সঠিক জাকাত আদায়ে দারিদ্র্য বিমোচন সম্ভব

ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে জাকাত একটি অন্যতম। জাকাত অর্থ পরিচ্ছন্নতা, পবিত্রতা ও বৃদ্ধি। মুসলমানদের নিসাব পরিমাণ ধন-সম্পদের একটি নির্দিষ্ট অংশ বছর পূর্তিতে আল্লাহতায়ালার নির্ধারিত খাতসমূহে ব্যয় করাকে জাকাত বলে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর তাদের (ধনীদের) সম্পদে অবশ্যই দরিদ্র ও বঞ্চিতদের অধিকার রয়েছে’ (আল-যারিয়াত : ১৯)। জাকাত ইসলামে ধনী-গরিবের মধ্যে সেতুবন্ধ। নিসাব মানে নির্ধারিত পরিমাণ বা মাত্রা। যে পরিমাণ সম্পদ থাকলে জাকাত ফরজ হয়, তাকে নিসাব বলে। অর্থাৎ দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় ব্যয় বাদে নিসাব পরিমাণ মালের অধিকারী হলে বছর পূর্তিতে একটি নির্দিষ্ট অংশ আল্লাহর নির্ধারিত খাতে জাকাত দিতে হয়।
যেসব সম্পদ নিসাব পরিমাণ থাকলে জাকাত দিতে হয়, সেগুলো হলো—১. সোনা, রুপা (নগদ অর্থ ও গহনাপত্রসহ), ২. গবাদিপশু, ৩. জমিতে উৎপন্ন ফসল, ৪. ব্যবসা-বাণিজ্যের পণ্য, ৫. অর্জিত সম্পদ ইত্যাদি। সোনা সাড়ে সাত ভরি বা সাড়ে সাত তোলা (৮৭.২৫ গ্রাম) বা রুপা সাড়ে বায়ান্ন তোলা (৬১২.২৫ গ্রাম) অথবা এর তৈরি গয়না থাকলে জাকাত দিতে হয়। এর কোনো একটি অথবা উভয়টির মূল্য পরিমাণ অন্য কোনো সম্পদ থাকলেও তার মূলের আড়াই শতাংশ হারে জাকাত দিতে হবে। জাকাত দেওয়ারও একটি নিয়ম রয়েছে। সবাইকেই জাকাত দেওয়া যাবে না। যাঁদের জাকাত দেওয়া যাবে, তাঁরা হলেন—১. ফকির বা অভাবগ্রস্ত, ২. মিসকিন বা সম্পদহীন, ৩. জাকাতের জন্য নিয়োজিত কর্মচারীবৃন্দ, ৪. ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হতে পারে এমন ব্যক্তি, ৫. দাসমুক্তি, ৬. ঋণগ্রস্ত, ৭. আল্লাহর পথে সংগ্রামকারী ও ৮. অসহায় পথিকদের জন্য।
জাকাত পরিশোধের জন্য কোনো নির্ধারিত সময় নেই যে তা শুধু রমজানেই দিতে হবে। তবে বছরে একবার দিতে হয়। বলা আছে, বছর পূর্তিতে জাকাত দিতে হবে। অর্থাৎ একবার যখন দেওয়া হলো, সেখান থেকে পরের বছর ঠিক সে সময়ই জাকাত পরিশোধ করা যেতে পারে। রমজানের ঈদকে জাকাত প্রদানের জন্য উপযুক্ত সময় মনে করা হয় এ জন্য যে, এ সময় দিলে জাকাত প্রার্থীদের জন্য সবচেয়ে বেশি উপকারে আসে। আগেই বলা হয়েছে, জাকাত কিন্তু গরিবের জন্য কোনো ধরনের দয়া প্রদর্শন নয়; বরং এটি জাকাতযোগ্য ব্যক্তিদের বাড়িতে বাড়িতে গোপনে পৌঁছে দিতে পারলে আরো বেশি ভালো। কোনো ব্যক্তির সম্পত্তি জাকাতযোগ্য হলে তা পরিশোধ না করা পর্যন্ত তার ধন-সম্পত্তি পাক-পবিত্র হয় না। জাকাতপ্রাপ্তিতে ধনীদের প্রতি গরিবদের দাবি রয়েছে; বরং ধনী ব্যক্তি গরিবের হক মেরে খাচ্ছেন হিসেবে বিবেচনা করলেও ভুল হবে না। কারণ ইসলাম ধর্মমতে, সবার মধ্যে ধনী-গরিবের ব্যবধান কমিয়ে আনার জন্য জাকাতকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে রাখা হয়েছে। মানুষের অর্জিত সম্পদের সুষম বণ্টনের জন্য যেমন রাজনৈতিকভাবে গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক, ধনতান্ত্রিক কতশত সমাজব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে। সবকিছুই হলো মানুষের কল্যাণ ও সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের জন্য, কিন্তু ইসলাম ধর্মের জাকাত বিধান হলো সমাজের আর্থিক ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য তা একটি উৎকৃষ্টতম পন্থা।
এই জাকাত বিতরণ করতে গিয়ে প্রতিবছর কোথাও না কোথাও দেখা দেয় যত বিপত্তি। যেমন গতবছর (২০১৫) অনিয়মতান্ত্রিক ও অগোছালোভাবে জাকাত বিতরণ করতে গিয়ে ময়মনসিংহে ২৭টি হতদরিদ্র মানুষের প্রাণ ঝরে পড়েছিল। এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত এই জাকাত বিতরণ করতে গিয়ে বিভিন্ন স্থানে নানা সময়ে তিন শতাধিক জাকাতপ্রার্থী মানুষের মৃত্যু হয়েছে। কী কারণে হয় এসব মৃত্যুর ঘটনা! জাকাত হলো গোপনে পালনের একটি ধর্মীয় দায়িত্ব। সেখানে আগে থেকে যার যার নিজ নিজ এলাকায় প্রতিবেশীদের ভেতর জাকাত প্রাপ্য, সেসব ব্যক্তিকে গোপনে তালিকা প্রণয়ন করে তা বাড়িতে বাড়িতে বিতরণের ব্যবস্থা নিতে হয়। কিন্তু দেখা গেছে, সবাই তাদের নিজস্ব সম্পদের নিসাব পরিমাণ হলেই জাকাত তো পরিশোধ করছেনই না, বরং যখন বিতরণ করছেন তখন একে সামাজিক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে একটি প্রচার-প্রচারণার ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছেন। সে জন্য তারা রমজানের ঈদ সামনে নিয়ে নিজেদের সমাজের কাছে জাহির করার মানসে জাকাত বিতরণের নামে শাড়ি কিংবা লুঙ্গি প্রদান করে থাকেন।
সেই জাকাত বিতরণের সময় কোনোরকম পূর্বপ্রস্তুতি থাকে না, কোনো শৃঙ্খলা থাকে না, প্রশাসনকে জানানো হয় না, পুলিশসহ কোনো নিরাপত্তাকর্মীদের কোনো বেষ্টনী থাকে না, জাকাত প্রদানের সংখ্যা কিংবা আগে থেকে কোনো তালিকা করা থাকে না। ফলে যা হওয়ার তা-ই হয়। এমনও দেখা গেছে যে, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রাষ্ট্রপতি হিসেবে রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকাকালে ১৯৮৭ সালে কোনো নিয়মশৃঙ্খলা না মেনে জাকাত বিতরণকালে তখনো খোদ ক্যান্টনমেন্টের ভেতরেই পুলিশের লাঠিচার্জে চারজন মারা যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছিল। আর এসব ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনার স্বীকারে পরিণত হয় নারী ও শিশুরা। তা ছাড়া বিভিন্ন সময়ে পদপিষ্ট ও ভিড়ের চাপে পড়ে যাঁরা নিহত হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ১৯৮০ সালে ঢাকার জুরাইনে ১৩ জন, ১৯৮৩ সালে ঢাকায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে তিন শিশু, ১৯৮৯ সালে চাঁদপুরে ১৪ জন, ১৯৯০ সালে চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে ৩৫ জন, পরের বছর ১৯৯১ সালে আবারও সেই চট্টগ্রামেই ৩২ জন, ২০০২ সালে গাইবান্ধায় ৪২ জন, ২০০৩ সালের ঢাকার শাহজানপুরে ৯ জন, ২০০৫ সালে আবারও গাইবান্ধায় ৩৭ জন, ২০০৬ সালে পটুয়াখালী ও ময়মনসিংহে নয়জন, ২০১০ সালে চট্টগ্রামে একজন, ২০১১ সালে আকিজ গ্রুপের কার্যালয়ের সামনে থেকে সাতজন, ২০১২ রাজধানীতে তিনজন, ২০১৪ বরিশাল ও মানিকগঞ্জে ২৫ জন, আর সর্বশেষ ২০১৫ সালের ১০ জুলাই ময়মনসিংহ থেকে কাপড় নেওয়ার জন্য এসে লাশ হয়েছিল ২৭ জন, যা আগেই উল্লেখ করেছি। অথচ একটু সতর্কভাবে পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে করলে সহজেই এসব মৃত্যু এড়ানো যেত। সঠিকভাবে ধর্মীয় বিধিবিধান মেনে সবাই যদি জাকাত পরিশোধ করত, তাহলে একমাত্র জাকাতের মাধ্যমেই দেশের দারিদ্র্য বিমোচন করা সম্ভব হয়ে উঠত।
এ সম্পর্কিত একটি পরিসংখ্যান এখানে তুলে ধরলেই তা একটু পরিষ্কার হবে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশের ২১ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। ভূমিহীন পরিবারের সংখ্যা ১৫ লাখ আট হাজার ৮৭৬ জন। ইসলামী ব্যাংক কনসালটেটিভ ফোরামের (আইবিসিএফ) তথ্যমতে, শুধু মানুষের ব্যাংকে গচ্ছিত জমা টাকার আমানত থেকেই ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকার জাকাত আদায় করা সম্ভব। সেন্টার ফর জাকাত ম্যানেজমেন্টের (সিজেডএম) এক গবেষণা তথ্যমতে, বর্তমানে বাংলাদেশে জাকাতযোগ্য অর্থের পরিমাণ ১০ লাখ কোটি টাকা। আড়াই শতাংশ হারে এ থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকা আদায় করা সম্ভব, যা বাংলাদেশের বার্ষিক মোট উন্নয়ন কর্মসূচির ৪০ শতাংশ। যদি এ ২৫ হাজার কোটি টাকা আদায় করা যায়, তাহলে সেই অর্থ সমভাগে ১৫ লাখ মানুষকে বিতরণ করলে তাদের প্রত্যেকের ভাগে দেড় লাখ টাকারও বেশি পড়বে। তাহলে কী দাঁড়াচ্ছে!
যখন এ দেড় লাখ টাকা তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে দেওয়া যায়, তাহলে দুই-তিন বছর পরে আবার তারাই জাকাত দেওয়ার উপযুক্ত হয়ে উঠবে। তবে হিসাব কষে যত সহজ মনে হলো, বিষয়টি কিন্তু মোটেও তত সহজ নয়। কিন্তু সঠিক উদ্যোগ নিলে তা আবার অসম্ভবও নয়। কারণ, মুসলিম দেশ হিসেবে এশিয়ারই একটি দেশ মালয়েশিয়া এমন একটি জাকাত ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি প্রয়োগ করে সফল হয়েছে তাদের দেশে। কিন্তু বাংলাদেশে বর্তমানে যে জাকাত ব্যবস্থাপনা রয়েছে, তার মাধ্যমে সে স্বপ্ন পূরণ করা যাবে না। টাকা হলো মানুষের, সেখানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার যদি একটু একটু করে উদ্যোগ নেয়, তাহলে তা অবশ্যই বাস্তবায়ন করা সম্ভব। কারণ, দেশের মানুষের আয়ের একটি বিরাট অংশ যদি আয়কর হিসেবে বাধ্যতামূলকভাবে দেওয়ার বিধান থাকে এবং তার অংশীদারিত্বের ভিত্তিতেই দেশের জাতীয় বাজেট প্রণয়ন হতে পারে, তবে কেন জাকাত আদায়ের ক্ষেত্রে হবে না। এ কাজটি সরকারের ধর্ম মন্ত্রণালয়ের ইসলামী ফাউন্ডেশনের আওতাধীন বর্তমানে জাকাত বোর্ডকে কার্যকর করার মাধ্যমে করা সম্ভব।
লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।