জলবায়ু পরিবর্তন
রাজধানী ঢাকা কি মৃত্যুপথযাত্রী?

রাজধানীর করাইল বস্তির একটা ছোট্ট ঘরে স্বামী ও চার সন্তান নিয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন পারুল আক্তার। বৃষ্টির সময় ছোট্ট এই ঘরটিও হয়ে যায় বসবাসের অনুপযোগী। ইট দিয়ে উঁচু করে রাখা বিছানাটা বাদ দিলে বাকি সব কিছুই ভেসে যায় বৃষ্টির পানিতে। তারপরও এই মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু খুব করেই দরকার পারুলের। দরকার তাঁর মতো আরো অনেক বস্তিবাসীর, যাঁদের অনেকেই ঢাকায় আসতে বাধ্য হয়েছেন প্রাকৃতিক দুর্যোগে সর্বস্বান্ত হয়ে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে রাজধানী ঢাকায় প্রতিনিয়ত বাড়ছে পারুলের মতো জলবায়ু উদ্বাস্তু।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রবল ঝুঁকির মুখে থাকা দেশগুলোর মধ্যে প্রথম সারিতে আছে বাংলাদেশের নাম। পরিবেশ রক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়া হলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যেতে পারে বাংলাদেশের বড় একটা অংশ। এরই মধ্যে শুরুও হয়ে গেছে এই বিধ্বংসী প্রক্রিয়া। আর যার ফলে পারুলের মতো জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হতে হচ্ছে অনেককে। সাত বছর আগে বন্যায় সব কিছু হারিয়ে ভোলা থেকে ঢাকায় পাড়ি জমিয়েছিলেন পারুল। তিনি বলেন, ‘নদীর তীর থেকে দ্রুত সরে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না আমাদের। এক সপ্তাহের ভেতরেই নতুন জীবন শুরুর জন্য আমরা ঢাকায় চলে আসি।’
ঢাকায় প্রতিদিনই প্রায় দুই হাজার করে মানুষ আসছে নতুন জীবন শুরুর হাতছানিতে। দারিদ্র্যের তীব্র কশাঘাত থেকে মুক্তির আশায় অনেক মানুষই হয় ঢাকামুখী। কিন্তু সম্প্রতি বেড়ে যাচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের শিকার হয়ে ঢাকায় আসা মানুষের সংখ্যা।
বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে দ্রুত গলছে হিমালয়ে জমে থাকা হিমবাহ। আর তা বাড়িয়ে দিচ্ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ও বন্যার তীব্রতা। উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে বাড়ছে লবণাক্ততা, যা ধীরে ধীরে ধ্বংস করছে ফসলি জমি ও তৈরি করছে খাবার পানির সংকট। কিছু কিছু প্রভাব এরই মধ্যে পড়তে শুরু করেছে। যার ফলে গড়ে প্রতিবছর চার লাখ মানুষ রাজধানী ঢাকায় স্থায়ী বসতি গড়ছে বলে এক প্রতিবেদনে দাবি করেছে বিশ্বব্যাংক। আর ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন (আইওএম)-এর হিসাব মতে, ঢাকার বস্তিগুলোতে বসবাসকারী ৭০ ভাগ মানুষই সেখানে এসেছে কোনো ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের শিকার হয়ে। ২০১২ সালে দেড় হাজার পরিবারের তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশবিষয়ক গবেষণাকেন্দ্রের প্রধান এ এস মনিরুজ্জামান খান। যাদের বেশির ভাগই পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে শহরে পাড়ি জমিয়েছিল। বেশির ভাগই এসেছিল ঢাকায়।
কিন্তু এই জলবায়ু উদ্বাস্তুদের গন্তব্যস্থল রাজধানী ঢাকাও আছে প্রবল ঝুঁকির মুখে। ২০১১ সালের একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছিল, তীব্র উপকূলীয় বন্যার হুমকিতে থাকা জনবহুল শহরগুলোর তালিকায় ঢাকা আছে তৃতীয় স্থানে। প্রথম দুটি শহর মুম্বাই ও কলকাতা। গুয়াংজু, হো চি মিন সিটি, শাংহাই, ব্যাংকক, মিয়ামিও আছে প্রবল ঝুঁকিতে। তারপরও ঢাকায় বেড়ে চলেছে জলবায়ু উদ্বাস্তুর সংখ্যা। আর এ ব্যাপারে খুব বেশি প্রস্তুতিও নেই নগর পরিকল্পনার।
প্রায় ৩০০ বর্গকিলোমিটার ব্যাসার্ধের এই ঢাকা শহরে বসবাস করে দেড় কোটি মানুষ। আগামী দুই দশকের মধ্যে এই সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়াতে পারে তিন কোটিতে। ফলে চরম প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়া মানুষগুলো ঢাকায় এসে পড়ছেন আরো সমস্যার মুখে। ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের গবেষক সরদার শফিউল আলম বলেছেন, ‘তারা বিশুদ্ধ খাবার পানি পাচ্ছে না। পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যকর পরিবেশ পাচ্ছে না।’
বন্যার প্রবল ঝুঁকিতে থাকলেও ঢাকা ভুগছে বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকটেও। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমেই নেমে যাচ্ছে নিচের দিকে। শহরের ৯০ শতাংশ খাবার পানির চাহিদা পূরণ হয় এই মাটির নিচে জমে থাকা পানি থেকে। কিন্তু প্রতিবছরে প্রায় তিন মিটার করে নিচে নেমে যাচ্ছে এই ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। ২০১৪ সালের হিসাব অনুসারে, ঢাকায় প্রতিদিন বিশুদ্ধ খাবার পানির ঘাটতি থাকছে পাঁচ লাখ লিটার। ঢাকা শহরকে একটা নৌকার সঙ্গে তুলনা করে শফিউল আলম বলেছেন, ‘প্রতিটা নৌকার মতো প্রতিটা শহরেরও একটা ধারণক্ষমতা আছে। সেই সীমা যদি অতিক্রম করে যায় তাহলে নৌকা উল্টে যাবে। শহরের ক্ষেত্রেও ঘটবে একই রকম ঘটনা।’
লেখক : সাংবাদিক