প্রবাসীদের কবিতায় বৈশাখ

Looks like you've blocked notifications!
সিঙ্গাপুরে বাংলা সাহিত্যের প্রাণকেন্দ্র, বাংলাদেশ সেন্টার।

এখানে বৈশাখ নেই!  

আছে রজব, শাওয়াল ও শাবান। 

এখানে ইলিশ নেই! 

আছে হামুর, সেহরি ও রুবিয়ান।

তাই বলে কি মোরা বাঙালি নই?

হয়েছি কি আরাবিয়ান?

‘এবারের বৈশাখে’ শিরোনামের কবিতায় স্তবকটি লিখেছেন সৌদি আরবের প্রবাসী কবি আবদুল্লাহ সোলাইমান। ১৬ কোটি বাংলাদেশির প্রায় এক কোটি প্রবাসী। বিদেশের মাটিতে অর্থ সংগ্রহের এই মহান যোদ্ধারা আত্মীয়স্বজন, বন্ধুদের মায়া-মমতার আশায় করুণ চোখে তাকিয়ে থাকেন স্বদেশের দিকে। মাতৃভূমিতে এঁদের জীবিকার সুযোগ না হলেও অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে তাঁরাই রাখছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। শত হাহাকার শত বেদনা জড়িয়েও প্রতিদিন স্বদেশের একটু সাফল্য, একটু অর্জনের কথা শোনার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আবহাওয়া ভিন্ন হলেও প্রবাসীরা যেন স্বদেশের আবহাওয়ার ছোঁয়া পান সব সময়, বসন্তে যখন বাংলাদেশ ফুলে ফুলে ভরে যায়, তখন প্রবাসীদের হৃদয়ও ফুলে ফুলে ছেয়ে যায়, তারাও কবিতা, গানে বসন্তের স্বাদ গ্রহণ করেন, অনলাইন পত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন ফিচারে চোখ বুলিয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলেন। নিজেরাও তাঁদের কবিতায় রাঙিয়ে তোলেন ফেসবুকের ওয়াল।

 
পহেলা বৈশাখে প্রতিবছর পালন করা হয় বাঙালির চিরাচরিত ঐতিহ্যবাহী বর্ষবরণ উৎসব, এই দিনে বাঙালির প্রাণে বয়ে যায় নতুনের বারতা, বাঙালিরা পুরোনোকে বিদায় দিয়ে নতুনকে বরণ করে নেন হৃদয়ের সবটুকু ভালোবাসা দিয়ে, এসো হে বৈশাখ এসো এসো
কবিগুরুর কবিতা দিয়ে নববর্ষকে স্বাগত জানান। বৈশাখ নিয়ে দূর সুদূরে থেকেও প্রিয় কবিদের মতো প্রবাসীরাও লেখেন কবিতা, গান।

সিঙ্গাপুরপ্রবাসী কবি জাকির হোসেন খোকন বৈশাখ নিয়ে তাঁর কবিতায় লিখেছেন-

‘বৈশাখের বুকের ভেতর যে ভালোবাসার রং থাকে

সে রঙে রঙিন হব

তুমি আর আমি।

সুখের গাল ছুঁয়ে নববর্ষের সারাটা দিন বলব

ভালোবাসি, ভালোবাসি।’

মালয়েশিয়াপ্রবাসী কবি সালমান বৃশ্চিক ‘এসেছে বৈশাখ’ কবিতায় লিখেছেন-

 
‘ওড়ায়ে ধুলা দোলায়ে অগ্নি,

ধূম্র দাহে অগ্নি ঝরি।

আহা! মরি মরি দগ্ধ দিগম্বর,

শালপাতা হয় ধূসর অম্বর।

কাল মরুতে মত্ত মূর্তি অশাখ,

এসেছে কালবৈশাখ,

এসেছে বৈশাখ॥’

 

দুবাইপ্রবাসী মনির হোসেন টুটুল ‘হে বৈশাখ’ কবিতায় লিখেছেন-

‘তুমি আসবে বলে হে বৈশাখ

আমি শত ফুলের ডালি নিয়ে বসে আছি

তোমায় বরণ করব বলে..!

তুমি আসবে বলে চৈত্রের দাবদাহের

উষ্ণ গরমের শুভ্র সকালে সাজিয়েছি

আমার অঙ্গরূপ হে বৈশাখ।’

 

বাহরাইনপ্রবাসী কবি মাহাবুব হাসান লিখেছেন-

‘মনে কি পড়ে সেই পহেলা বৈশাখ?

সেজেছিলে তুমি বৈশাখের সাজে,

চারিপাশে হই হুল্লোড় আর ঢাকঢোল বাজে

রূপালি রাঙা বৈশাখী রূপ দেখেছিলাম সেদিন তোমার মাঝে।’

মালয়েশিয়ার প্রবাসী কবি ফেরারী মুরাদ স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে ‘পহেলা বৈশাখ ও গোলাপের আর্তনাদ’ কবিতায় লিখেছেন-
 

‘আজ পহেলা বৈশাখ

ঠিক সাতটি বছর আগে এমনি দিনে

রমনার বৈশাখী মেলায় ঘুরবে বলে বায়না ধরলে।

টিউশনির জমানো টাকা দিয়ে একটি পাঞ্জাবি কিনে দিলে।

আর বললে ঠিক সকাল ৭টায় গোলাপ হাতে 

যেন টিএসসির মোড়ে থাকি দাঁড়িয়ে।

 

সৌদি আরবপ্রবাসী কবি এম এম বিল্লাহ গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে লিখেছেন-

‘গরম পান্থা ইলিশ ভুলে জাগ্রত হোক মানবতা 

অসহায়ের প্রতি হই নমনীয়, দেই খাদ্যের কিছুটা

হাতে হাত রেখে বন্ধন, চলি একসাথে আগামীর পথে,

বাঙালি চেতনা থাকুক সদা মানবতার শর্তে।’

 

এ ছাড়া সিঙ্গাপুরপ্রবাসী বেশকিছু কবির কবিতা দেওয়া হলো।

কবি তারেক হাসান কৈশোরের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে ‘তাল পাতার বাঁশি’ কবিতায় বাঙালিদের প্রতি আকুতি জানিয়েছেন এভাবে-

‘কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে সব

ঐতিহ্য ধরে রাখতে আসুন এগিয়ে আসি,

প্রবাসীর অনুরোধ, এবার মেলা থেকে

কিনে আনবেন একটা তাল পাতার বাঁশি।’

 

কবি রাজীব শীল জীবনের কবিতায় এসেছে-
 

‘ঘরে ইলিশ থাকুক আর না থাকুক,
পান্তাভাত থাকুক আর না থাকুক
পরিচয়ে আমরা মাছেভাতে বাঙালি।
হৃদয়ে জেগেছে আজ পহেলা বৈশাখ,
হাতে হাত রেখে গাই ‘এসো হে বৈশাখ’।”

প্রতিবাদী কবি কাজী শিহাব উদ্দিন লিটন ‘বৈশাখ এলেই’ কবিতায় খুব আক্ষেপ করেই লিখেছেন-

‘বৈশাখী মেলার আয়োজনে,
কোনোকিছুর কমতি যেন না থাকে,
সবকিছুর করি আয়োজন এত ধুমধামে,
অথচ আমরা অনেকেই জানি না এখনো,
মাসের নাম বাংলা বার মাসের, 
আমরা এখনো জানি না সংস্কৃতি আমাদের,
ভুলে যাই জারি-সারি, মুর্শিদী আর ভাটিয়ালি সুর,
কারো হাতে নেইকো সময় একটু কবিতা শোনার,
অনেকে বলে কবিতা নাকি শুধু প্রলাপ পাগলের।’

প্রবাসী কবি ও সাংবাদিক মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বাবু তাঁর কবিতায় বাঙালি সংস্কৃতির করুণ চিত্র ফুটিয়ে তুলতে গিয়ে লিখেছেন-

‘ঢোল মাদল চাই না তাদের 
চাই না ডিস্কো, হিন্দি 
বৈশাখেতে চলে এখন 
নষ্ট ভাবের ফন্দি।’

কবি মুকুল হোসেন লিখেছেন-
‘হে বৈশাখ
তুমি আবার এলে 
নতুন সাজে নতুন গানের মেলায়,
আজ এই প্রবাসী বেলায়।

হে বৈশাখ
হৃদয়ে আমার বাঙালি ঘ্রাণ
মনে-প্রাণে ভেসে আসে সুর অম্লান
পুরাতন ভুলে দাও নতুনের সন্ধান।’

কবি এম আর মিজান কবিতায় যেমন বৈশাখকে স্বাগত জানিয়েছেন তেমনি আক্ষেপও প্রকাশ করেছেন-

‘অরুণোদয় হয়েছে আজ 
জেগেছে উৎসবে বাংলা,
হৈ হুল্লোড়ে মেতেছে লোকান্তর
চারদিকে ঢোলক, বাঁশি তবলা।
বাঙালিয়ানায় লেগেছে কৃত্রিমতা
উপহাস হয়েছে সব কৃষ্টি,
আয় বাঙালি হয়ে উৎসবে আয়
হোক প্রকৃত বাঙালির সৃষ্টি।’

কবি শরিফ উদ্দিন ‘বৈশাখী ঝড়’ কবিতায় লিখেছেন-
 

‘আমি প্রবাসী
স্বপ্নের আঙিনায় স্মৃতির দোলনায় চড়ি
নতুন বছরেও পুরোনো স্বপ্নের ভিত গড়ি!’

কবি সৈয়দুর রহমান লিটনের নতুন ভাবধারায় রচিত নিউক্লিয়াস কবিতায় বৈশাখ নিয়ে তিনি লিখেছেন-
‘বৈশাখ
তুমি এসো, বারবার 
দুঃখিনীরে করো সংহার, বৃক্ষাদি থুবড়ে করো উল্লাস,
তোমার এবারের জলোচ্ছ্বাসে, মুছে যাবে খুন ধর্ষণ মহামারী, আমার বিশ্বাস।’

কবি কাউসার আহমেদ অপেক্ষার বৈশাখ কবিতায় লিখেছেন- 
‘তুমি যে আজ হারিয়ে গেছ দূরে
বৈশাখ এলেই তোমায় মনে পড়ে। 
এক বৈশাখ কাটিয়ে ছিলে আমার প্রতীক্ষায়,
আমার হাজার বৈশাখ কাটে এখন তোমার অপেক্ষায়।’

কবি বিকাশ নাথ বৈশাখের বর্ণনা দিয়েছেন-
‘বৈশাখ মানে
ছোট্ট খুকির হাতে বাঁশি,
বৈশাখ মানে 
গালে আঁকা লাল সবুজের পতাকায়
হাসি রাশি রাশি।’

কবি ও গায়ক মাসুদ অপু  লিখেছেন-
 

‘সবার ভাবনা বৈশাখ এলে 
পান্তা ইলিশ খাওয়া
আমার ভাবনা তোমায় নিয়ে
বটমূলে  যাওয়া!’

মাহবুব হাসান দিপু বৈশাখকে স্বাগত জানিয়ে লিখেছেন-
 

‘এসেছে এসেছে বৈশাখ 
পাল্টেছে বাংলার চিত্র।
দূর থেকে তাই স্বাগত জানাই-
লিখে কয়েক ছত্র।’

কবি কাজী সজীব লিখেছেন-
 

‘নববর্ষের আভাসমাখা ভোরে
কে গো তুমি উঁকি দাও চুপিসারে?
আলোয় আসো,  সুখেতে ভাসো
অভিমান সব ছুড়ে ফেলো আঁধারে।’

প্রবাসীদের হৃদয়ে বাংলাদেশ,  ভাষা ও সংস্কৃতি, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের মতো বাংলায় যেহেতু জন্ম তাই বাংলাতেই মৃত্যুর স্বপ্ন দেখেন প্রবাসীরা, আর সুখ খোঁজেন স্বজনদের সুখেই।

এসেছে নতুন রোদ
তুলে নাও সব অবরোধ
শত ব্যথা অভিমান ভুলে
হৃদয়ের বাতায়ন খুলে
ক্ষমাতেই নাও প্রতিশোধ।