১৯৭১
ড. আবুল কালামকে খুন করে আলবদর বাহিনী
১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের ৪ তারিখ থেকে ঢাকায় নতুন করে কারফিউ জারি করা হয়। ডিসেম্বরের ১০ তারিখ থেকেই বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের প্রস্তুতি নেওয়া হয়। মূলত ১৪ ডিসেম্বর পরিকল্পনার মূল অংশ বাস্তবায়ন হয়। অধ্যাপক, সাংবাদিক, শিল্পী, প্রকৌশলী, লেখকসহ চিহ্নিত বুদ্ধিজীবীদের পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের দোসররা জোরপূর্বক অপহরণ করে নিয়ে যায়। ওই দিন প্রায় ২০০ জনের মতো বুদ্ধিজীবীকে তাঁদের বাসা থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁদের চোখে কাপড় বেঁধে মিরপুর, মোহাম্মদপুর, নাখালপাড়া, রাজারবাগসহ অন্য অনেক স্থানে অবস্থিত নির্যাতন কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাদের ওপর বীভৎস নির্যাতন চালানো হয়। পরে তাঁদের নৃশংসভাবে রায়েরবাজার ও মিরপুর বধ্যভূমিতে হত্যা করে ফেলে রাখা হয়। তাঁদের মধ্যে একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ।
আবুল কালাম আজাদ ১৯৩৩ সালে ১ জানুয়ারি কুষ্টিয়া জেলার ভেড়ামারা উপজেলার রামকৃষ্ণপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। শিক্ষাজীবনে গণিতের ছাত্র ছিলেন আবুল কালাম আজাদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে এমএসসিতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন। আজাদ ছাত্রজীবনে বরাবরই অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফলিত গণিতে রেকর্ড ভাঙা নম্বর নিয়ে স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে স্বর্ণপদক পান।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে আজাদ ফ্লাইং অফিসারের পদমর্যাদা নিয়ে অধ্যাপক হিসেবে তৎকালীন পাকিস্তান বিমানবাহিনী একাডেমিতে যোগ দেন। সেখান থেকে প্রশিক্ষণের জন্য তাঁকে যুক্তরাজ্যে পাঠানো হয়। বিমানবাহিনীতে তাঁর মেধা এবং কৃতিত্ব অবাঙালিরা ভালো চোখে দেখেনি। এ জন্য তাঁর চাকরির মেয়াদ তারা হঠাৎ শেষ করে দেয়। নিরুপায় হয়ে তিনি তখন ঢাকায় পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সভাপতির কাছে চাকরির সন্ধান চেয়ে চিঠি লেখেন। চিঠির উত্তরে তিনি সাক্ষাৎকারের সুযোগ পান এবং পরে বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারি মহাবিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন।
যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তরল পদার্থসম্পর্কিত বলবিজ্ঞানে ডিপ্লোমা, ফলিত গণিতে এমএসসি এবং ম্যাথবিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। উচ্চশিক্ষা গ্রহণ শেষে ১৯৫৮ সালের নভেম্বর মাসে সরকারি কলেজের অঙ্কের লেকচারার হিসেবে যোগ দেন। পরে সরকারি জগন্নাথ কলেজের গণিত বিভাগে দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেন। জগন্নাথ কলেজে একপর্যায়ে গণিত বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হন। ১৯৬৮-৬৯ পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭০ সালের ১০ সেপ্টেম্বর তিনি অধ্যাপক পদে উন্নীত হন। ১৯৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্সড সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি টিচিং-এ যোগ দেন। নিখোঁজ হওয়ার আগপর্যন্ত তিনি এখানে অধ্যাপনা করেন। আবুল কালাম আজাদ ছাত্রজীবনে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। শিক্ষকতাকালে (১৯৫৮-৭১) এ দেশের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে সমর্থন জুগিয়েছেন। একাত্তরের উত্তাল দিনগুলোতে বিভিন্ন কর্মসূচিতে নানাভাবে সহায়তা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর অবরুদ্ধ ঢাকায় তিনি পরিবারসহ থেকে যেতে বাধ্য হন। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে না পারলেও যখনই পেরেছেন গোপনে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে কাজ করেছেন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র এক দিন আগে, ১৫ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এ দেশীয় দোসরদের একটি দল তাঁকে আটক করে অজ্ঞাত এক স্থানে নিয়ে যায়। বদর বাহিনীর পাঁচ খুনি ১৫ ডিসেম্বর সকালে তাঁদের বাসায় ঢুকে পড়ে। প্রথমে তারা আজাদের সামনে রিভলবার ধরে তাঁকে নিয়ে ঘুরে ঘুরে অকারণ তল্লাশি চালায়।
তারপর নিরপরাধ আজাদকে বাসি মুখে ধরে নিয়ে যায়। ছোট বোনটি তখন তাদের পায়ে ধরেছিল। মা বারবার তাদের বুকে জড়িয়ে ধরে বলেন, বাবা তোমরা বাঙালি, তোমরাও আমার ছেলে, ওকে তোমরা ছেড়ে দাও। কিন্তু কেউ তাঁর কথা শোনেনি। নরপশুরা এই নারীকে প্রতিবারই প্রচণ্ড ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছে।
সেদিন তিন ঘণ্টার জন্য সান্ধ্য আইন উঠে যায়। স্বাধীনতার পর তাঁর পরিবারের সদস্যরা রায়েরবাজার বধ্যভূমিসহ বিভিন্ন স্থানে খোঁজ করেন। তখন আজাদের ছোট ভাই ‘ইভনিং পোস্ট’-এর সম্পাদক হাবিবুল বাশার, বড় ভগ্নিপতি ইস্টার্ন নিউজ এজেন্সির মালিক গোলাম রসুল আজাদের সন্ধান নেওয়ার জন্য নানাভাবে চেষ্টা করেন। কিন্তু কোনো ফল হয়নি। শেষ পর্যন্ত তাঁকে পাওয়া গেল ১৭ ডিসেম্বর বিকেলে, ডক্টর রাব্বিসহ আরো কয়েকজন জ্ঞানীগুণীর লাশের পাশে।
অবিবাহিত আবুল কালাম আজাদ মা, চার ভাই ও চার বোনসহ থাকতেন ঢাকার আজিমপুরে। ভাইবোনদের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। তাঁর বাবা বেঁচে না থাকায় তিনিই ছিলেন তাঁদের অভিভাবক। অবরুদ্ধ জীবনের মধ্যে তাঁকে ভাইবোনদের আগলে রাখতে হয়েছে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত পরিবারের সবাইকে বেঁচে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন, সাহস জুগিয়েছেন।
আবুল কালাম আজাদ নিশ্চিত ছিলেন, এ দেশ একদিন স্বাধীন হবেই। যুদ্ধের পরিস্থিতি দেখে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সম্পর্কে নিশ্চিত হলেও এই স্বাধীনতা তিনি দেখে যেতে পারেননি।