শ্রীলঙ্কা ট্র্যাজেডি
এভাবেই তবে সাঙ্গ হবে জীবনের জয়গান?
![](https://publisher.ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2019/04/24/photo-1556084115.jpg)
কয়েক সহস্র বছর ধরে মানুষরা সগর্বে ঘোষণা দিয়ে যাচ্ছে, পৃথিবী নামের এই নীল গ্রহের সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী ওই মানুষ নিজেই। মানুষজাতের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলার মতো বুদ্ধিদীপ্ত প্রাণী অবশ্য এই গ্রহে নাই সত্য, কিন্তু এই আত্ম-অহংকারী মানুষের চেয়ে সৎগুণসম্পন্ন প্রাণী যে এই গ্রহে আছে এ নিয়ে এখন সবাই সন্দেহমুক্ত। মানুষ ছাড়া আর কোনো প্রাণী নিজে আত্মঘাতী হয়ে তার সগোত্রীয় কাউকে খুনের নিশানা বানায় না। উপরন্তু নিজের জীবন বিপন্ন করে হলেও মানুষের জন্য অকাতরে অক্সিজেন বিলিয়ে যায় বিচিত্র বৃক্ষরাজি। পক্ষান্তরে মানুষ তার জাত চিনিয়ে দেয় নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চ মসজিদে কিংবা শ্রীলঙ্কার গির্জায়। এতটা নির্মম-নির্দয় হওয়া মানুষেরই বুঝি সাজে, আর কারো নয়। এভাবেই তবে সাঙ্গ হবে জীবনের জয়গান?
মানুষের হাতেই লেখা তবে তার নিজের প্রজাতির করুণ বিনাশ? মাসখানেক হলো ক্রাইস্টচার্চ মসজিদে শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসীর হামলার নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞের ঘটনার। সেই ক্ষত না শুকাতেই এবার শ্রীলঙ্কার গির্জা ও হোটেলগুলোতে ঘটানো হলো দক্ষিণ এশিয়ার চলতি দশকের সবচেয়ে বড় বর্বরতা। ছয় ঘণ্টর মধ্যে আট জায়গায় সাত আত্মঘাতী বোমারুর শক্তিশালী বোমা বিস্ফোরণ। প্রায় ৩৫৯ মানুষের প্রাণপাত আর ৫০০ আহত মানুষের করুণ আর্তনাদে ভারি এখন শ্রীলঙ্কার বাতাস।
গৃহযুদ্ধপীড়িত শ্রীলঙ্কা যখন সব জাতি-ধর্ম-বর্ণ গোত্রের মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছিল, এমন সময় এই বিরাট বিপর্যয়। নির্বিকারভাবে বোমা মেরে মানুষ হত্যা করতে কীভাবে পারে ওই নামধারী মানুষ? এতটা ঘৃণার বীজ তাদের মগজে কারা রোপণ করে? দয়ামায়া-ভালোবাসার অনুভূতিগুলো কারা সমূলে উৎপাটন করে চলেছে? মানুষ কাকে বিশ্বাস করবে? কীভাবে তার হারানো বিশ্বাস ফিরে পাবে? আমাদের সত্যি জানা নাই।
ধর্মীয় কিংবা নিধার্মিক উগ্রবাদ এখন সারাবিশ্বেরই ক্যানসার। এই জঘন্য ভাইরাস থেকে কারোরই নিস্তার নেই। পৃথিবীতে মায়ামমতা প্রেমপ্রীতি সৌহার্দ সহমর্মিতা যেটুকুই এখনো টিকে আছে, এ জন্য মহান ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে হবে। কিন্তু এই যে উগ্রবাদ, ধর্মজিহাদ, রেসিজম, আধিপত্যবাদ, ধনতন্ত্র, পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদের মতো ঘৃণ্য কলুষিত শয়তানি—এ জন্য আমরা কোন ঈশ্বরের কাছে প্রশ্ন তুলব? সত্যি জানা নাই।
শয়তানের সতীর্থ অমানুষের অমানুষিতার সীমা-পরিসীমা নেই। ইস্টার সানডেতে শ্রীলঙ্কার গির্জায় ধর্মীয় কৃত্যপালনকারী এবং হোটেলে থাকা বিদেশি পর্যটকদের ওপর কাপুরুষোচিত সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা জানানোর ভাষা আমাদের সত্যি জানা নাই। নিরীহ-নির্বিরোধ মানুষের প্রাণহরণ করে ওরা কী কায়েম করতে চায় আমাদের বুঝে আসে না? যাদের মনে ভালোবাসা নেই, তাদের কোনো সত্যনিষ্ঠ আদর্শও নেই। শয়তানি আদর্শপুষ্ট সন্ত্রাসী হন্তারক ও তাদের অস্ত্রবাজ ইন্ধনদাতাদের সমুচিত শাস্তি চাই। কিন্তু কে নিশ্চিত করবে বিচার ও শাস্তি?
হামলাকারী কারা, তা শতভাগ চিহ্নিত না হলেও প্রাথমিক তদন্তের পর শ্রীলঙ্কার শীর্ষ কর্মকর্তারা বলেছেন, হামলাকারীদের বড় অংশই উগ্র ইসলামপন্থী এবং তারা একটি আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কের সহায়তায় হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে। শ্রীলঙ্কার সরকারের বরাতে বিভিন্ন মিডিয়ায় শ্রীলঙ্কার আঞ্চলিক জঙ্গিগোষ্ঠী ন্যাশনাল তাওহিদ জামাত বা এনটিজের নাম এসেছে। আল-কায়েদা, আইএস, তালেবান, লস্কর-ই-তৈয়বা, মুসলিম ব্রাদারহুড প্রভৃতি গোষ্ঠীর নামও ওই একই ঘরানার। যারা বিশ্বের বৃহৎ শক্তির ইন্ধনে ধর্মীয় মোড়কে রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ বাস্তবায়ন করতে নিরীহ-নির্বিরোধ মানুষকে হামলার টার্গেট করে।
লন্ডনে, স্টকহোমে, বার্লিনে কারা আক্রমণ করেছিল, তা সবার জানা। প্যারিসের স্টেডিয়ামের কনসার্টে গুলি করে কারা শতাধিক মানুষ হত্যা করেছিল, সে পরিচয়ও নিশ্চিত হওয়া গেছে।
উগ্রবাদ এখন আর একটি ধর্ম, একটি জাতি বা একটি দেশের একার সমস্যা নয়। এমন সর্বগ্রাসী ভাইরাসকে নির্মূল করতে হলে মানবিকতা, ভালোবাসা আর ঔদার্যের অনুগামী হওয়ার বিকল্প নেই।
শ্রীলঙ্কার জন্য শোকাবিভূত আমাদের সংহতি ও সহমর্মিতা। অসহায় অগণন অমৃত প্রাণের জন্য অশেষ শ্রদ্ধা। মানুষ হিসেবে আমরা হতাশ ও সংক্ষুব্ধ। তবু তালাশ করি সদাশয় ভালোবাসা ও অহিংসা। এক্সট্রিমিজম নিপাত যাক। বিশ্বটা ভালো মানুষের হোক। কিন্তু সাদাসিধে ভালো মানুষ আর কোথায় পাব?
শ্রীলঙ্কার নেগোম্বোর সেইন্ট সেবাস্টিয়ান গির্জায় ইস্টার সানডে বিশেষ উৎসবে গিয়েও ভাগ্যগুণে বেঁচে ফিরেছে দিলিপ ফার্নান্দো ও তাঁর পরিবার। ফার্নান্দো বলেন, প্রতিশোধ নিরর্থক। এই ঘটনার প্রতিশোধ নিতে আর কোনো সন্ত্রাসী হামলা হবে না বলে আশা করেন তিনি। বোমা হামলার পর ভক্তের রক্তে জর্জরিত প্রভু যিশুও নিশ্চয় এভাবেই উচ্চারণ করেছেন :
আমি সব কষ্ট সয়ে নিতে জানি। ব্যথাদের পাহাড় দাবড়ে উঠে যাই অহিংসার চূড়ায়। দুঃখদের সাগর সাঁতরে পৌঁছতে পারি আনন্দালোকে। হ্যাঁ মৃত্যুদূত, তোমার অগণন পাপ আমাকেই বিদ্ধ করুক। ভক্তের রক্তস্নানে পবিত্র হোক আমাদের ভালোবাসার ঘর। মঙ্গলালোকে রোশনাই হোক হিংসুক তোমাদের রক্তপিপাসু মন। আমার পুনরুত্থানের পবিত্র দিনে এই হোক প্রার্থনা।
মহাপ্রভু তোমাদের জ্ঞান দিক...
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন।