শাহরু রামাদান, বিশ্ব রবের মহাদান
জুমার দিন যেমন সপ্তাহের সেরা দিবস, রামাদান তেমন বছরের সেরা মাস। এ মাস যেন রহমতের দরিয়া, যে দরিয়ায় অবগাহন করে মুমিন বান্দা পারলৌকিক মুক্তির ঠিকানা খুঁজে পায়। তাই তো মুমিন নিজ আমলকে সমৃদ্ধ করার জন্য ১১ মাস অপেক্ষা করে। কেননা, এ মাসের প্রতিটি নফলের মর্যাদা অন্য মাসের ফরজের সমান এবং একটি ফরজ ইবাদত অন্য মাসের ৭০টি ফরজ ইবাদতের সমান। তা ছাড়া এ মাসে এমন একটি রাত রয়েছে, যা হাজার রজনীর চেয়ে উত্তম।
এই মোবারক মাসের প্রতিটি দশককে আলাদা আলাদা নামে নামাঙ্কিত করা হয়েছে। প্রথম দশক রহমতের, দ্বিতীয় দশক মাগফিরাত তথা ক্ষমার এবং শেষ দশক হলো নাজাত তথা জাহান্নাম থেকে মুক্তির দিবস।
সত্যিই, রামাদান মাস আসার সঙ্গে সঙ্গে রহমতের ধারা প্রবাহিত হতে থাকে। অভিজ্ঞতার নির্যাস থেকে বলতে পারি যে, সারা শাবান মাস প্রচণ্ড খরতাপে দেশ পুড়তে থাকলেও রামাদানের প্রথম রাত থেকেই রহমতের বৃষ্টি পড়তে থাকে। আসলে রহমানের রহমতের ভাগটা অনেক বিশাল। হাদিসে কুদসিতে এসেছে, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন : ‘আমার রহমত আমার রাগের ওপর অগ্রগামী হয়েছে।’
রহমতের দ্বারগুলো এ মাসে সবার জন্য অবারিত। ভাগ্যবানরা তা লুফে নেন সবার আগে।
হাদিস শরিফে এসেছে, আল্লাহর প্রিয়তম হাবিব হজরত মুহাম্মদ (সা.) এরশাদ করেন, যখন রামাদান মাস প্রবেশ করে, তখন আকাশের দ্বারগুলো উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। অন্য বর্ণনায় এসেছে, জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। আর শয়তানদের শিকলাবদ্ধ করা হয়। অপর বর্ণনায় আছে, রহমতের দ্বারগুলো অবারিত করা হয়। (মিশকাত শরিফ-১৮৫৫)
এ মাসের প্রথম রাত থেকে একজন আহ্বানকারী আহ্বান করতে থাকেন এ কথা বলে যে, হে কল্যাণ তালাশকারী সম্মুখে ‘অগ্রসর হও’ আর হে মন্দের অন্বেষণকারী ‘থেমে যাও’। (মিশকাত-১৮৬৪)
এ মাস ধৈর্যের মাস, আর ধৈর্যের প্রতিদান হলো জান্নাত। পারস্পরিক সহানুভূতির মাস হিসেবে রামাদানের কোনো জুড়ি নেই। কেননা, রোজার উপবাসের মধ্য দিয়ে ধনীরা ক্ষুধা-পিপাসা কাতর অভাবীর দুঃখ-কষ্ট অনুধাবন করতে সক্ষম হন। ফলে তাঁরা এ মাসের ফকির-মিসকিনের প্রতি একটু বেশি সহানুভূতিশীল হয়ে ওঠেন।
তাই তো দেখা যায়, প্রিয় নবী (সা.) এ মাসে প্রত্যেক বন্দীকে মুক্তি করে দিতেন এবং প্রত্যেক ভিক্ষুককে দান করতেন।
এই বরকতময় মাসকে উপলক্ষ করে সারা বছর জান্নাতকে সুসজ্জিত করা হয়। যেমন হাদিস শরিফে এসেছে, বিশ্বনবী (সা.) এরশাদ করেন, বছরের প্রথম থেকে পরবর্তী বছর পর্যন্ত রামাদানকে উদ্দেশ করে জান্নাতকে সুসজ্জিত করা হয়ে থাকে। অতঃপর যখন রামাদানের প্রথম দিন আসে, তখন আরশের নিচে জান্নাতের গাছের পাতা হতে ডাগর ডাগর চোখবিশিষ্ট হরদের প্রতি এক প্রকার বাতাস প্রবাহিত হয়। তখন তাঁরা (হরগণ) বলেন, হে আমাদের প্রতিপালক। আপনার বান্দাদের মধ্য থেকে আমাদের জন্য এমন স্বামীগণ নির্ধারিত করুন, যাদের দেখে আমাদের চোখ শীতল হবে এবং আমাদের দেখে তাদের চোখ ঠান্ডা হবে। (মিশকাত শরিফ-১৮৭০)
সর্বোপরি এ মুক্তির মাসে অবতীর্ণ হয়েছে বিশ্বমানবতার আলোর দিশারী মহাগ্রন্থ আল কোরআন। যেমন : আল্লাহতায়ালা বলেন—
রামাদান (এমন একটি মাস), যাতে কোরআন নাজিল করা হয়েছে, আর এই কোরআন (হচ্ছে) মানবজাতির জন্য পথের দিশা, সৎপথের সুস্পষ্ট নিদর্শন এবং (মানুষের জন্য হক বাতিলের) পাথর্ক্যকারী।
তা ছাড়া এ মহান মাসের প্রথম রাতে মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর ওপর ছাইফাসমূহ অবতারিত হয়। তাওরাত নাজিল করা হয় ৭ রামদানে, ইনজিল অবতারিত হয় এই মাসের ১৪ তারিখে এবং যাবুর অবতারিত হয় অত্র মাসে ১৩ তারিখে।
প্রান্তিক ক্ষণে এসে বোখারি শরিফের ৬ নম্বর হাদিস দিয়ে লেখার ইতি টানছি। হাদিসটি হজরত ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন—আল্লাহর রাসূল (সা.) মানুষের মধ্যে অধিক দানশীল ছিলেন এবং প্রিয় নবী (সা.) রামাদান মাসে দানশীলতার চূড়ান্ত স্তরে পৌঁছতেন, যখন জিবরাঈল (আ.) তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন। আর জিবরাঈল (আ.) রামাদানের প্রতি রাতেই আল্লাহর প্রিয়তম হাবিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন এবং তাঁকে কোরআন শিক্ষা দিতেন। অবশ্যই আল্লাহর রাসূল (সা.) প্রবহমান বায়ুর চেয়েও অধিক দানশীল ছিলেন।
মাওলানা সাখাওয়াত হোসেন : প্রভাষক, আরবি বিভাগ, উত্তর বাড্ডা ইসলামীয়া কামিল মাদ্রাসা