পরবাসী জীবন

Looks like you've blocked notifications!

আমি যখন বাংলাদেশে ছিলাম তখন বারবার প্রবাসে যাওয়ার ইচ্ছে কাজ করছিল। প্রবাসে যাওয়ার একটি কারণই প্রধান ছিল। সেটি হল প্রবাসে গেলে ভালো আয়-রোজগারের ব্যবস্থা হবে। ভালোভাবে থাকতে পারব। পরিবার-পরিজন সুখে থাকবে। সেজন্যই একদিন পাড়ি জমালাম মরুর দেশ সৌদি আরবে। তখন ২০০৯ সাল। যেদিন গিয়ে পৌঁছলাম সবকিছু ঠিক ছিল। প্রবাসে আসার আনন্দে ও নতুন দিনের স্বপ্ন দেখে খুব উচ্ছল ছিলাম। কিন্তু কদিন যেতে না যেতেই স্বদেশের শূন্যতা টের পেলাম। এখানে কত কত মানুষ। কিন্তু কাউকে চিনি না। কেউ আমার ভাষায় কথাও বলে না। আমার সুখ, দুঃখগুলো ভাগাভাগি করব কার সাথে? দেশে তখন মোবাইলে কল করলে প্রচুর টাকা খরচ হতো। সেজন্য খুব বেশি কথা বলা হতো না। কেবল উপার্জনের চিন্তা ছিল।

দেখতে দেখতে মাস কেটে গেল। মা ও মাতৃভূমির প্রতি টান আমার প্রবল হয়ে ওঠল। অনেক বেশি পরিবারকে মিস করতে লাগলাম। কী বলব, বুক ফেটে কান্না আসত প্রায়ই। চাকুরি নিয়ে আমার কোনো সমস্যা ছিল না। বেতনও ভালো পেতাম। কেবল পরিচিত মুখগুলো দেখতে পাই না। সুখ-দুঃখ আনন্দের কথাগুলো কাউকে বলতে পারি না। অবসরের দিনগুলো অনেক আগে থেকেই বিদায় নিয়েছে আমার কাছ থেকে। কাজ আর কাজ। অবসর পেলেই আমার গ্রামের কথা মনে পড়ে। একসময় আমি গ্রামে গ্রামে মঞ্চ নাটক করে বেড়াতাম। সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান করে বেড়াতাম। কবিতা, গল্প লিখতাম পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা। সাংবাদিকতাও করতাম। সৌদি আরব এসে বছর খানেকের মধ্যে ঘুরে দাঁড়াতে চেষ্টা করলাম। কেবল অর্থ দিয়ে কী হবে। আমি আমার শখগুলোর চর্চা আবার শুরু করলাম। মঞ্চ নাটক লিখলাম। সংগঠন করা শুরু করলাম। আমার হারানো দিনগুলো ফেরত আসা শুরু হলো। সৌদি আরব থেকে সাংবাদিকতা শুরু করলাম। স্থানীয় ও জাতীয় অনেক সংবাদপত্রের সাথে জড়িত হলাম। অনেক বাঙালি বন্ধু জুটে গেল। আরবি ভাষা ভালোভাবে আয়ত্ব করে ফেললাম তত দিনে। সবমিলিয়ে ভালোভাবে দিন চলে যাচ্ছিল। কিন্তু মায়ের স্নেহ, বোনের আদর কোথায় পাব? তবু মনের মধ্যে কোথাও শূন্যতা খেলা করত মাঝেমধ্যে। অবশ্য একসময় সব মানিয়ে নিয়েছিলাম।

কত দিন রোদে পুড়েছি। বাংলাদেশের বৃষ্টিকে তখন খুব মিস করতাম। আমাদের প্রকৃতি ও সৌদি আরবের প্রকৃতি এক নয়। আমাদের প্রকৃতি যত কোমল, ওখানকার প্রকৃতি তত রুক্ষ। এরমধ্যে অনেকবার দেশে এসেছি। প্রতিবার দেশে এসেছি অপার আনন্দ নিয়ে। কিন্তু যখন ফিরে যাচ্ছি, মনে হতো আর না যাই। সৌদি আরবে এলে পরের চার-পাঁচদিন খুব খারাপ কাটত। সম্প্রতি বাংলাদেশে এসেছি একুশে বইমেলায় উপলক্ষে। এ মেলায় আমার একটি কবিতাগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। দেশে এসেছি অনেক আনন্দ নিয়ে। পরিবার, পরিজন নিয়ে অনেক আনন্দে কেটেছে দিনগুলো। এখন আবার কদিন পর সৌদি আরবে পাড়ি জমাব। আমার ছুটি শেষ হতে আর অল্প কদিন বাকি। এখন মন খারাপ লাগছে। আমি জানি মক্কায় পৌঁছানোর পর আবার ব্যস্ত হয়ে পড়ব অফিসের কাজে। দেখতে দেখতে আবার সব সয়ে যাবে। স্বদেশের কথা মনে পড়বে, মায়ের কথা মনে পড়বে, আবার বাড়ি ফিরতে মন চাইবে। এভাবেই কেটে যাবে আমার প্রবাসী জীবন।

লেখক : সৌদিআরব প্রবাসী।