বাংলাদেশে বাঁশ উৎসব!
মনে পড়ে গত বছর সিঙ্গাপুরের বাংলাদেশি হাইকমিশন দূতাবাসের বাইরে নোটিশ ঝুলিয়েছিলেন পাসপোর্টের কাজে আসা শ্রমিকদের শৃঙ্খলা রক্ষা করার জন্য। দুঃখজনক হলো, ইংরেজিতে বাংলাদেশ লিখতে গিয়ে ভুলে তাঁরা লিখে বসেছিলেন বালাদেশ (Baladesh)!! এর কয়েক দিন পরে তাদের বিভিন্ন ফরমে পাওয়া গেল আরো মারাত্মক ভুল। দেখলাম, সেখানে ইংরেজিতে সিঙ্গাপুর লিখতে গিয়ে সিঙ্গাপিউর (Singapure) লিখেছেন। এতেও হতাশ হলাম।
সিঙ্গাপুরের একমাত্র বাংলা পত্রিকা 'বাংলার কণ্ঠে' এ নিয়ে রিপোর্ট হয়েছে। এ জন্য সে সময় দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে লিখেছিলাম, ‘বালাদেশ আবার কোন দেশ?’
এটা কি ত্রিশ লক্ষ শহীদের দেশ?
শেষে আরো লিখেছিলাম, যাঁরা আমাদের টাকায় ভোগবিলাস করেন, স্বদেশের প্রতিনিধিত্ব করতে বিদেশে এসে বাংলাদেশের নাম লিখতে ভুল করেন, তাঁদের নিয়ে আমরা কী করব?
যাই হোক, ইদানীং বাঁশ নিয়ে বেশ আলাপ হচ্ছে। ভবন নির্মাণে রডের বদলে বাঁশ এখন টক অব দ্য কান্ট্রি।
বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারি ভবনে রডের বদলে বাঁশ দেওয়ার বেশ কয়েকটি রিপোর্ট পত্রপত্রিকায় ফলাও করে প্রকাশ করা হয়েছে। প্রবাসে বসে ভাবি, বাংলাদেশে কি বাঁশ উৎসব চলছে? ভেবে অবাক হই। ভূমিকম্পের পর বাংলাদেশে অনেক ভবন পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে, রানা প্লাজা হয়ে আছে বিশ্বের অন্যতম ইতিহাস, সেখানে সরকারি ভবনে রডের বদলে বাঁশ ব্যবহার করে সমগ্র জাতিকে বাঁশ দিয়ে যাচ্ছেন কারা? এই কীটপতঙ্গের উৎপত্তি কোথায়, এদের মদদদাতাই বা কারা? এই রডচোরের সম্রাট কে?
রাতের অন্ধকারে বাঁশ উৎসবের মধ্য দিয়ে না জানি কত বছর কতকাল কত ভবন এভাবেই নির্মিত হয়েছে! বাঙালি জাতি সংগ্রামী জাতি, এরা কাঁদতে জানে না, আজ আমাদের সংগ্রাম কাদের বিরুদ্ধে?
১৭৫৭-তে সিরাজউদ্দৌলার ডাকে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করলাম, তিতুমীর-ক্ষুদিরামের মতো ফাঁসিতে ঝুললাম, ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার সূর্য উদিত হওয়ার মুহূর্তে মাতৃভাষাকে হারাতে বসলাম, আবার সংগ্রাম ভাষার জন্য, শিক্ষার অধিকারের জন্য, এর পর বঙ্গবন্ধুর ডাকে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে সরাসরি সংগ্রাম করলাম, স্বাধীন দেশে গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করালাম, কিন্তু স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী ছুঁতে যাওয়া বাংলাদেশে আজো বাঙালি সংগ্রামবিমুখ হতে পারল না।
আজ আমাদের সংগ্রাম কাদের বিরুদ্ধে? কে এর নেতৃত্বে? কিছুই জানা নেই, তবু যুদ্ধের মাঠেই প্রহর গোনা। যুদ্ধরত বাঙালিরা মারা যাবে, আহত হবে, এটা অস্বাভাবিক নয়; হত্যাকারী, আহতকারীও বড় অপরাধী নয়। তবে নিরীহ বাঙালি, যারা একটু আশ্রয়ের জন্য, একটু মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য ছুটে যাচ্ছে সরকারি ভবনে, সেই ভবনে স্বার্থসিদ্ধির জন্য নির্ঘাত মৃত্যুর ফাঁদ পেতে রেখেছে যারা, তারা মোটেও ছোটখাটো অপরাধী নয়, হতেই পারে না। নিরীহ মানুষের জন্য মৃত্যুর ফাঁদ তৈরি করা এসব ব্যক্তির তিনবার ফাঁসি হওয়া উচিত।
সংগ্রামের প্রতিপক্ষ কে? জানি না। সংগ্রামের নেতা কে? তা-ও জানি না। কিন্তু সংগ্রাম অনিবার্য। রাজপথ যেমন নিরাপদ নয়, নির্জনতা যেমন নিরাপদ নয়, সরকারি আশ্রয়কেন্দ্র শিক্ষালয় আজ ঠিক তেমনি অনিরাপদ। অনিরাপদের অকল্পনীয় ইতিহাসের পাতায় বাঁচার জন্য বাঙালিকে সংগ্রামেই থাকতে হবে, যুদ্ধের লক্ষ্যচ্যুত সংগ্রামী বাঙালিকে শুধু বাঁশ উৎবের সম্রাট, সদস্য ও ইন্ধনদাতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে গেলেই হবে না, সভ্যতার সব জঞ্জালের বিরদ্ধে যুদ্ধে যেতে হবে, সংগ্রাম আমাদের অস্তিত্ব হলে বিপ্লব অনিবার্য।