জার্মানির পথে পথে

চার পাহাড়ের পিরমাসেনস

Looks like you've blocked notifications!
ছবি : নাসরুনা তাবাসসুম

আজ কিন্তু ভারী জ্যাকেট নিয়ে নিও। একটু অবাক হলাম শুনে। তখনো ঠান্ডা পড়েনি তেমন। জার্মানির চারটি ঋতুর একটি হেরবস্ট (আমরা ইংরেজিতে হয়তো অটাম বলি যাকে) চলছে তখন। শীত আসি আসি ভাব। আমি কৌতূহলী হয়ে মি.-কে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমরা কোথায় যাচ্ছি, উত্তরে?’ যথারীতি হাসিমাখা রহস্য, ‘দেখো, কোথায় নিয়ে যাই, পাহাড়ের উপরে একটা শহরে।’ পাহাড় শুনলেই আমার আনন্দ দেখে কে, সেটা বাংলাদেশের বান্দরবান হোক আর বিদেশ যেখানেই হোক।

উইক এন্ডের ছুটির দিনটা বা একদিন ছুটি কাটাতে সাধারণত এক দেড় ঘণ্টা কার ড্রাইভের দূরত্বের বেশি যাওয়া হয় না, এখানেও এক ঘণ্টার কিছু বেশি সময় লাগল। দূরের যাত্রায়, হাইওয়ে রোডগুলোর (এখানে বলে আউটোবান) দুই পার্শ্বের দৃশ্য সব সময়ই মনোমুগ্ধকর।


সবচেয়ে এক্সাইটিং লাগে, যখন রাস্তাটা আস্তে করে পাহাড়ের ওপর উঠে যায় আর এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে অনেক উঁচু দিয়ে সেতুর ভিতর দিয়ে যায়। নিচে, বহু নিচে রাস্তা, নদী বা ছোট পাহাড়। ওপর থেকে ছড়ানো-ছিটানো অন্যান্য পাহাড়ের ওপরের শহরগুলো দেখতেও রোমাঞ্চ লাগে।

জার্মানির রাস্তাঘাট এত চমৎকার (স্মুথ) যে, সাইডে খেয়াল না রাখলে কখন যে এক পাহাড় ডিঙিয়ে অন্য পাহাড়ে চলে এসেছি, টের পাওয়া যায় না। তবে সেতু শুরু হলে উঁচু করে রাস্তার পাশের রেলিং দেওয়া থাকে, কাচের বা মোটা হার্ড প্লাস্টিকের। টানা বা ঝুলন্ত সেতু ও থাকে। কোথাও কোথাও টানেলের ভেতর দিয়েও এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে যেতে হয়, যা সত্যিই রোমাঞ্চকর।
ইউরোপের সৌন্দর্য বলতে সাধারণত সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্সের প্যারিস, অস্ট্রিয়া এগুলোর নামই আমাদের মনে আসে। নিঃসন্দেহে এই প্রত্যেকটা দেশ, শহর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার। কিন্তু জার্মানি ও কোনো দিক দিয়ে কম নয়। এমনই একটি প্রান্তিক নয়নাভিরাম শহর পিরমাসেনস (Pirmasens)। ওইদিকে বাস বা ট্রেন স্টেশনের এটাই জার্মানির শেষ স্টপেজ।

রাইনলান্ড-পালাটিনেট হচ্ছে ফ্রান্স,বেলজিয়াম ও ক্ষুদ্রায়তনের ইউরোপীয় দেশ লুক্সেমবুরগ বেস্টিত জার্মানির ১৬ টি স্টেট-এর অন্যতম একটি স্টেট, যা রাইনলান্ড-ফালস নামেই পরিচিত এবং এর রাজধানী হচ্ছে মাইনজ (Mainz) এবং পিরমাসেনস শহরটি দক্ষিণ-পশ্চিম জার্মানির এই স্টেটের ই একটি প্রাচীন শহর।
শহরে ঢুকে রাস্তার পাশে গাড়ি পার্ক করে শহরে হাটতে বের হলাম। তখনই কনকনে ঠান্ডাটা টের পেলাম। জ্যাকেট না নিলে খবরই ছিল। পাহাড়ের ওপরে হওয়াতে লাল হলুদের রাজত্বেও ঠান্ডা বেশি। সব শহরের মতোই সেন্ট্রাল মারকটপ্লাটস এর দিকে গেলাম। তখনি ইংরেজিতে হোটেল লেখা একটী দুই তিনশত বছরের পুরোনো জীর্ণ ভবন দেখিয়ে মি.বললেন যে, এই হোটেলে প্রায় আড়াই বছর উনি কাটিয়েছেন, প্রথম জীবনে ইউরোপে এসে। বাঙালি বুদ্ধিতে কীভাবে পলিব্যাগ এর ভেতরে খাবার রেখে জানালার বাইরে ঝুলিয়ে রাখত, ঠান্ডায় খাবার টাটকা থাকার জন্য, এমন অনেক আনন্দ-দুঃখের কাহিনীও শুনলাম। বহু স্মৃতি এই শহর জুড়ে, প্রায় ২৫ বছর পর নব্য এই আমাকে নিয়ে এখানে আসা। হাঁটতে হাঁটতে একটা সেন্ট্রাল তিনতলা আন্ডারগ্রাউন্ড কার পারকিং এরিয়া তে গেলাম। কৃত্রিম ফোয়ারা, টাওয়ার, ফুলগাছ, ভাস্কর্য, বসার জায়গা সব কিছু মিলিয়ে সুন্দর। ভালো লাগল, ভাবলাম এই ছোট শহরে এর চেয়ে বেশি আর কি বা থাকবে।

পাহাড়ি শহর বিধায় রাস্তাঘাট গুলো কোথাও বেশ খাড়া,নামার সময় আবার ঢালু।রাস্তা ধরে হাটলে এমনিতেই পৌরাণিক গা ছমছমে ভাব আসে, পুরোনো বাড়িঘরের প্যাটার্ন, গির্জা বা যে কোন স্থাপনা দেখলেই।দেখার তখনো বাকী, মূল মারক্টপ্লাটস এ যাওয়ার সময় একটা সিংহদার এর মতো চোখে পড়লো, তার ওপর পুরনো আমলের রোড ল্যাম্প,রাস্তাটা ঢালু নেমে গেছে। ফ্রাংকেন্সটাইনের গল্প মনে পড়ে যায়।অনেক দোকানপাট, খাবার দোকান ছাড়া সবকিছুই বন্ধ।সেদিনটি ছিল পূর্ব ও পশ্চিম, দুই জার্মানি একত্রীকরণের সেই বিশেষ দিন, ৩রা অক্টোবর, তাই সরকারি ছুটি ছিল। সেই সঙ্গে অনেক বড় বড় দোকান খালি পড়ে আছে যেটা অন্য শহরে চিন্তাই করা যায় না। শহরটি আর আগের মতো জমজমাট নেই। বেকার সমস্যা এখানে প্রকট, লোকজন খুব কম, রাস্তায় খুব অল্প মানুষ এই ছুটির দিনেও। এমনিতেই ঠান্ডা, লোকজন না থাকায় আরো ঠান্ডা যেন জেঁকে বসেছে।

রাস্তার ওপর অনেক মুড়্যাল আর ভাস্কর্য দেখতে দেখতে মুল ফোয়ারার কাছে এসে আমার চোখ কপালে। হা করে তাকিয়ে আছি,সব মারকটপ্লাটসই দেখার মতো থাকে কারণ এখানে সবাই আড্ডা দেয়,হাটাহাটি করে,বাচ্চারা খেলে। কিন্তু এত দারুণ, প্রায় চার-পাঁচতলা সমান ফোয়ারা, মাঝে ভাস্কর্য, উপর থেকে ধেয়ে আসা পানি, পাশ দিয়ে যে সিড়ি টা উঠে গেছে, সবকিছু মিলিয়ে এত সুন্দর, ছোট্ট কিন্তু ঠান্ডা শহর এই প্রথম দেখলাম। সিড়ি দিয়ে উঠলে একটা মনকাড়া রেস্টুরেন্ট আছে। সেখানে বসে কফি খেলাম আর চারপাশের দৃশ্য, নিচে খেলায় মত্ত শিশুদের খেলা উপভোগ করলাম।আসলে একটা পাহাড় কেটে ফোয়ারাটা বানান হয়েছে। 
ওপরের দিকের রাস্তায় ও গাড়ি চলছে। নিচের হাঁটার রাস্তাটায় (ফুসগ্যাংগার জোন বলে এখানে) এমনভাবে সাদা রং দিয়ে ঢেউ-এর মতো পেইন্ট করা, হঠাৎ করে দেখলে মনে হয়, ওপর থেকে পানি পড়েই মনে হয় ঢেউয়ের সৃষ্টি। কিছু কিছু সৌন্দর্য নিজ চোখে না দেখলে বোঝানো কঠিন। ছবিতেও তা ধরা পড়ে না। ফোয়ারার সিঁড়িতে বসলে সামনের গির্জার কারুকাজ বিমোহিত করে।

পিরমাসেনস নামক পুরনো এই শহরটি জুতা তৈরির কলাকৌশলের জন্য বিখ্যাত ছিল। জার্মানির সবচেয়ে পুরনো জুতা প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান 'পেটার কাইজার জিএমবিএইচ' (Peter Kaiser GmbH) এই শহরেই ছিল। মূল শহরের অদুরেই জুতার মিউজিয়াম আছে।আরো আছে বিজ্ঞান জাদুঘর, জিয়েগফ্রিএড লিনে জাদুঘর (Siegfried Line Museum)। কবি, লেখক এবং সাউন্ড পয়েট্রির সূচক 'হুগো বল’ (Hugo Ball) এবং জার্মান ফুটবলার 'এরিক দ্রুম' (Erik Drum), ২০১৪ এর জাতীয় দলে যার অভিষেক হয়েছিল, তাদের জন্মস্থান এই পিরমাসেনস।
চায়নিজ রেস্তোরাঁটাও বন্ধ থাকায় খুজে খুজে একটা তুর্কী খাবারের দোকানে গিয়ে ‘ইউফকা’ (ডোনারের মাংস,সালাদ,মেয়নিজ বা সস দিয়ে মোড়ানো নান রুটি)দিয়ে দুপুরের খিদে মিটালাম। ইউরোপে কেউ হালাল খাবার খেতে চাইলে নিঃসন্দেহে তুর্কী দোকানের খাবার খেতে পারেন।জার্মান খাদ্য গবেষকদের মতে, যত রকম 'ফাস্ট ফুড'খাবার আছে তার ভিতর তুর্কি খাবার, বিশেষ করে 'ডোনার' হচ্ছে সবচেয়ে স্বাস্থ্যসম্মত।আরো একটু ইতিউতি ঘুরে গাড়িতে ফিরে গেলাম। অতঃপর বাড়ির দিকে রওনা দিলাম।

ইউরোপে ঘুরতে এসে যাঁরা খুব নিরিবিলি সময় কাটাতে চান, তাঁদের জন্য এটা একটা আদর্শ জায়গা। সঙ্গে আরো ৩ দেশের বর্ডার থাকায় কয়েকটা দেশ ঘুরতেও সুবিধা।সব সময় ই বলি,ইউরোপের ভাঁজে ভাঁজে ইতিহাস আর সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে।সময় আর সাধ্যের সমন্বয় হলে ঘুরে দেখুন।

প্রয়াত মাহমুদ ভাই (বেড়াই বাংলাদেশ)-এর মতো বিশ্বাস করি, 'প্রবহমান জলে শ্যাওলা জমে না।'