যুদ্ধকথা
এখনো ক্ষত বয়ে বেড়ান গাজী সালেহ উদ্দীন
‘তখন আমার বয়স ছিল ২২-২৩ বছর। সবে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট শেষ করেছি। বাবা আলী করিম চাকরি করতেন রেলওয়েতে। সেই সূত্রে আমাদের বাসা ছিল চট্টগ্রাম শহরের পাহাড়তলী রেলওয়ে কলোনিতে। সেখানে বাঙালিদের ওপর বিহারিদের অত্যাচার ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। বাঙালিরাও কম যায় না, প্রতিবাদ করেছে সমানতালে। বয়সটা তরুণ হওয়ায় এসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতাম পাড়ার অন্য সব বাঙালির মতো। তবুও শেষ রক্ষা হয়নি। বিহারিদের অত্যাচারে ছাড়াতে হয়েছিল কলোনি।’ এভাবে যুদ্ধকালীন নিজের স্মৃতি বর্ণনা করছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. গাজী সালেহ উদ্দীন।
পরে তাঁদের নিয়ে নোয়াখালীর সোনাইমুড়ীতে গ্রামের বাড়ি বদরপুর চলে যান তাঁর বাবা। শুধু ভিটা ছাড়া আর কিছুই ছিল না তাঁদের। গোয়ালঘরের মতো করে একটি ছাউনি দিয়ে থাকত। মা-বাবা খাটে ঘুমাতেন, আর তাঁরা খড় বিছিয়ে মাটিতে রাত কাটাতেন। সেখানেও রাজাকারদের অত্যাচার যেন তাঁদের নিত্যসঙ্গী। পাশের গ্রামের এক হিন্দু মেয়েকে গণধর্ষণ করে রাজাকাররা। তাঁদের পরিবার এরপর সেই যে গ্রাম ছেড়ে ভারতে গেল, আর ফেরেনি। এসব দেখে পরিবারের তিন ভাই ঠিক করল, যুদ্ধে যাবে। তাঁদের বাবাও আপত্তি করলেন না। বড় ভাই গাজী মেজবাহ উদ্দীন পাকিস্তান বিমানবাহিনী ছেড়ে পালিয়ে বাংলাদেশে চলে এলেন। এপ্রিল মাসের শেষের দিকে তিনিসহ তিন ভাই বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্সের মাধ্যমে কমান্ডার ডা. আনিসুল ইসলামের অধীনে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করে। এর কিছুদিন পর তাঁর বাবাও পরিবার চালাতে চট্টগ্রামে চাকরিতে যোগ দেন। বাড়ি থেকে আসার সময় বাবা (আলী করিম) চিঠি লিখে রেখে আসেন তাঁদের জন্য। যেখানে লেখা ছিল, ‘বাবা, তোমরা দেশ রক্ষা করতে যুদ্ধে গেছ। আর আমি আমার পরিবার রক্ষা করতে চট্টগ্রাম যাচ্ছি।’
সেই যে বের হলো আর ঘরে ফেরা হলো না তাঁর বাবার। ১০ নভেম্বর চট্টগ্রামের পাহাড়তলী বধ্যভূমিতে তাঁর বাবা ও চাচাকে মিলিটারিরা হত্যা করে। তাঁর ছোট ভাই ১১ নভেম্বর আমিশাপাড়া ক্যাম্প এ গিয়ে খবর দিয়েছিল। প্রথমে তা বিশ্বাস করেননি তিনি। পরে ১২ তারিখ রাতে বাবার খোঁজে চট্টগ্রাম আসেন। এ কারণে বেশ কিছু দিন চট্টগ্রাম থাকতে হয়। এর পরের দিন, অর্থাৎ ১৩ নভেম্বর সিআরবিতে বাবার খোঁজে যান তিনি। সেখানে খোঁজ নিয়ে বাবার এক সহকর্মী নুর মোহাম্মদকে নিয়ে থানায় যান। থানা থেকে দুজন সিপাহি নিয়ে তাঁর বাবা যে বাসায় থাকত, সিএমবি কলোনির সে বাসায় গিয়ে দেখে ঘর তছনছ অবস্থায় পড়ে আছে। তখন ছিল রোজার মাস। খাওয়া অবস্থা থেকে তুলে নেওয়ায় তিনি দেখতে পান, টেবিলে খাবার পড়ে আছে। আর তা থেকে পচা দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। সেখান থেকে বধ্যভূমিতে আসতে চাইলে তাকে না করা হয়। পরে জেনারেল হাসপাতলে খোঁজ নেয় তাঁর বাবার লাশ আনা হয়েছে কি না। কিন্তু না, সেখানে মাত্র চারটি লাশ ছিল। বলে রাখা ভালো, তাঁর বাবার সহকর্মী নুর মোহাম্মদ তাঁদের পরিবারের আর্থিক অনটনের বিষয়টি জানতেন। তাই তিনি (নুর মোহাম্মদ) পরামর্শ দিলেন, হাসপাতাল থেকে একটা লাশ নিয়ে তাঁর বাবার নামে দাফন করতে। যাতে করে একটা মৃত্যুসনদ পাওয়া যাবে এবং তা দিয়ে সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার থেকে কিছু টাকা পাওয়া যাবে। অন্তত পরিবারটা বাঁচবে। তখন তাঁর বাবার চিঠির কথা মনে পড়ে তাঁর। বাবার সহকর্মীর কথামতো একটা লাশ নিয়ে চট্টগ্রাম নগরীর চৈতন্য গলিতে নিয়ে দাফন করা হয়। সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার থেকে প্রায় ৫০০ টাকা পাওয়া যায়, যার মধ্যে সব ৫০ টাকার নোট ছিল।
যুদ্ধকালীন তাঁর দুঃখের স্মৃতি
নোয়াখালী জেলার হাপানিয়া নামে এক এলাকায় একটি খাল ছিল। একদিন অপারেশনের জন্য বের হলেন তাঁরা। ওই খাল পার হওয়ার সময় হঠাৎ একটি শব্দ পেয়ে সকলে পানিতে লাফ দেয়। তিনি (সালেহ উদ্দীন) সাঁতার জানতেন না। সকলের মতো তিনিও লাফ দিলে খালে পুঁতে রাখা একটা চিকন বাঁশের অংশ তাঁর পায়ে ঢুকে যায়। সেই ক্ষত নিয়ে যুদ্ধে যান তিনি। সেই ক্ষতচিহ্ন এখনো বয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। যেহেতু তাঁর বাবা ও চাচাকে হত্যা করা হয় যুদ্ধ চলাকালে, সুখের মুহূর্ত থেকেও দুঃখের মুহূর্ত বেশি তাড়া করছিল তাঁকে।
তাঁর সম্পর্কে কিছু কথা
ড. গাজী সালেহ উদ্দীন যুদ্ধ করেছিলেন ২ নম্বর সেক্টরে, কমান্ডার ডা. আনিসুল ইসলামের অধীনে। গ্রামের বাড়ি নোয়াখালী হলেও জন্মের পর থেকে চট্টগ্রামে বড় হন তিনি। ছাত্রজীবনে জড়িত ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সঙ্গে। চাকরির পাশাপশি পড়ালেখা করেছেন তিনি। স্বাধীনতা-পরবর্তী জীবনে মা তাঁদের জন্য অনেক কষ্ট করেন। ১৯৭৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। এখন পর্যন্ত তাঁর লেখা তিনটা বই প্রকাশিত হয়েছে। চট্টগ্রামের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ২০১২ সালে তাঁর লেখা ‘প্রামাণ্য দলিল মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম’ প্রকাশিত হয়। সেখানে চট্টগ্রাম জেলার সব বধ্যভূমি, সব শহীদের তালিকা, সম্মুখ ও গেরিলা যুদ্ধস্থানগুলোর তালিকা, যুদ্ধের বিবরণ সেখানে আছে। মাঠ জরিপের মাধ্যমে করা মৌজা ও দাগ নম্বরও রয়েছে। এমনকি দু-তিনটি থানার প্রশিক্ষণ শিবির, মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণস্থল, দাগ-খতিয়ান নম্বরসহ দেওয়া হয়। যা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বইটি তথ্য দলিল হিসেবে ব্যবহার করে।