শিক্ষা দিবস
শিক্ষকের জীবনমান ও মর্যাদা বাড়ুক

শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার, আর এই অধিকারে পূর্ণতা দেওয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রের, আরো স্পষ্ট করে বললে সরকারের কাঁধে এই দায় বর্তায়। জাতিসংঘ সনদে স্বীকৃত অন্যান্য অধিকারের সঙ্গে শিক্ষাও যে গুরুত্বপূর্ণ এবং বড় মৌলিক অধিকার সেটি রাষ্ট্র বহু আগেই স্বীকার করে নিয়েছে। তাহলে একটি শিশু যখন জন্ম নেয়, তার খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের সঙ্গে তাকে শিক্ষিত করে গড়ে তোলার দায়িত্বটিও সরকার নেবে এমনটিই কথা ছিল। কিন্তু সেটি শেষ পর্যন্ত ঘটেনি, সেই ব্যবস্থাটি সম্পন্ন করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি, স্বাধীনতার বহু বছর পরও। অথচ এটিই ছিল স্বাধীনতার ইশতেহার, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যে, মানুষ দুই বেলা খাবার পাবে, মাথা রাখার ঠাঁই থাকবে, চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকবে, প্রতিটি শিশু সময়মতো পাবে মানসম্পন্ন শিক্ষা। যেহেতু আমাদের রাষ্ট্র নানা দুর্ঘটনায় জর্জরিত, দুর্নীতি আছে, রাজনৈতিক নেতৃত্বে সততার অভাব রয়েছে, তাই এই রাষ্ট্রে সেসব কথা স্বপ্নের মতোই মনে হয়।
প্রশ্ন আসে তাহলে উপায় কী? উপায় একটা আছে বটে, নাগরিককে নিজ উদ্যোগে এসব চাহিদার জোগান দিতে হবে, এখানে যে সক্ষম হবে সে খাবার পাবে, মানসম্পন্ন শিক্ষা পাবে, পাবে নামিদামি হাসপাতালে চিকিৎসাও। অন্যদিকে যে পয়সা জোগাড় করতে পারবে না, সে খাবার, বস্ত্র, চিকিৎসা কোনোটিই পাবে না। শিক্ষা তখন দূরের বিষয়, মানসম্পন্ন শিক্ষা তখন সুদূর পরাহত। এই ছবিই এখন আমরা দেখছি, এ দেশের মানুষ খাবার না পেয়ে পথেঘাটে মরে পড়ে থাকে, একটু আশ্রয় নেই বলে রাত কাটায় ফুটওভার ব্রিজের ওপর, সকালে এ দেশের সকল শিশুই বিদ্যালয়ে যায় না, অনেক বড় সংখ্যক শিশুই এখনো কারখানা-গ্যারেজে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে।
এই যখন অবস্থা তখন নাগরিকরা নিজ উদ্যোগে যেটুকু করছেন, তার ওপরেও সম্প্রতি খড়গ নেমে আসতে দেখছি আমরা, যার অন্যান্য নজির হলো শিক্ষার ওপর মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট। রাষ্ট্র যেন বলতে চাইছে, বাজার থেকে আলু-পটোল ক্রয় করলে তুমি যেমন ভ্যাট দাও, পড়ালেখা করলেও তোমাকে ভ্যাট দিতে হবে কারণ বাজারের আর দশটা পণ্যের মতোই এটিও একটি পণ্য। সেই ইংরেজ আমলে শ্মশ্রুর ওপর কর আরোপের মতোই হাস্যকর এই ঘটনা। ‘নো ভ্যাট অন এডুকেশন’ স্লোগান দিয়ে আজ যারা সড়কে নামছেন, তাদের তো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার কথা ছিল না, প্রকৃত কথা হলো সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এদের স্থান করে দিতে পারেনি রাষ্ট্র। এ জন্য একপ্রকার বাধ্য হয়েই অনেক শিক্ষার্থী সেখানে পড়ালেখা করছে।
এদের মধ্যে মধ্যবিত্তের সংখ্যাই তো বেশি, অনেক শিক্ষার্থীকে আমরা জানি, যারা পড়ালেখার খরচ জোগাতে হিমশিম খান, কেউ কেউ টিওশনি করেন, কেউ খণ্ডকালীন চাকরি করে পয়সা উপার্জন করেন। অথচ এই নির্বোধ রাষ্ট্রটি সেই জায়গায় আরো নিষ্ঠুরতার প্রমাণ দিতে চায়। আমরা মনে করি সকল প্রকার শিক্ষার ওপর থেকে কর প্রথা উঠে যাওয়া উচিত, কারণ শিক্ষার ব্যয় বাড়লে আর যাই হোক এই অনুন্নত দেশে একটি শিক্ষিত জাতি গড়ে ওঠা কঠিন। সে জন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যেমন করণীয় আছে, তেমনি সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মালিকদেরও সদিচ্ছা থাকতে হবে।
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের যে দাবি আদায়ের আন্দোলন চলছে সেখানে সরকারকে নজর ফেলতে হবে, এটি মূলত শিক্ষকদের মর্যাদার লড়াই, শিক্ষার মানকে কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে নিতে হলে শিক্ষকদের অমর্যাদাকর অবস্থানে রেখে সেটি সম্ভব নয়। শিক্ষকদের সম্মান এবং সম্মানি দুটোই যে অনেক নিচে রাখা হয়েছে এ আলোচনা আমরা পূর্বে সবিস্তারে আলোচনা করেছি। কিছু কিছু স্থানে কথা উঠেছে শিক্ষকদের মর্যাদা উদ্ধারে শিক্ষকদের ভূমিকা রয়েছে, একথা সত্য। আবার এ কথাও শোনা যায়, রাজনীতির নামে কোথাও কোথাও শিক্ষকদের মধ্যে অসম প্রতিযোগিতা চালু আছে, তবে এটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এ দেশের বেশির ভাগ শিক্ষকরা এখনো সততা এবং নৈতিকতার সঙ্গেই শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করেন। সেদিন দেখা গেল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব তাঁর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষককে সালাম করেছেন, এর মাধ্যমে মূলত তিনি ওই শিক্ষক এবং শিক্ষাগুরুর প্রতি নিজের সম্মান এবং ভক্তির কথা প্রকাশ করেছেন। আমরা চাই এটি শুধু প্রতীকী অর্থের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থেকে সরকারি সিদ্ধান্তে তাঁর প্রতিফলন ঘটুক।
শুধু বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় নয়, প্রাথমিক থেকে শুরু করে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক সব পর্যায়ের শিক্ষকদের জন্য সম্মানজনকভাবে বেঁচে থাকার ব্যবস্থা করা সময়ের দাবি। এবং একই সঙ্গে শহর ও গ্রামীণ জীবনে শিক্ষার নানা স্তরে যে বৈষম্য রয়েছে, এগুলো দূরীকরণও জরুরি হয়ে পড়েছে।
আমাদের এবারের শিক্ষা দিবসের অঙ্গীকার হোক সকল স্তরের শিক্ষকদের জীবনমান উন্নয়ন এবং মর্যাদা বৃদ্ধি। শিক্ষকদের মর্যাদা ও সম্মান বাড়লে জাতি হিসেবে আমরা গৌরব লাভ করব, বিশ্বসভায় আবার মোরা নতুন করে আসন লাভ করব।
লেখক : অধ্যাপক ও প্রেসিডেন্ট, রিসার্চ ফর অ্যাডভান্সমেন্ট অব কমপ্লিট এডুকেশন