জিম্বাবুয়েতে সামরিক অভ্যুত্থানে কলকাঠি নাড়ছে কারা?
![](https://publisher.ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2017/11/18/photo-1510981786.jpg)
আফ্রিকার দেশ জিম্বাবুয়েতে রাজনৈতিক সংকট ঘনীভূত হওয়ার পর অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে রাজধানী হারারের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে দেশটির সেনাবাহিনী। যদিও জিম্বাবুয়ের সেনাপ্রধান জেনারেল কনস্ট্যানটিনো চিয়েঙ্গা বলেন, ‘এটি সেনা অভ্যুত্থান নয় এবং প্রেসিডেন্ট মুগাবে নিরাপদে আছেন।’
প্রেসিডেন্ট মুগাবে গত সপ্তাহে তাঁর ভাইস প্রেসিডেন্ট এমারসন নানগাগওয়াকে বরখাস্ত করলে এই রাজনৈতিক সংকটের সূচনা হয়। মি. নানগাগওয়াকে এত দিন প্রেসিডেন্ট মুগাবের উত্তরসূরী ভাবা হলেও সম্প্রতি তাঁর জায়গায় ফার্স্ট লেডি গ্রেস মুগাবের নাম সামনে চলে আসে।
দৃশ্যত স্ত্রী গ্রেসি মুগাবেকে ক্ষমতার স্বাদ দিতে গিয়ে নিজের বিপদ ডেকে এনেছেন জিম্বাবুয়ের প্রেসিডেন্ট রবার্ট মুগাবে। তাঁর ক্ষমতার মেয়ার প্রায় ৪০ বছর ছুঁই ছুঁই। তার পরই ক্ষমতার মসনদে স্ত্রীকেই দেখতে চেয়েছিলেন তিনি। তাই সরিয়ে দেন ভাইস প্রেসিডেন্ট এমারসন নানগাগওয়াকে। এতেই জিম্বাবুয়ের রাজনীতির পারদ তুঙ্গে উঠতে থাকে। রাজধানীতে মঙ্গলবার রাতেই হারারেবাসী প্রত্যক্ষ করে সেনা টহল। সাজোয়া যান।
এটা স্পষ্টত সামরিক অভ্যুত্থান হলেও সেনাবাহিনী কৌশলে একে অভ্যুত্থান বলছে না। জিম্বাবুয়ের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মরগান সাঙ্গিরাইয়ের সাবেক একজন রাজনৈতিক সহযোগী অ্যালেক্স মাগাইসা বলেন, যা-ই বলেন, যেভাবেই বলেন এটা অন্য নামে একটি সামরিক অভ্যুত্থান। তারা দেখাতে চাইছে যে, এখনো দেশের নেতা আছেন প্রেসিডেন্ট মুগাবে। কিন্তু বাস্তবে সেখানে মূল চালিকাশক্তি হিসেবে রয়েছে অবশ্যই সেনাবাহিনী।
তবে জিম্বাবুয়েতে সামরিক অভ্যুত্থানের পেছনে কারা কলকাঠি নাড়ছে?- এমন প্রশ্ন বিশ্ববাসীসহ জিম্বাবুয়ের নাগরিকদের। অনেকেই বলছে, বিরোধী দলের শতভাগ আশ্বাস, বহিষ্কৃত ভাইস প্রেসিডেন্ট এমারসন নানগাওয়া ও দলের বঞ্চিত প্রবীণ নেতাদের আশ্বাসে জিম্বাবুয়ের সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করেছে।
তবে বিদেশি দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে প্রশ্ন তোলা হয়েছে যে, জিম্বাবুয়েতে সামরিক অভ্যুত্থানের পেছনে কি চীনা কানেকশান থাকতে পারে?
জিম্বাবুয়ের প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রধান জেনারেল কনস্টেনটিনোর গত সপ্তাহের চীন সফরে যান। সেখানে বেশ কয়েকজন কর্তা ব্যক্তির সঙ্গে তিনি সাক্ষাৎ করেন। চীন থেকে ফিরেই তিনি দেশে সামরিক হস্তক্ষেপ শুরু করেন বলে অভিযোগ উঠে ।
গত ১০ নভেম্বর (শুক্রবার) চীন থেকে ফেরার পর আকস্মিক দখল করেন দেশটির রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন। গৃহবন্দি করেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট মুগাবেকে। এরপর প্রেসিডেন্ট মুগাবেকে ক্ষমতা থেকে সড়ে দাঁড়ানোর জন্য ক্রমাগতভাবে চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন।
শুধু তাই নয়। চীন সরকার সেনাবাহিনীকে গ্রিন সিগনাল দিয়ে থাকতে পারে বলে আন্তর্জাতিক মহল আশঙ্কা করছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এর কারণ হিসেবে তারা বলছে, দেশটিতে চীনের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব রয়েছে। জিম্বাবুয়ের কৃষি, বিদ্যুৎ এবং নির্মাণ খাতে দেশটির বড় অঙ্কের বিনিয়োগ রয়েছে।
রিপোর্টে আরো বলা হয়, ১৯৭০ সালে জিম্বাবুয়ের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় চীন সরাসরি দেশটিতে প্রচুর অস্ত্র ও অর্থ দিয়েছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের নায়ক বর্তমান প্রেসিডেন্ট রবার্ট মুগাবেও চীনের সঙ্গে মিত্রতা বজায় রেখে চলছিলেন। ২০০২ সালে যখন ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র জিম্বাবুয়ের ওপর অবরোধ আরোপ করতে চাইছিল, চীন তখন ১০০টির বেশি প্রকল্পে বিনিয়োগ করে। পাশাপাশি বেইজিং জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলের নেওয়া জিম্বাবুয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার উদ্যোগকেও ভেটোর মাধ্যমে আটকে দেয়।
তবে সম্প্রতি মুগাবে অনেকটা কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে উঠছিল বলে দলের মধ্যে অভিযোগ রয়েছে। ২০১৫ সালে দেশটিতে সফরকালে চীনা প্রেসিডেন্ট সি জিনপিং পাঁচ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের কথা বলেন। এ সময় জিম্বাবুয়েকে সব সময়ের বন্ধু বলে তিনি ঘোষণা করেন।
তবে সম্প্রতি মুগাবে অনেকটা কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে উঠছিলেন বলে দলের মধ্যে অভিযোগ রয়েছে। এতে চীনের সঙ্গেও মুগাবের একটি দূরত্ব তৈরি হয়। চীন তার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে মুগাবের ওপর আর নির্ভর করতে পারছে না বলেও জানা যায়।
গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, জিম্বাবুয়ের সামরিক বাহিনীকে ১৯৮০ সাল থেকেই সহযোগিতা করে আসছে চীনা সেনাবাহিনী। চীন সরকার নিজস্ব অর্থায়নে জিম্বাবুয়ের প্রতিরক্ষা কলেজ নির্মাণ করে । শুধু তাই নয়, দেশটির সামরিক বাহিনীকে সামরিক প্রশিক্ষণও দেয় তারা।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, জেনারেল কনস্টেনটিনো নিয়মিত চীনা সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে আসছেন। চীনের প্রতিরক্ষা বিভাগের প্রধান চেং ওয়াংকুয়ান ২০১৫ সালে হারারে সফরকালে কনস্টেনটিনোর সঙ্গে উষ্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়।
কিন্তু জিম্বাবুয়ের সেনাপ্রধানের চীন সফরের কারণ সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো আভাস মেলেনি কোথাও। তবে সেনাপ্রধানের সঙ্গে বহিষ্কৃত ভাইস-প্রেসিডেন্ট এমারসনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা জানা গেছে আল-জাজিরার এক প্রতিবেদন থেকে।
অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির আফ্রিকার ইতিহাস ও রাজনীতির প্রভাষক মাইলস ব্লেসিং টেন্ডি মনে করেন, মুগাবের ভাগ্য সম্পর্কে চীন আগে থেকেই জানত-তা নিশ্চিত হয়ে বলার উপায় নেই। তবে তিনি মনে করেন, সার্বভৌমত্বের প্রতি চীনের শ্রদ্ধা থাকার কারণে অভ্যুত্থানে তাদের ভূমিকা প্রচলিত ধরনের হবে না। মাইলস বলেন, ‘অভ্যুত্থান যেখানে অস্থিতিশীলতার জন্ম দেয় চীন সেখানে সবসময়ই স্থিতিশীলতার কথা বলে। ফলে দৃশ্যত মনে হয় না অভ্যুত্থানের সঙ্গে চীন জড়িত। এ ধরনের কোনো কিছুর পরিকল্পনা গোপনেই হয়। কেউ প্রকাশ্যে তা স্বীকার করবে না। ফলে অভ্যুত্থানে চীনের সংযোগ আছে কি না, নিশ্চিতভাবেই আমরা তা প্রমাণ করতে পারব না।’
লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিষয়ের অধ্যাপক টেডি ব্রেট মনে করেন, জিম্বাবুয়ের ক্ষমতায় যিনিই থাকুন না কেন তাঁকে বিদেশ-নির্ভর হতেই হবে। এ ক্ষেত্রে চীনকে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি মনে করেন তিনি। ‘তারা যদি চীনের সহযোগিতায় শাসন শুরু করে আমি খুব একটা অবাক হবো না। গণতন্ত্রের আশ্বাস না দিয়েই তা ক্ষমতা চালিয়ে যেতে পারে। চীন সব সময় ক্ষমতায় থাকা শক্তিকে শর্তহীনভাবে সমর্থন জানিয়েছে। নির্বাচিত বা অনির্বাচিত সরকারই হোক না কেন চীন সমর্থন জানিয়ে আসছে।’ বলেন টেডি ব্রেট।
যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা শক্তি যখন মুগাবের সরকারের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করে তখন চীন তাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। স্বৈরাচারি শাসন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনে আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখেও চীন মুগাবেকে সমর্থন করে গেছে। জিম্বাবুয়ের গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগকারী চীন। ২০১৫ সালে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং জিম্বাবুয়ে সফর করেছিলেন। ওই সময় শি বলেছিলেন দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গভীর। সফরে ৪০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন চীনা প্রেসিডেন্ট।
তবে অনেকেই বলছে দেশটিতে সামরিক অভ্যুত্থানের পেছনে মুগাবের স্বেচ্ছাচারিতাই দায়ি।এছাড়া ভাইস প্রেসিডেন্ট নানগাওয়াকে বহিষ্কারের ফলে দলের মধ্যে কোন্দল সৃষ্টি হয়েছে।নানগাওয়াও গোপনে চীনের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছেন বলে বিভিন্ন সূত্র দাবি করেছে।
লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও প্রতিনিধি, বাংলাদেশ প্রতিদিন