মার্কিন নির্বাচন
বিশ্ব কি ট্রাম্পকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত?
৮ নভেম্বর পোলস্টার ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের ভ্রান্ত প্রমাণ করে দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। যদিও আগে ভোটার জরিপে হিলারির চেয়ে পিছিয়ে ছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে সাম্প্রতিক কিছু নির্বাচন বিভিন্ন দেশে প্রমাণ করেছে যে, ভোটার জরিপ আর নির্বাচন ফল সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী হতে পারে। যদিও ডোনাল্ড ট্রাম্প বিতর্কিত বক্তব্য দিয়ে প্রায় সব ধরনের সুস্থবুদ্ধির মানুষকে তাঁর বিপক্ষে দাঁড় করিয়েছিলেন। তারপরও তাঁর হাতে রয়েছে একটি বড় ট্রাম্পকার্ড। আর সেটি হলো ইমিগ্রেশন তথা অভিবাসী প্রবেশ দমনে তাঁর শক্ত অবস্থান।
জুলাইয়ের ব্রেক্সিট নির্বাচনে সারা বিশ্ব বিস্ময়ভরা চোখে দেখেছে কমনসেন্স। অর্থনৈতিক যুক্তি উপেক্ষা করে ব্রিটেনের তথা ইংল্যান্ডের মানুষ ব্রিটেনে অভিবাসন ঠেকাতে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে আসার পক্ষে ভোট দিয়েছে। জয় হয়েছে বিদ্বেষ, উদারহীনতা আর ঘৃণার। দ্বিতীয় বিশ্ব-পরবর্তী ব্রিটেনের অনেক অর্জনই আজ হুমকির সম্মুখীন। তাই যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন। এতে সামান্যতম অবাক হওয়ার কিছু নেই। ডোনাল্ড ট্রাম্প হবেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট।
মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ভিত্তিমূলে ২৪০ বছরের ইতিহাসে এক চরম আঘাত। হয়তো চেক অ্যান্ড ব্যালান্সের আওতায় সহ্য করতে পারবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু বিশ্ব রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে যে চরম অস্থিরতা সৃষ্টি করবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এই প্রেক্ষাপট বিশ্বের জন্য কি বয়ে আনবে ডোনাল্ড প্রেসিডেন্সি?
অবশ্যই, মার্কিন স্ট্যাবলিশমেন্ট শঙ্কিত তাদের অবস্থান নিয়ে। ক্যাম্পেইনকালে তাঁর মন্তব্য যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন ব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ, তা ইতিমধ্যে সমগ্র বিশ্বে মার্কিন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকেই হেয়প্রতিপন্ন করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে যাঁরা একমাত্র পরাশক্তি দেখতে চান না, তাঁদের জন্য ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্সি আশীর্বাদ হয়ে এলেও আসতে পারে। তবে সবচেয়ে বড় শঙ্কা হলো, সমগ্র বিশ্বব্যবস্থা টালমাটাল হওয়ারও একটা বড় সম্ভাবনা রয়েছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো একজন ব্যক্তিত্ব পৃথিবীর সর্ববৃহৎ সামরিক ও অর্থনৈতিক পরাশক্তির প্রেসিডেন্ট হলে সমগ্র বিশ্বে আবারও অর্থনৈতিক মন্দার কালো মেঘ নেমে আসতে পারে এবং বিশ্বের রাজনৈতিক ব্যবস্থা পড়তে পারে ভয়াবহ গোলমালের মাঝে। ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর নির্বাচনী অঙ্গীকার অনুসারে যদি যুক্তরাষ্ট্র থেকে সব অবৈধ অভিবাসীকে বের করে দেওয়া শুরু করে, তাতে শুধু মেক্সিকান নয়, বাংলাদেশিদের ওপরও এর প্রভাব পড়বে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের মস্তিষ্ক বিকৃতির চরম খেসারত দিতে হতে পারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ সারা বিশ্বকে।
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের হাতে থাকবে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ নিউক্লিয়ার অস্ত্রের বাটন এবং পৃথিবীর একমাত্র রাষ্ট্র, যে রাষ্ট্র এর আগে এই অস্ত্র ব্যবহার করেছে। তাই ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্সি বিশ্বকে ফেলতে পারে এক ভীতিকর অবস্থায়। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আবার জন্মও দিতে পারেন এক নতুন বিশ্বব্যবস্থার। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে গুটিয়ে নিতে পারে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল থেকে, যা বিশ্বকে নতুন মেরুকরণের সুযোগ করে দিতে পারে।
বিশ্বব্যাপী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খবরদারি কমে গেলে বিশ্ব নতুন মেরুকরণের পথ খুঁজে পেতে পারে। কিন্তু সমস্যা হলো, ওত পেতে থাকা অন্য পরাশক্তিগুলো নিশ্চয় হাত গুটিয়ে বসে থাকবে না, বিশেষ করে চীন, রাশিয়া; যেমন আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তাদের অবস্থান করে নিতে মুহূর্ত বিলম্ব করবে না, সেইসঙ্গে আঞ্চলিক পরাশক্তি, যেমন—ইন্ডিয়া, জাপান, সাউথ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া চেষ্টা করবে তাদের অবস্থান করে নিতে। আর এই প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করতে পারে এমন অবস্থা, যা বিশ্বের জন্য সুখের নাও হতে পারে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্সি সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করবে বিশ্বের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রাকে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট একজন সফল ও শক্তিশালী প্রেসিডেন্ট হিসেবে বিবেচিত হওয়ার অর্থ হলো প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে শাসন করতে চান একই ধারায়।
বিশ্ববাসী এরই মধ্যে আমরা দেখেছি, উত্থান হচ্ছে অভিবাসী বিদ্বেষী, নারীকে অপমানকারী, ধর্মীয় বিভেদ সৃষ্টিকারী নেতৃত্বের, যারা আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয় এবং বিশ্বব্যবস্থার জন্য হুমকিস্বরূপ। সর্বশেষ ফিলিপিনো প্রেসিডেন্টের ধারাবাহিকতায় ডোনাল্ড ট্রাম্পও হয়তো নির্বাচিত হবে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশের রাষ্ট্রপতি। ডোনাল্ড ট্রাম্পের Make America Great Again স্লোগানের সঙ্গে হিটলারের জার্মানিকে পূর্ণ শক্তিশালীকরণ প্রপাগান্ডার যে এক অবিশ্বাস্য মিল দেখা যাচ্ছে, সেই প্রেক্ষাপটে বিশ্ব কি প্রস্তুত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অভিষেকের জন্য?
লেখক : ব্যারিস্টার মাসুদ আখতার, অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।