ট্রাম্প
নতুন প্রেসিডেন্ট কথা রাখবেন তো?
নির্বাচন বিশেষজ্ঞ, সংবাদ বিশ্লেষক, পোলস্টার সর্বোপরি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ সমগ্র বিশ্বকে চমক দিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাঁর বিজয়ের বক্তৃতায় সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপে আবির্ভূত হয়ে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী আদব বজায় রেখে যেমন তাঁর প্রতিপক্ষকে অভিবাদন জানিয়েছেন ঠিক তেমনি ভাবে বলেছেন বিভেদ ভুলে তিনি ঐক্যবদ্ধ আমেরিকার সবার প্রেসিডেন্ট হতে চান।
পৃথিবীর সর্ববৃহৎ অর্থনীতি ও পরাশক্তির প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব যে ব্যক্তি নিতে যাচ্ছেন এবং তাঁর নির্বাচনী প্রচারণাকালীন বক্তব্য সমগ্র বিশ্বকে চরম উৎকণ্ঠার মাঝে ফেলে দেয়। সেই প্রেক্ষাপটে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিজয়ী-বক্তব্য কিছুটা হলেও স্বস্তি নিয়ে আসে।
নব নির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে তাই বিশ্ব নেতাদের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা বার্তা পেতে বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়নি। ট্রাম্পের এ বিজয় বিশ্বকে হতবাক করলেও বিশ্ব নেতারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনসাধারণের ভোটে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে যে যার অবস্থান থেকে শুভেচ্ছা বার্তা পাঠাচ্ছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ম অনুসারে ৯ নভেম্বর থেকে ২০ জানুয়ারির আগে পর্যন্ত নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করবেন না। তবে এই সময়ই বুঝা যাবে কেমন হবে নতুন রাষ্ট্রপতির শাসনের ধরন। কারণ এই সময়েই গঠিত হবে নতুন মন্ত্রিসভা ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসন নীতি।
ডোনাল্ড ট্রাম্প অত্যন্ত চতুর ব্যবসায়ী তাই খুব চমৎকারভাবেই নকল করেন ব্রিটেনের ব্রেক্সিটের পক্ষের রাজনীতিবিদদের কৌশল। ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৭২% শতাংশ শ্বেতাঙ্গদের মাঝে একটি বিশাল ঐক্য গড়ে তোলেন ইমিগ্রেশন বিরোধী কঠোর তর্জন-গর্জনের মাধ্যমে। তার বক্তব্য যতই অবাস্তবতায় ভরপুর হোক সাধারণ জনগণ তার সহজ সমাধানকে খুব সহজেই একমাত্র সমাধান হিসেবে মেনে নিয়েছে।
অর্থাৎ ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনী অঙ্গীকারগুলোকে তাদের মনের কথার সাথে মেলাতে পেরেছে আর তাই বিশাল নীরব জনগোষ্ঠী ভোটের বাক্সে নীরব বিপ্লব ঘটিয়েছে যা কি না নির্বাচন বিশেষজ্ঞ আর মিডিয়ার এন্টেনার বাইরে রয়ে গিয়েছিল। তাই এ নির্বাচন সবাইকে অবাক করে দেওয়ার নির্বাচন।
নির্বাচনে যে মিথ্যা, চটকদার আর অবিশ্বাস্য প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচিত হওয়া যায় তার শ্রেষ্ঠ প্রমাণ ডোনাল্ড ট্রাম্প। ২০ জানুয়ারি ২০১৭ থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে তার প্রতিশ্রুতি পূরণে কাজ করতে হবে এবং তার প্রতিশ্রুতি গুলোর খুব দ্রুত বাস্তবায়ন চায় তার সমর্থকরা যা কি না উঠে এসেছে বিবিসির জরিপে। এই পাঁচ প্রতিশ্রুতির মধ্যে রয়েছে- মেক্সিকো বর্ডারে অতি মজবুত একটি প্রাচীর নির্মাণ করা যাতে করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মেক্সিকো থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভাষায় কোনো রেপিস্ট, ক্রিমিনাল আর যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে না পারে। ডোনাল্ড ট্রাম্প চান প্রাচীর নির্মাণের ব্যয় বহন করবে মেক্সিকো, যার খরচ হতে পারে ২.২ বিলিয়ন থেকে ১৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মধ্যে।
রিপাবলিকান পার্টির ন্যাশনাল কংগ্রেসের সময় থেকে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এই স্লোগানটি ‘Lock her up’ যার মানে হলো হিলারীকে জেলে ঢুকাও, ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাপোর্টারদের মধ্যে এই দাবিটি ব্যাপক ভাবে জনপ্রিয় এবং তাদের প্রত্যাশা ট্রাম্প হিলারিকে দ্রুতই জেলে পাঠাবেন। যে পদ্ধতিতে ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজে এবং তার সমর্থকরা চান হিলারিকে আটক করে জেলে পুরতে তা এখন তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতেও কমে গেছে। তবে তা রাশিয়ায় সচরাচর দেখা যায়। ট্রাম্পকে হয়তো তার রাজনৈতিক আদর্শ গুরু ভ্লাদিমির পুতিনের কাছ থেকে পরামর্শ নিতে হতে পারে। তবে কোনো কারণে ডোনাল্ড ট্রাম্প ব্যর্থ হলে তার পরিণতি দেখবার জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।
এরপর সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রতিশ্রুতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষ থেকে তাঁর সমর্থকদের কাছে হলো সাময়িক ভাবে মুসলমানদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ নিষিদ্ধকরণ। যদিও ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স বলেছেন এই নীতি থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্প সরে এসেছেন কিন্তু রূঢ় বাস্তবতা হলো এটি তাঁর সমর্থকদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং তাঁর সমর্থকরা দৃঢ় ভাবে প্রত্যাশা করে যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাঁর এই প্রতিশ্রুতি পালনে সামান্যতম বিচ্যুত হবেন না। কিন্তু বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায় তা বাস্তবায়ন কতটুকু সম্ভব হবে তা একটি বিরাট প্রশ্ন। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় জনগোষ্ঠীকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ থেকে কীভাবে বিরত রাখবেন তা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।
তবে বলা যেতে পারে এ রকম কোনো কার্যক্রম হাতে নিলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে অন্যের কাছ থেকে দূরে রাখতে গিয়ে নিজেই একা হয়ে যেতে পারে।
ট্রাম্প সমর্থকরা চায় বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ওবামার ফ্লাগশিপ আইন অ্যাফোর্ডেবল কেয়ার অ্যাক্ট ২০১০-এর বাতিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে এটি জনপ্রিয় হলেও রিপাবলিকানদের কাছে এটি খুবই অপ্রিয়। তবে এই দাবিটি পূরণে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প হয়তো সহজেই সমর্থ হবেন কারণ ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হবেন সেই প্রেক্ষাপটে যখন তিনি পাবেন রিপাবলিকান মেজোরিটি কংগ্রেস ও সিনেট। তাই এই দাবি যে খুব দ্রুতই পূরণ হতে যাচ্ছে তাতে সন্দেহ নেই।
বাস্তবতা হলো ট্রাম্প এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। তাঁর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলো তিনি কীভাবে বাস্তবায়ন করবেন তার ওপর নির্ভর করবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তথা আগামী দিনের আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি।
বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের একজন হিসেবে আমাদের প্রত্যাশা থাকবে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিধর রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর ব্যাপক ক্ষমতা দায়িত্বশীলতার সাথেই প্রয়োগ করবেন।
লেখক : অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট