ইতিহাসের পথে
ঢাকার প্রথম মসজিদ
 
রাজধানীর কোলাহলপূর্ণ নারিন্দা এলাকায়, বলধা গার্ডেনের পাশ দিয়ে খ্রিষ্টান কবরস্থানকে বাঁয়ে রেখে কিছুটা এগিয়ে গেলেই চোখে পড়ে স্থাপত্যের এক প্রাচীন নিদর্শন বিনত বিবির মসজিদ। এটি শুধু একটি মসজিদ নয়, এটি ঢাকার মুসলিম স্থাপত্যের নীরব সাক্ষী।
বর্তমানে এই প্রাচীন কাঠামোর গা-ঘেঁষে নির্মিত হয়েছে প্রায় ২৪ তলা বাড়ির সমান ২৪৩ ফুট উঁচু এক বিশাল মিনার। চারপাশে বহুতল ভবন মাথা তুলে দাঁড়ানোয় পুরোনো মসজিদটিকে সরাসরি সামনে না এলে দেখা যায় না, তবে এর নতুন মিনারটি দূর থেকেই ঢাকার আকাশকে ছুঁয়ে থাকার বার্তা দেয়।
প্রতিষ্ঠা ও ঐতিহাসিক পটভূমি
এই প্রাচীন মসজিদটি পুরান ঢাকার নারিন্দায় প্রতিষ্ঠিত হয় ৮৬১ হিজরিতে, যা খ্রিষ্টীয় ১৪৫৬ সালের সমসাময়িক। শিলালিপি অনুসারে, মসজিদটি নির্মিত হয়েছিল সুলতানি আমলে, যখন সুলতান নাসির-উদ্-দীন মাহমুদ শাহ বাংলা সালতানাত পরিচালনা করছিলেন। এর গায়ে উৎকীর্ণ শিলালিপি থেকে জানা যায়, কোনো এক মরহমতের কন্যা মোসাম্মত বখত বিনত (পুরো নাম মোসাম্মত বখত বিনত দোখতর-ই-মরহমত) এই মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন।
ইতিহাসবিদেরা একমত যে, এটিই রাজধানীর সবচেয়ে প্রাচীন মসজিদ এবং প্রাক-মোগল যুগের অন্যতম প্রধান স্থাপত্য নিদর্শন। প্রত্নতত্ত্ববিদ ও ঐতিহাসিক আ ক ম যাকারিয়া তাঁর 'বাংলাদেশের প্রত্নসম্পদ' বইয়ে এটিকে 'লিপি প্রমাণে ঢাকার প্রাচীনতম মসজিদ' হিসেবে উল্লেখ করেছেন, সেই অর্থে একে ঢাকার প্রথম মসজিদও বলা হয়।
বিনত বিবির পরিচয়: রহস্য ও তথ্যের খোঁজ
'বিনত বিবির মসজিদ: ঢাকার প্রথম মুসলিম স্থাপনা' হিসেবে পরিচিত এই ইমারতটির প্রতিষ্ঠাতা বিনত বিবির পরিচয় নিয়ে কিছু বিভ্রান্তি ছিল। উইকিপিডিয়াসহ কিছু জায়গায় তাঁকে সুলতান নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহের কন্যা বলা হলেও, ড. মুনতাসীর মামুনের মতো গবেষকদের লেখায় বিনত বিবিকে 'মারহামাত'-এর কন্যা হিসেবে উল্লেখ করা হয়। বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের অফিশিয়াল ওয়েবসাইটের তথ্য এই রহস্যের জট খুলে দেয়। জানা যায়, মসজিদটি নির্মাণ করেন মূলত বিনত বিবির বাবা আরাকান আলী, যিনি পারস্য উপসাগরের অঞ্চল থেকে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে নারিন্দা-ধোলাইখাল এলাকায় এসেছিলেন।
সেই সময়ে এখানে বুড়িগঙ্গার একটি শাখা প্রবাহিত হতো, যা বাণিজ্যের জন্য সুবিধাজনক ছিল। এখানেই বসবাসকালীন আরাকান আলীর মেয়ে বিনত বিবির আকস্মিক মৃত্যু হলে তাঁকে মসজিদের পাশেই সমাধিস্থ করা হয় এবং পরে আরাকান আলীকেও এখানেই কবর দেওয়া হয়।
পরবর্তীতে এই মসজিদটি বিনত বিবির নামেই পরিচিতি লাভ করে।
স্থাপত্যশৈলী
মূল মসজিদটি ছিল এক গম্বুজবিশিষ্ট এবং বর্গাকৃতির। এর ভেতরের আয়তন ছিল ৩.৬৩ বর্গমিটার, প্রতিটি দেওয়াল ছিল ১.৮৩ মিটার পুরু। মসজিদটির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এর বিশেষ আকৃতির স্তম্ভ, বর্গাকার কক্ষের ওপর অর্ধ বৃত্তাকার গম্বুজ, পূর্ব, উত্তর ও দক্ষিণ দিকে খিলানের ব্যবহার এবং সাদামাটা অলঙ্করণ। মসজিদের ছাদ গোলাকার গম্বুজ দিয়ে ঢাকা এবং এর পূর্ব, উত্তর ও দক্ষিণ দিকে একটি করে মোট তিনটি প্রবেশপথ ছিল। বারবার সংস্কার এবং বাংলা ১৩৩৭ সালে দ্বিতীয় গম্বুজটি স্থাপন ও সম্প্রসারণের ফলে বর্তমানে মসজিদের বাইরের প্রকৃত অবয়ব পাল্টে গেলেও, এর অভ্যন্তরে প্রাক-মোঘল সালতানাতের স্থাপত্য বৈশিষ্ট্যসমূহ বেশ ভালোভাবে লক্ষ্য করা যায়। এই মসজিদের আরেকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো এর শিলালিপি। সম্ভবত ঢাকায় প্রাপ্ত শিলালিপিগুলোর মধ্যে বিনত মসজিদের শিলালিপিটিই ছিল প্রথম মুসলিম শিলালিপি, যা এর ঐতিহাসিক গুরুত্বকে আরও বাড়িয়ে তোলে।
বায়ান্ন হাজার তেপান্ন গলির এই ঢাকায় সকাল আর সন্ধ্যা নামে আজানের সুরে। 'মসজিদের শহর' ঢাকার এই উপাধি যে একদিনে জোড়া হয়নি, তার প্রমাণ দেয় নারিন্দার এই ঐতিহাসিক বিনত বিবির মসজিদ। এটি শুধু একটি প্রাচীন স্থাপনা নয়, এটি ঢাকার ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।

 
                   ফিচার ডেস্ক
                                                  ফিচার ডেস্ক
               
 
 
 
