মধ্যপ্রাচ্য
তেল, আধিপত্যবাদ ও পশ্চিমাদের স্বার্থ
‘রাশিয়ার সিরিয়া আক্রমণ বড় ভুল’ বলে মন্তব্য করেছেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন। কিন্তু ‘মধ্যপ্রাচ্য রক্ষায় রুশ অভিযান গুরুত্ববাহী’ বলে মনে করেন বাশার আল-আসাদ। অবশ্য মার্কিনিদের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ে একটু অগাধ জ্ঞান আছে বলে মনে হয়। তাই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা শুধরিয়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে বলেন, ‘রাশিয়া আসলে সিরিয়ার ভুল জায়গায় আক্রমণ করেছে...আইএস ও মডারেট অপজিশন বা যাঁরা উগ্রপন্থি নন এমন বিরোধীদের মধ্যকার পার্থক্য তিনি বোঝেন না।...তারা আইএসসহ আসাদবিরোধী ও অন্যান্য গোষ্ঠীর ওপর হামলা চালাচ্ছে।’
প্রশ্ন হলো, মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ে এত স্বচ্ছ ধারণা থাকার পরও আমেরিকা কেন কয়েক মিলিয়ন সাধারণ মানুষ হতাহতের মতো ভুল কাজটি করল? ‘নোবেল পিস প্রাইজ-উইনিং ডক্টরস গ্রুপ’ পিএসআরের প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, ১৯৯০ সালের পর মার্কিন নেতৃত্ব বিভিন্ন যুদ্ধ-সংঘাতে সর্বোচ্চ দুই মিলিয়ন মানুষ নিহত হয়েছে। এর সমালোচনায়, অনুসন্ধানী সাংবাদিক ড. নাফিজ আহমেদ মিডলইস্ট আই-এর তথ্যসমৃদ্ধ প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, শুধু আফগানিস্তান আর ইরাকেই চার থেকে ছয় মিলিয়ন মানুষ নিহত হয়েছে, যার অধিকাংশই শিশু। অর্থাৎ জঙ্গি নিধনের নামে সাধারণ মানুষ হত্যার এ এক বীভৎস কাণ্ড। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্য কারো হাতেই নিরাপদ নয়। ২৫ বছর পর রাশিয়া মধ্যপ্রাচ্য আক্রমণ করল। সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যপ্রাচ্য আক্রমণের বীভৎসতা ইতিহাসের কলঙ্কিত পাঠ। মার্কিনি কিংবা রাশিয়া সবাই লুটতরাজ করেছে, করছে। যা হোক, মধ্যপ্রাচ্য ইস্যুটি সারা মুসলিম বিশ্বের কাছে অতি আপন; তারা এর মঙ্গলকামী।
এখন মুসলিম বিশ্ব সিরিয়ায় রাশিয়ার এ আক্রমণ কোন চোখে দেখবে? আইএসকে সমর্থন আর মুসলিমদের প্রতি অসহযোগিতার অভিযোগ সৌদি আরবের বিরুদ্ধে রয়েছে। তবে মুসলিম বিশ্ব এখন ইরানকে বিকল্প হিসেবে চিন্তা করে। খোমেনি বলেন, যারা শিয়া-সুন্নি বিভেদ করে, তারা শিয়াও নয়, সুন্নিও নয়; তারা পশ্চিমাদের দোসর। ইরানের এই নীতি সত্যি হলে তারা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ভালো করবে বোধ হয়। কিন্তু শিয়া আসক্তি মানে সুন্নিবিদ্বেষ ইরানিদের মাঝে প্রকট। এই পরিপ্রেক্ষিতে মুসলিম বিশ্বে খেলাফতের সর্বশেষ ঐতিহ্য বহনকারী এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অভ্যস্ত ও বিশ্বাসী তুরস্ক মুসলিমদের নেতৃত্বে সৌদির বিকল্প হতে পারে। কিন্তু সৌদিকে বাদ দিয়ে কোনো মুসলিম রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ইসলামের চর্চা করবে না। সে ক্ষেত্রে মার্কিনিরা চাপে পড়লে ব্রাদারহুডের উত্থান হতে পারে মধ্যপ্রাচ্যব্যাপী। তবে সৌদি আরবের বর্তমান বাদশাহ ও পরবর্তী সম্ভাবনাময়ী বাদশাহর পশ্চিমা প্রেম তুলনামূলক কম থাকায় মিনার দুর্ঘটনা নিয়ে সৌদিরা একটু বেশি চাপে আছে। তা ছাড়া আরব আমিরাতের সঙ্গেও এই বাদশাহর বৈরিতা লক্ষণীয়। এ রকম পরিস্থিতি দীর্ঘ হলে এরদোগান-মুরসির জন্য সুযোগ তৈরি হতে পারে। তাই মুসলিম বিশ্ব হয়তো আগ বাড়িয়ে মার্কিন বা রাশিয়া কোনো পক্ষের দিকেই ঝুকবে না। যেমন পাকিস্তান এখন অনেক হিসাবি। তারা সিরিয়া অভিযানে মার্কিনিদের আহ্বান ভেবে দেখছে। তা ছাড়া মুসলিম রাষ্ট্রগুলো নানা স্বার্থে বিভিন্নমুখী। ফলে মুসলিমদের বিশেষ ব্লক তৈরি হওয়াটা এ মুহূর্তে অসম্ভব।
তবে ইরান, চীন, জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালির রাশিয়া অভিযানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থন নিশ্চিত হলেও তা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ লেগে যাওয়ার মতো কোনো আশঙ্কা আছে বলে মনে হয় না। এতে মার্কিনিরা যে চাপে পড়বে, সেটা বলা যায়। সে ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্য ইস্যুকে কেন্দ্র করে বাকি বিশ্বে উত্তেজনা বাড়বে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যকে পুড়তে হবে। এটা ধর্মের প্রশ্ন নয়, এটা অর্থ ও ক্ষমতার প্রশ্ন।
১৯৭৩ সালে আরব দেশগুলো পশ্চিমা আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে তেলের অস্ত্র নিয়ে দাঁড়ানোর চেষ্ট করে; তেল সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। তখন মার্কিনিরা নিজেদের মজুদে থাকা তেলও বিক্রি না করে অতিরিক্ত কৃত্রিম সংকট দেশ ও বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরে। ফলে ‘মুসলিম’ ও ‘ইসলাম’ ভিলেনে পরিণত হয়। ১৯৭৫ সালে কমেন্টারি পত্রিকায় ময়নিহান ও থুকার বেশ কিছু প্রবন্ধে লেখেন, আগের উপনিবেশগুলোকে স্বাধীন হতে দেওয়া ঠিক হয়নি; তাদের আবার দখল করতে হবে। ১৯৭৫-৭৭ সাল পর্যন্ত এ প্রচার চলল। ’৭৮ সালে ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ বাধলে এবং যুক্তরাষ্ট্রে পাহলোভির আশ্রয়কালে মার্কিন দূতাবাস বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্ররা দখল করে নিলে ‘ইসলাম’ ও ইরান পশ্চিমা সাধারণের চোখে ভিলেন হয়ে ওঠে। এডওয়ার্ড সাইদের মতে খ্যাতি, অর্থ ও চাকরির লোভে মিডিয়াকর্মী ও গবেষকরা ইসলাম সম্পর্কে ভুলভাবে উপস্থাপন করেন। এতে মধ্যপ্রাচ্যে তার বিরূপ প্রভাবে কিছু লোক বিদ্রোহ করলে বিশ্ববাসীর কাছে তারা আবার ভিলেন হয়। পরে যুক্তরাষ্ট্র অর্থ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়ে তালেবানসহ বিভিন্ন জঙ্গি বাহিনী গঠন করে ইসলামের নামে চালিয়ে দেয়। এ প্রেক্ষাপটে একটিবারও ধর্মীয় ইস্যু সামনে আসেনি। মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানরাও ধর্মকেন্দ্রিক মাতামাতি করে না। তাই বলতে হয়, তেল ও আধিপত্যবাদই এ সংকটের প্রধান কারণ।
লেখক : এমফিল গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।