মার্কিন নির্বাচন
ভোটের লড়াইয়ে ট্রাম্প বনাম হিলারি
এক.
আজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৫৮তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। ১৭৮৮-৮৯ সালে জর্জ ওয়াশিংটন প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। সেই থেকে সংবিধান অনুযায়ী প্রতি চার বছর পরপর নিয়মিতভাবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সংবিধানের ২২তম সংশোধনীর মাধ্যমে একজন এক নাগাড়ে দুবারের বেশি প্রেসিডেন্ট হতে পারেন না। সে কারণে এবারের নির্বাচিত ব্যক্তি হবেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট। সে জন্য জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তৃতীয়বারের জন্য লড়তে পারছেন না।
মার্কিন সংবিধান অনুযায়ী একই সঙ্গে প্রেসিডেন্ট, ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং প্রয়োজনে সিনেটর, প্রতিনিধি পরিষদ সদস্য, এমনকি জনমত যাচাইয়ের বিভিন্ন বিষয় নির্বাচন ও মতামত গ্রহণ করা হয়। পরোক্ষ ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত ৫৩৮ জন নির্বাচকমণ্ডলীর (Electoral college) ২৭০টি গরিষ্ঠ ভোট পেলে একজন প্রার্থী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও বহুদলীয় ব্যবস্থাধীনে নির্বাচন পরিচালিত হয়। দীর্ঘদিন ধরে সেখানে দ্বিদলীয় ব্যবস্থা (Bi Party system) কায়েম রয়েছে।
বর্তমান নির্বাচনে দুজন প্রধান প্রার্থী রয়েছেন। এঁরা হলেন ডেমোক্র্যাট প্রার্থী, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী, সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের স্ত্রী হিলারি ক্লিনটন এবং রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। রিপাবলিকান প্রার্থী একজন ধনকুবের এবং টিভির রিয়েলিটি শো ব্যক্তিত্ব। দুজন প্রার্থীর বাড়ি একই জায়গায়- নিইউয়র্ক। ১৯৪৪ সালের পর থেকে এরকম একই রাজ্য থেকে দুজন প্রার্থী আর প্রতিদ্বন্দিতা করেননি। টেক্সাস সিনেটর ট্রেড ক্রুজ, ফ্লোরিডা সিনেটর মার্কো রুবিওসহ অন্যদের পরাজিত করে রিপাবলিকান পার্টির প্রেসিডেন্ট প্রার্থী মনোনীত হন ট্রাম্প। অপরদিকে ভারমন্ট সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্সসহ অন্যদের পরাজিত করে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রেসিডেন্ট প্রার্থী মনোনীত হয়েছেন হিলারি ক্লিনটন। আমেরিকার নির্বাচনে হিলারিই প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট প্রার্থী। নির্বাচিত হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২৪০ বছরের ইতিহাসে তিনিই হবেন প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট। নির্বাচিত হলে ঐতিহ্য অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট তাঁর দায়িত্ব গ্রহণ করবেন ১০ জানুয়ারি। সংবিধানে সুনির্দিষ্টভাবে নির্বাচন ও দায়িত্ব গ্রহণের তারিখ উল্লেখ রয়েছে। ৮ নভেম্বর থেকে ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত সময়কালকে বলা হয় অন্তর্বর্তীকালীন সময়। এ সময়ে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে জাতীয় ঘটনাবলি সম্পর্কে অবহিত রাখা হয়। তাঁকে ‘নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট’ (President Elect ) বলে অভিহিত করা হয়। এ অন্তর্বর্তীকালীন সময়টি নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট তাঁর মন্ত্রী পরিষদ গঠন এবং শীর্ষস্থানীয় দায়িত্ব বণ্টনের কাজে ব্যয় করেন।
দুই.
যা হোক, সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী হিলারি ৪৫ এবং ট্রাম্প ৪২ শতাংশ ভোটে এগিয়ে রয়েছেন। শেষ মুহূর্তে হিলারি হানা দিচ্ছেন ট্রাম্পের দুর্গ বলে খ্যাত অঙ্গরাজ্যগুলোতে। আর ট্রাম্প চেষ্টা করছেন হিলারির ভোট কাটতে। এর আগে গৃহীত জনমতে হিলারি নিরাপদ দূরত্বে এগিয়ে ছিলেন। কিন্তু নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসতে থাকে ততই দূরত্ব হ্রাস পেতে থাকে। এর একটি কারণ ‘ঘরের ছেলে ঘরে ফেরা’। আমাদের দেশেও দেখা যায় প্রথমদিকে দলীয় প্রার্থী পছন্দ না হলে সমর্থন না দেওয়া। কিন্তু ভোট যতই ঘনিয়ে আসতে, থাকে ততই বাড়তে থাকে দলীয় চাপ। অবশেষে নিজ মনস্তত্ত্বের লড়াইয়ে নিজেই হেরে যান। নিজের প্রার্থীকে ভোট দেন অবশেষে। ট্রাম্পের কথাবার্তা ও আচার আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে এতদিন অনেক রিপাবলিকান কর্মী হাত গুটিয়ে ছিলেন। যখন দেখলেন ট্রাম্প এগিয়েছেন কিছুটা, তখন মন ঘুরে গেল অনেকের। অন্য আরেকটি কারণ হলো, নির্বাচনের মাত্র ১০ দিন আগে এফবিআই যখন হিলারি ক্লিনটনের ই-মেইল অভিযোগের দ্বিতীয়বার তদন্তের নির্দেশ দেয়, তখন বিতর্কের বিষয়টি ট্রাম্প শিবিরের পক্ষে যায়।
প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে দূরত্ব কমার আরো কারণগুলো হলো : ১. হিলারিবিরোধী ইহুদী তথা কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর নির্বাচন প্রাকমুহূর্তে অঘটন ঘটাতে পারে বলে পর্যবেক্ষকরা শঙ্কিত ছিলেন। ঠিক তাই হলো। ২. আল-কায়দা মরে ভূত হয়ে গেলেও এফবিআই নির্বাচনের দিন আল-কায়দার হামলার কথা বলেছে। ৩. এখন আবার তারা সাইবার হামলার আশঙ্কা করছে। ৪. হিলারির সমর্থকরা নীরব। আর ট্রাম্পের সমর্থকরা সরব। নির্বাচনের দিন হিস্পানিক, কৃষ্ণাঙ্গ, মুসলিম ভোটাররা যাতে হাজির না হয়, সে জন্য এ আগে তারা ভীতি ছড়িয়েছে। মিথ্যাচার করেছে।
সর্বশেষ খবর উৎসাহব্যঞ্জক। এফবিআইর সর্বশেষ বিবৃতি দ্বারা হিলারি অভিযোগমুক্ত হয়েছেন। এতে চাঙ্গা হয়েছে হিলারির ভোটাররা। পত্রিকায় খবর এসেছে, আমাদের দেশের নির্বাচনীকর্মীদের মতো তাঁরাও নাকি নাওয়াখাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। একজন নির্বাচন বিশেষজ্ঞ মন্তব্য করেন, ‘ভোটাররা যদি বাড়ি থেকে বের হন, হিলারি জিতবেন।’ আরো খবর হিলারির কর্মীরা আমাদের মতো ভোটারদের বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন। তারুণ্যের উচ্ছলতায় উজ্জীবিত হিলারি শিবির। অপরদিকে মাস্তান, রক্ষণশীল, শ্বেতকায় এবং প্রবীণরা ট্রাম্পকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছেন। ট্রাম্পের স্বঘোষিত শত্রুপক্ষেও জোরতৎপরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। কালোদের উৎসাহিত করতে হিলারি বলেন, ‘মার্কিন লুথার কিং উঠে দাঁড়িয়েছিলেন বলে ওবামা দৌড়াতে পেরেছেন। ওবামা দৌড়াতে পেরেছেন বলেই কালো শিশুরা এখন ওড়ার স্বপ্ন দেখে।’
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অভিবাসীদের দেশ। ইউরোপের বিশেষত ব্রিটিশদের প্রধান্য থাকলেও ক্রমশ অন্যরা প্রাধান্য অর্জন করছে। কালো-ধলো-বাদামি নানা রঙের বৈচিত্র্য সত্ত্বেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার প্রায় আড়াইশ বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য, আদর্শ অভিন্নতা দিয়ে একটি শক্ত ভিত্তির ওপর তাদের রাষ্ট্রকাঠামোকে দাঁড় করিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র শত শত বছরের সাধনার মধ্য দিয়ে ‘বৈচিত্র্যের মাঝে যে ঐক্যের সঞ্চার করেছে, তা আজকের নির্বাচনে আশা করি প্রতিফলিত হবে। ‘স্ট্রংগার টুগেদার’ ধারণার দর্শন বিজয়ী হবে।
লেখক : গবেষক, প্রাবন্ধিক, অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।