষকে ঘরবাড়ি থেকে বিতাড়ন করা হয়। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। কুর্দি অঞ্চলে খাদ্য সরবরাহে বিধি নিষেধ আরোপিত হয়।
একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী এ সময়ে ২০ হাজার কুর্দি নিহত হয়। ২০১৪ সালে সিরিয়া এবং ইরাকে অবস্থিত কুর্দিরা স্বাধীনতার আন্দোলন শুরু করে। কুর্দিরা এসব দেশে তথাকথিত ইসলামিক স্টেটের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। তারা সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের সুযোগে কখনো পক্ষ কখনো বিপক্ষে অবস্থান করে তাদের অবস্থানকে সংহত করার চেষ্টা করে। এখনো একাংশ বাশার আল আসাদের হয়ে লড়ছে এই আশায় যে, অবশেষে তারা একটি স্ব-শাসিত অঞ্চল পাবে। অপরদিকে তাদের এই পরস্পর বিরোধী অবস্থানে ক্ষিপ্ত অন্যরা। আল নুসরা ফতোয়া দিয়েছে যে, কুর্দিদের হত্যা করা জায়েজ।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানে জাতি ও রাষ্ট্রের বিবিধ সংজ্ঞা রয়েছে। ধর্ম, বর্ণ, নৃগোষ্ঠী, অঞ্চল, অর্থনীতি ও রাজনীতি ইত্যাদি বিষয়গুলো জাতি গঠনের উপাদান। এক কথায় বলা হয় ‘Sentiment of Oneness’ বা একই মনোভাবের মানুষ হলেই জাতি রূপে পরিগণিত হয়। এই জাতিগোষ্ঠী যখন তার সুদীর্ঘ সংগ্রাম, স্বকীয়তা এবং ধারাবাহিকতা দ্বারা একটি সংগঠন বা সরকার গঠনে সক্ষম হয় তাহলেই তারা জাতিরাষ্ট্র গঠন করে। ইতিহাসের স্তরে স্তরে রয়েছে কুর্দি জনগণের গৌরবোজ্জল অবদান। মধ্যযুগে ধর্ম যুদ্ধ বা ক্রুসেডের প্রেক্ষাপটে জেরুজালেম যখন খ্রিস্ট ধর্মের পদানত তখন মিসরের ফাতেমীয় শাসক হজরত সালাহ উদ্দীন আইয়্যুবী (রহ:) মহামতি রাজা রিচার্ডের মুখোমুখি হয়ে জেরুজালেম পুনরুদ্ধার করেন। তিনি কুর্দি বংশোদ্ভুত ছিলেন। উপর্যুক্ত বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, কুর্দি জনগোষ্ঠী একটি জাতিরাষ্ট্র গঠনের দাবি রাখে। দেখা যায় যে, মধ্য যুগে কুর্দি রাষ্ট্রগুলো স্ব-স্বাধীন ছিল। স্বাধীন জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য তাদের রয়েছে সুদীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস। সাম্রাজ্যবাদ কখনোই এ ধরনের জাতিগুলোকে স্বাধীনতা অর্জনের অধিকার দেয়নি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অধিকার একটি অর্জনের বিষয়। মধ্যপ্রাচ্যের জটিল রাজনীতির আবহাওয়ায় কুর্দি রাষ্ট্রের প্রকাশ বিকাশ এবং লালন একটি কঠিন বাস্তবতা। এতদ্ব সত্ত্বেও আমরা আশা করব কুর্দি জনগণের রক্তপাত বৃথা যাবে না।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।