দেশের স্মৃতি

যাদের ঈদে ফেরা হয় না

Looks like you've blocked notifications!

প্রথম যেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হওয়ার জন্য ঈগল পরিবহনের একটি বাসে চেপে বসেছিলাম-সেদিন বুঝিনি আর ফেরা হবে না এখানে। তখন নড়াইলের লোহাগড়া থেকে বাস যশোর হয়ে ঢাকা যেত, রাস্তা ছিল ৩২০ কিলোমিটার। সকালে উঠলে সন্ধ্যা লেগে যায়।

বাস যত সামনের দিকে যাচ্ছে আর পেছনে পড়ে যাচ্ছে রামপুরা, এড়েন্দা, দত্তপাড়া, বুড়িখালি, সীমাখালি। চারপাশে রাই সর্ষে হলুদ হয়ে আছে প্রান্তর। আমি মুখ লুকিয়ে কাঁদছি। কাঁদছি আমার পুরনো ভাঙাবাড়ির ছাদের জন্য, কাঁদছি আমার বাড়ির সামনে এক চিলতে ক্রিকেট আর ব্যাডমিন্টনের মাঠের জন্য, প্রচণ্ড খরতাপে পুড়তে থাকা মফস্বলের হৃদয় ছাতরার খালের গহীনে ডুব দিয়ে মাছ পোকাদের পেছনে পেছনে দৌড়ানোর জন্য।

খুব বৃষ্টি হলে ফুটবল নিয়ে আমরা নেমে পড়তাম বাড়ির সামনের ছোট্ট মাঠে, সেই তুমুল বৃষ্টিতে মাঝে মধ্যে শুরু হতো ক্রিকেট উৎসব।

তাদের কে কোথায় আছে এখন? ওর মধ্যে সব থেকে সিরিয়াস ছিল সঞ্জয় সাহা। আমাদের পুরনো ভাঙা রাজবাড়ি যেন ইডেন গার্ডেন। পাকিস্তান ভারতের ম্যাচ। সেই ভীষণ সিরিয়াস সঞ্জয় এখন কলকাতায় এখন ওষুদের ব্যবসা করছে। বলরলাম সাহা। আমাদের ক্লাসের ফাস্ট বয়। নিয়ম করে হত্যে দিয়ে সন্ধ্যাপূজা করতে হতো এমন কি ভোরবেলা উঠে নদীতে স্নান সেরে পুজো দিয়ে বসতে হতো পড়ার টেবিলে। আমাদের সেই ফাস্ট বয় এখন শিক্ষা কর্মকর্তা। আরো ছিল আলিমুজ্জামান লিন্টু। সে বেচারা এখন গরু-ছাগলের খাদ্য বানানোর কোম্পানির কর্মকর্তা। আমার ভাগ্নে ও তেমন কিছু পারত না। আমিনুর মোল্লা। সে এখন নাম পরিবর্তন করে মতি মাঝি হয়েছে। নাম পরিবর্তন নাকি জীবন পরিবর্তন সে আমি বুঝতে পারি না।

বিপ্লব সাহা, এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানের মস্ত বড় ডাক্তার। ভালো অলরাউন্ডার ছিল। তার একটিই লক্ষ্য ছিল-কীভাবে এই ছোট্ট মাঠ থেকে বলটিকে রায় বাড়ির ছাদে পাঠিয়ে দেবে। আর সেই সুযোগে রায় বাড়ির ছোট মেয়েটির সাথে একবার দেখা হয়ে যাবে। কিন্তু হলোটা কী? রায় বাড়ির ছোট মেয়ে কলকাতার কিসব ঝাল মরিচ ছাতা ফাতার ব্যবসায়ীর বৌ হয়ে জীবনটা বেগার পার করল?

ছোট ভাই লিটন ছিল সেরকম ক্ষ্যাপাটে বোলার। এখন সে উচ্চ আদালতের আইনজীবী। ও যে রেগে গেলে মানুষকে মারতে যেত। ওর পক্ষে এখন রায় না গেলে ও কি বিচারককে মারতে যায়? কতবার ভেবেছি চুপি চুপি একদিন যাব ওর সাবমিশন দেখতে। যাওয়া হয় না। সময় কই!

ওদের বন্ধু ছিল আজাদ। ওকে আমি হাতকাটা রবীন বলতাম। এক হাত নেই। রায় বাড়ির জামরুল গাছ থেকে পড়ে ওর একটি হাত নস্ট হয়ে যায়। পরে সেটি কেটে ফেলতে হয়। তো আজাদ সেই হাতকাটা রবীন এখন বিশেষ ক্রিকেটের জাতীয় দলের প্লেয়ার। ও অস্ট্রেলিয়া ইংল্যান্ডের মুখোমুখি ঢাকায় খেলেছে এবার।

সুজন ছিল চেয়ারম্যান সাহেবের ভাগ্নে। ওর একটা বোন ছিল। নবীনা। ঢাকায় নার্স কোর্সও শেষ করেছিল। এক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। সুজন ক্রিকেট খেলতে ঢাকায় এসেছিল। বড় ক্লাবে জায়গাঁও পেয়েছিল। কিন্তু মোটর বাইক এক্সিডেন্টে ওর খেলোয়াড় হওয়া শেষ হয়ে যায় মনে হয়। ও এখন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে উঠাবসা করে। তাদের সাথে সেলফি তুলে ফেসবুকে দেয়।

তো পোদ্দারপাড়া ক্রিকেট টিমটি এভাবেই যমজমাট হয়ে থাকত বর্ষা কিম্বা শীতে। এ রকম কত শত গল্প নিয়ে লোহাগড়া বসে আছে একাকী বৃক্ষের মতো।

আশ্চর্য এক নদী ছিল লোহাগড়ায়। সেটি এখন মৃতপ্রায়। দখলও কম হয়নি। প্রেসক্লাব থেকে শুরু করে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, সাবেক আর্মি কর্মকর্তার দখলে নবগঙ্গা মরাগঙ্গাতে পরিণত হয়েছে। সেই নদীর পাশে ছিল রাজু ভাইদের বাড়ি। সেখানে থাকত আশ্চর্য্য এক রুপবতী কন্যা। ওই বাড়ি ঘিরে লোহাগড়ার ছেলে-বুড়োদের ভিড় লেগে থাকত।

আমাদের বন্ধু ছিল বাসার। ছোটখাটো মানুষ। সে আরেক ছোটখাটো নারীকে ভালোবেসে ফেলে। সেই নারীর বাড়িও ছিল আশ্চায্য সেই নদীর ধারে। তাকে চুরি চুরি করে দেখতে যেতাম আমরা। আমাদের একটা চায়ের দোকান ছিল বাধা। চায়ের দোকানের পেছনে একটি চেম্বার। তখন একটি গোল্ড লিফের দাম ২ টাকা। চৌধুরী সাবের পোলা শাহনুর, প্রেমিক বাসার, ভাগ্নে বিপুল, কমরেড তনয়, কলেজপাড়ার বাবু এদের নিয়ে সেখানে ছিল আমাদের আড্ডা। মাঝে মধ্যে ৫০ পয়সায় কেনা আটার লাড্ডু বাসারের প্রেমিকার বাড়ির পেছনে ছুড়ে মারতাম।

লোহাগড়ার সমাজে আমাদের নিজের বাপেদেরও এত ভয় করতাম না যতটা করতাম লোহাগড়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক অরবিন্দ আচার্য্য অরবিন্দ স্যারকে। তিনি একদিন সেই চেম্বারের মধ্যে ঢুকে পড়লেন। আমি তখন সিগারেটের ধোয়া ছেড়ে রিং বানাচ্ছিলাম। একটি ধোয়ার রিং স্যারের মুখের দিকে চলে গেল। আমি দ্রুত সিগারেট ফেলে দিলাম। স্যার কশে আমাকে একটা থাপ্পড় মারলেন।

বললেন, টাকা দিয়ে সিগারেট কিনতে হয় না?' এরপর স্যার ওখানে এলে আগেই গলা খাকারি দিতেন। আর ওই চেম্বারে কখনোই আসেনি।

আমাদের রাজনীতি ছিল সেই লোহাগড়ায়। বাংলাদেশ ছাত্রমৈত্রী করতাম। করতাম নাটকের সংগঠন গণনাট্য সংস্থা। কমরেড বলতে তনয় কুমার বিশ্বাস। অ্যাডভোকেট শেখ হাফিজ ভাই ওরফে হাফিজ ভাইরে মোটরসাইকেলের পেছনে চড়ে যেতাম গ্রামে গ্রামে। কৃষকের সাথে মিটিং, শ্রেণি সংগ্রাম বোঝানো। কত কী। ফেরার সময় হাফিজ ভাই গল্প করত ৭১ সালে যুদ্ধ কীভাবে বেহাত হয়ে গেল। আমি শুনতাম আর ক্রোধে ফুসতাম। শ্রেণিহীন সমাজ কেমন হবে সেই গল্প হাফিজ ভাই করত। সেই হাফিজ ভাই এখন এমপি।

তনয়ের একটা মেয়ে হয়েছে। ডাক্তার চয়নেরও একটি কন্যা হয়েছে। আমাদের বিচারক সত্যব্রত সিকদার এখন ঝালকাঠি বা ওরকম কোন জেলার সিনিয়র সহকারী বিচারক। মতি মাঝির কিছুই করা হয়নি। এক নারীর প্রেমে অন্ধ হয়ে সে আমিনুর থেকে মতি মাঝিতে রুপান্তরিত হয়েছে। বিপুল মামা মাঝেমধ্যেই ফোন দেয়। এমপিকে গালাগালি করে। আমাকেও গালি দেয় মাঝেমধ্যে। আমি হজম করি। এক জীবনে কত কিছু হজম করলাম এ তো সামান্য ভর্ৎসনা।

মিন্টু কুণ্ড আদরের বন্ধু সব মিলিয়ে ৩৩ কেজি ওজন হবে। দেখা হলে বলবে, কমরেড প্রস্তুত হয়ে বসে আছি। শুধু খবর দিও মেশিন নিয়ে যুদ্ধে চলে আসব।  আর আছে ক্ষ্যাপা পাগলা সুশান্ত দা। এখনো সে পত্রিকা বের করে। সাপ্তাহিক শতাব্দীর আলো। নিজেই সম্পাদক নিজেই রিপোর্টার নিজেই আবার হকার। যে বিশ্বাস করে নতুন পৃথিবীতে সমাজতন্ত্রের যাত্রা শুরু হবে লোহাগড়া থেকে।

আমার মামাদের এলাকায় তালবাড়িয়াতে একটি পদ্ম বিল আছে। এ বিলের অপরপ্রান্তে মরমি কবি বিজয় সরকারের বাড়ি। সেই বিলের মাঝখানে লাল পদ্মফুল ফুটে থাকত। এখনো কি সেই বিলে পদ্মফুল ফোটে। বিলের বুকজুড়ে সেই আশ্চর্য লাল থেকেই বোধ হয় নকশালরা শক্তি পেয়েছিল। ১৯৭১ সালে সেই বিল দাবড়িয়ে বেড়াত তারা। কিন্তু মুজিব বাহিনী তাদের উচ্ছেদ করে। তারা হয়ে যায় পলাতক।

এখান থেকে আরেকটু দূরে নড়াইলের পেড়োলে সেখানে একদিনে ২০ জনের বেশি নকশালকে মুজিব বাহিনী খুন করেছিল সেটি যুদ্ধের সময় আগস্ট মাসে। সেখান থেকে পালিয়ে বেঁচে এসেছিলেন কমরেড বিমল বিশ্বাস। এখন তিনি মহাজোটের ওয়ার্কাস পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা। বিমল দা বলেছিল, তিনি সেই সব দিনের কথা লিখছেন। সতিই কি বিমল দা সেসব দিনের কথা লিখবেন?

আমার এক বন্ধু ছিল, বন্ধু কমরেড তৌফিক আহমেদ লেমন। ও মারা গেল সড়ক দুর্ঘটনায়। সম্ভবত ও বুঝতে পেরেছিল বেঁচে থাকাটাই একটা কারাবাসের সমান। মরে যাওয়ার আগে ও ওর মাকে ডাকছিল। এত করুণ সুরে। ওর মা তার এক বছর আগে মারা গিয়েছিলেন। আমি ওদের বাড়িতে ওর মায়ের হাতে মাংস রান্না খেয়েছি। ওর মরে যাওয়ার সিদ্ধান্তটিই ঠিক ছিল। প্রতিদিন এভাবে মরে যাওয়ার কোনো মানে নেই। বিপ্লব নেই, কবিতা নেই, কোনো স্বপ্ন পূরণের কথা নেই। এভাবে বেঁচে থাকার কোনো মানে নেই।

ওর কথা মনে হলে মনে পড়ে যায় রাজীব আহমেদ রাজু ও মাহমুদুল হাসান হীরা্র কথা। হীরা ভাই জার্মানিতে থাকে। আমি নেদারর‌্যান্ডস আসার পর ফোন দিয়েছিল। রাজু ভাই গান করেন। নিজেদের একটা ব্যান্ড আছে ‘সহজিয়া’ নামে। রাজু ভাইয়ের একটা দারুণ গান আছে। আদিবাসীদের নিয়ে। ছোট পাখি ছোট পাখি।

বড় পূজা এলে বাড়ি যেতে হবে। ঈদ-পূজা এক সাথে হলে তো কথাই নেই। মন্দির থেকে একটু দূরেই বাড়ি। মাইকে বাজছে, আমি মেলা থেকে একটা তাল পাতার বাঁশি কিনে এনেছি। বাঁশি তো আর আগের মতো বাজে না।' আমাদের ওখানে এমন কেউ ছিল না, যারা বলত প্রতিমা ভাঙলে বেহেশতে চলে যাওয়া যায়। বরং সরস্বতী প্রতিমা দেখলে বুকের ভেতরটা খাক হয়ে যেত। এমন সুন্দর। বাড়ির পাশের মেয়েটিকেই সরস্বতী মনে হোত। আহা সেই পূজার দিন মানেই নাড়ু সন্দেশ অলোকের বাড়ি যাওয়া, সত্য বাড়ির যাওয়া আর কমরেড তনয়ের বাড়ি তো যেতেই হবে। কাকিমা বসে থাকতেন। কাকা বারান্দায়। গত বছর কাকা মারা গেছেন।

আজকাল ঈদেও আর বাড়ি যাওয়া হয় না। আর কখনোই যাওয়া হবে কি না জানি না। কিন্তু গল্পগুলো ঠিকই রয়ে যাবে এক চীর বসন্তের মফস্বলের গতরের ভেতর।

লোহাগড়ার এমন কত গল্প আছে। সে যেন আজব এক জায়গার নাম। যেখানে প্রতিদিন গল্প তৈরি হয় আবার মরে যায় গল্পগুলো। নবগঙ্গার মরা বুকে জেগে উঠে চর। সেই সব চরে নতুন ধানের বাতাসে গল্পগুলো কি নাড়া খায়? আমি নিশ্চিত না। তবে গাঁও-গেরামের গতরের ভেতর সেই গল্পগুলো এখনো শেষ হয়নি। কেন জানি মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে গেলে লোহাগড়ার কথা মনে পড়ে যায়। গত কয়েকদিন ধরে ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখছি আমি মরে গেছি। মরা মানুষ হয়ে পড়ে আছি বিছানায়।

 

যদি মৃত্যু চলে আসে অকস্মাৎ কোনো বাতাসের মতো, তাহলে বলব অনেক গল্প নিয়ে আমি গত হয়ে গেলাম। অনেক কিছু বলার ছিল। প্রিয় লোহাগড়া, নবগঙ্গা, ছাতড়ার খাল। প্রিয় কলেজ, স্কুল, সিনেমা হল, বল দার চায়ের দোকান। এখনো কি ফয়েজ মোড়ে খাসির মাংসে ভয়ঙ্কর স্বাদের চপ বিক্রি হয়? কিম্বা কালনা থেকে সটান সোজা রাস্তায় বাড়ি ফেরা। দুই পাশে দুলে উঠা ধানগাছের মধ্যে জীবন খোঁজা।

জানি একবার শৈশব চলে গেলে তা আর ফিরে আসে না। ফিরে আসে কেবল মৃত্যু।

 

চিত্রা নদীতে সন্ধ্যা নামছে

আবছায়া আলো ফেলে পৃথিবীর রূপবান সন্ধ্যা আসছে

এইসব সন্ধ্যার দিনে বিপ্লবের ঘোর

নিয়ে যায় অদ্ভুত গল্পের দেশে

তখন আবছা আলোয় ভেসে যায় চিত্রা।

 

লেখক : অবস্থান করছেন নেদারল্যান্ডসের ডান হেগ অঞ্চলে।