পুলিশের নিপীড়ন ও সর্বজনের দায়
চারদিক থেকে ঘিরে রেখে পুলিশ কয়েকজন ছাত্রকে বুকে-পিঠে লাথি মারছে, এক নারী শিক্ষার্থীর দিকে লাথি তুলে এগিয়ে যাচ্ছে দুই পুলিশ, মেয়েটির চুলের মুঠি ধরে মাটিতে ছুড়ে মারছে আরেক পুলিশ। এসব ছবি বর্ষবরণ উৎসবে যৌন নিপীড়নকারীদের গ্রেপ্তারের দাবিতে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের ডিএমপি কার্যালয় ঘেরাও কর্মসূচির সময় আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশের হামলার সময়ের। যাঁরা ঘটনার সাক্ষী এবং যাঁরা ছবিগুলো দেখেছেন, সবাই এই পুলিশি বর্বরতার প্রতি ঘৃণা জানাচ্ছেন। তাঁরা হয়তো ভুলে যাচ্ছেন, বাংলাদেশ পুলিশের এলিট ফোর্স র্যাব কথিত ‘ক্রসফায়ার’ ও ‘বন্দুকযুদ্ধ’ সংঘটিত হচ্ছে ১০ বছরের বেশি সময় ধরে। ক্রসফায়ারে নিহত হওয়ার সময় কোনো ব্যক্তির মুখের অভিব্যক্তি কেমন হয়, তা কারো পক্ষে কল্পনা করা হয়তো কঠিন। তবে আমরা অনেকেই এ কথা জানি যে, হত্যাকাণ্ডই নিপীড়নের চূড়ান্ত রূপ। নরহত্যার বেশি নিপীড়নের কথা আমরা ভাবতে পারি না। কাজেই পুলিশ দলবদ্ধভাবে যখন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের রাস্তায় ফেলে লাথি মারে বা কোনো নারীকে চুলের মুঠি ধরে রাস্তায় ছুড়ে মারে, তখন সেটাকে হত্যার তুলনায় অল্প নিপীড়নই বলতে হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, পুলিশের ‘ক্রসফায়ারে’ কেন মানুষ মরে কিংবা পুলিশ কেন আন্দোলনকারীদের ওপর চড়াও হয়? এমন নয় যে, আন্দোলনকারীদের ওপর আক্রমণের ঘটনাটি স্রেফ শরীরচর্চার কোনো মহড়া।
অগণতান্ত্রিক দেশে সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে পুলিশকে মারমুখো হওয়া লাগে। এমন পরিস্থিতিতে পুলিশের দায়িত্বের একটা রূপান্তর ঘটে যায়। সরকার কী চায়, সেটা করা হয়ে পড়ে তাদের প্রধান কর্তব্য। অপরাধীকে পাকড়াও করা তখন খুব গৌণ বা একেবারেই অ-দরকারি কাজ। হয়তো সে কারণে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সময় পরিকল্পিত ও দলবদ্ধ যৌন নিপীড়নের ঘটনা দমনে কিংবা অপরাধীদের ধরার ব্যাপারে পুলিশ পুরোপুরি নিষ্ক্রিয়তা দেখিয়েছে। লেখক অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডের সময়ও এ অবস্থার ব্যতিক্রম ঘটেনি। কেউ কেউ পুলিশের সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলেন; কিন্তু পুলিশ যে খুব সক্রিয় ও তৎপর, তার নজিরও আছে। ছাত্র ইউনিয়নের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন কর্মসূচির ওপর আক্রমণেও এই সক্রিয়তা লক্ষ করা গেছে। কিন্তু তারা এই সক্রিয়তা দেখাচ্ছেন অপরাধী ধরার ক্ষেত্রে নয়, বরং যাঁরা বিচারের দাবি তুলছেন, তাঁদের ওপর।
নিপীড়নের সঙ্গে ক্ষমতার একটি নিবিড় যোগ আছে। নিপীড়নকারীর সঙ্গে কোনো না কোনো ক্ষমতার যুক্ততা থাকে। এই ক্ষমতা তাকে রক্ষা করবে, এমন ভাবনা হয়তো নিপীড়ণকারীকে ভেতরে ভেতরে ভরসা জোগায়। বর্ষবরণের দিন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটিয়েছে, তারা ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গসংগঠন ছাত্রলীগের নেতা ও কর্মী। বিশ্ববিদ্যালয়ে অতীতে ঘটে যাওয়া যৌন নিপীড়ন/ধর্ষণের ঘটনার ক্ষেত্রেও একই রকম হতে দেখা গেছে। বাস্তবে আমরা দেখেছি, নিপীড়ক যে ক্ষমতার ভরসা করেছে, সেই ক্ষমতা সত্যি সত্যিই তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছে। প্রক্টর, তদন্ত কমিটি, ডিসিপ্লিনারি বোর্ড—সবাই ক্ষমতার শিকলে বাঁধা। সবার কণ্ঠস্বর নিপীড়কেরই পক্ষে থেকেছে।
মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যৌন নিপীড়নের বিচার নিশ্চিত করতে অভিযোগ তদন্তে সেল গঠন করা হলেও কোনো নিপীড়নের ঘটনারই যথাযথ বিচার হচ্ছে না। অভিযোগ সেল গঠন অভিযোগকারীর ন্যায়বিচার পাওয়াটাকে সহজ করেনি। কারণ, অভিযোগ সেল গঠিত হয় ক্ষমতার চোখ দিয়ে দেখা পছন্দের ব্যক্তিদের নিয়ে। পছন্দের এসব ব্যক্তি কখনোই প্রশাসনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যান না। আর ক্ষমতার নির্ভরতার প্রশ্নেই প্রশাসন নিপীড়কদের রক্ষা করতে চায়। এই চাওয়ার ভেতরে আছে অন্যায়কারীদের মিথোজীবিতা ক্ষমতার বিভিন্ন অংশের অর্গানিক ঐক্য। কোনো যৌন নিপীড়নের ঘটনার পর তাই সব সময় আমরা দেখি, প্রাথমিকভাবে তদন্তকারীরা ঘটনার কোনো সত্যতাই খুঁজে পান না। পরবর্তী সময়ে তাঁরা ততটাই সত্য খুঁজে পান, যত বেশি শক্তি আন্দোলনকারীরা প্রদর্শন করতে পারেন রাস্তায়। যতক্ষণ অভিযোগের সত্যকে আন্দোলনের শক্তি দিয়ে প্রামাণিক করে তোলা না যাচ্ছে, তদন্তকারীরা ততক্ষণ কোনো সত্যই খুঁজে পান না। উল্টোভাবে অভিযোগকারীকেই নানা কায়দায় শাস্তি দিতে থাকেন।
কীভাবে? বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিযোগ সেল কীভাবে খোদ অভিযুক্ত নারীকেই শাস্তি দেওয়ার উদ্যোগ নেয়? তাঁরা অভিযোগ সেলের বৈঠকে বারবার অভিযোগকারীকে ডেকে পাঠান, তার পর দীর্ঘক্ষণ ধরে চলতে থাকে উদ্ভট সব মন্তব্য ও প্রশ্নের পরম্পরা, ‘ওরা কি তোমার শাড়ি ধরে টেনেছিল? কিন্তু তোমার শাড়ি তো ছেঁড়ে নাই। কী শাড়ি পরছিলা? সুতির নাকি সিল্কের? অনুষ্ঠান থেকে যে তোমাকে এগিয়ে দিতে গেছিল, তার সঙ্গে তোমার সম্পর্ক কী? তোমার ব্যাগের ভেতর কি কনডম ছিল? ওরা তো তোমার ব্যাগেই কনডম পেয়েছে।’ এসব প্রশ্ন ও মন্তব্যের ভেতর দিয়ে অভিযোগ সেল ক্রমে হয়ে উঠতে থাকে অভিযোগকারীর জন্য টর্চার সেল। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অভিযোগকারী ছাত্রীকে ডেকে নিয়ে ধমক দেন। বলেন, ‘ডাকনাম লিখেছ কেন, যার পুরা নাম জানো না, তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করো কীভাবে?’ প্রক্টরের ধমকে মেয়েটি হয়তো বিমূঢ় হয়ে পড়ে। আমরা দেখতে পাই, রাষ্ট্রের পুলিশ যেমন বিচারপ্রার্থীদের ওপর চড়াও হয়েছে, তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিযোগ সেল এবং প্রক্টরও একই রকম আচরণ করছে।
আমাদের জন্য তবে কোন পথ খোলা থাকে? রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের চর্চা না থাকলে পুলিশ এমন আচরণই করবে, ক্ষমতার পুচ্ছ ধরে থাকা তদন্ত দল একই রকমভাবে অন্যায়কারীদের তোষণ-পোষণ করবে, রাষ্ট্র পুলিশি ক্ষমতা ব্যবহার করতে থাকবে জনগণের বিরুদ্ধে, প্রতিবাদ-প্রতিরোধের বিরুদ্ধে হানতে থাকবে লাথি আর লাঠিচার্জ, জখম, গ্রেপ্তার চলবে; তবে নিশ্চয়ই ধীরে ধীরে বাড়তে থাকবে দ্রোহী মানুষের সংখ্যা, মিছিলের পেছন দিকটা ভরাট হতে থাকবে, পথসভাটা রাস্তার মোড় পার হয়ে অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত হবে, মিছিলের স্লোগান আর চিৎকার ক্রমে প্লাবিত করবে সহস্রের হৃদয়, তখন অবশ্যই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের প্রতিজ্ঞা আর অধিকার আদায়ের সংগ্রাম জয়ী হওয়ার পথ তৈরি করবে।
লেখক : শিক্ষক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।